ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

শাওন শায়লা পিপিএম

সংঘাতপূর্ণ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের কাজ এ সংঘাত নিরসনে কাজ করা। বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা এবং জাতিসমূহের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় সংঘাত পরবর্তী শান্তি বিনির্মানে বর্তমানে শীর্ষ শান্তিরক্ষা প্রেরণকারী দেশ বাংলাদেশ। নিরন্তর সংঘাতের পটভূমিতে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে নিবেদিতপ্রাণ নীল শিরস্ত্রাণধারী বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কর্মকান্ড বিশ্বব্যাপী আজ ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বে মুগ্ধ অন্যান্য দেশের শান্তিরক্ষীরা। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সাথে। বিশ্ব শান্তিরক্ষার কঠিনতর চ্যালেঞ্জে ১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘ শন্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে অদ্যবধি বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা সর্বোচ্চ পেশাদারী মনোভাব, আনুগত্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। গত তিন দশকে যেসব দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করেছেন কর্ম আর দক্ষতায় তা অনন্য হয়ে উঠছে। এ অভূতপূর্ব অবদানের ধারাবাহিকতায় বর্হিবিশ্বে লাল সবুজের পতাকার ভাবমূর্তি উজ্ঝলতর হয়েছে এবং বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা বিশ্বদরবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে জাতিসংঘের ৯টি শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ২৮৪ জন যার মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের ১৫০ জন গর্বিত সদস্য রয়েছেন। অদ্যবধি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর্তমানবতার সেবা দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের ১ হাজার ৬২৩ জন সদস্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করার মাধ্যমে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুসৃত এই আদর্শ অনুসরণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে শান্তি ও সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ।

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় প্রদত্ত তার ঐতিহাসিক ভাষণে বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থনের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত সকল শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে। শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করেছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এই স্থান পুনরুদ্ধার নিঃসন্দেহে একটি ঈর্ষা জাগানিয়া মাইলফলক।

জাতিগত সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোতে শান্তিস্থাপনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অনন্য অবদান যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তাতে বাংলাদেশ পুলিশের নারী শান্তিরক্ষীদের অধিকতর অংশগ্রহণ সম্প্রতি আরো বেগবান হয়েছে। যা একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রাখছে। ২০১১ সালে প্রথম নারী কন্টিনজেন্ট এফপিইউ (ফর্মড পুলিশ ইউনিট) হিসেবে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোয় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেন। দেশের প্রায় দুই হাজার নারী শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে সাফল্যের সঙ্গে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছেন।

মনুস্ক ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এলাকায় ব্যানএফপিইউ-১ এ নিয়োজিত নারী শান্তিরক্ষীগণ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নারী ও শিশুদের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সর্বত্র ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে চলেছে। নারী কন্টিনজেন্ট কমান্ডারের সুনিপুন তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ দলে রয়েছেন ৮২ জন নারী পুলিশ সদস্য। কঙ্গোতে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে মোতায়েনের পূর্বে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার (পিটিসি), টাঙ্গাইল এর নিবিড় তত্ত্ববধানে দক্ষতা উন্নয়ন ও শান্তিরক্ষা মিশন সংশ্লিষ্ট নানামুখী উন্নততর প্রশিক্ষণ প্রদানকরত এ নারী দলটিকে দায়িত্ব পালনের জন্য পরিপূর্ণভাবে উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। এর ফলশ্রুতিতে মিশন এলাকায় আগমনের পর হতে শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিভিন্ন অপারেশনাল কার্যক্রমের পাশাপাশি সংঘাতপীড়িত জনগনকে সহায়তাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে অবদান রেখেছেন তা ইতিমধ্যেই ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত (MONUSCO) অফিসসহ সবার মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। ব্যানএফপিইউ-১ কিনশাসায় MONUSCO ইন্সটলেশন এবং জাতিসংঘে নিয়োজিত কর্মীদের সুরক্ষা প্রদান, শারীরিক সহিংসতার আসন্ন হুমকির অধীনে নাগরিকদের সুরক্ষায় অবদান, জরুরী ক্ষেত্রে নিরাপদ অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়ার কাজ ও উন্নত পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা টহল পরিচালনা করে।

এছাড়াও অস্ত্র প্রশিক্ষণ, সার্চ অ্যান্ড ডিটেকশন প্রশিক্ষণ, আহতদের উদ্ধার প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ও এসকর্ট ড্রিল প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা শানিতকরণ সর্বদা চলমান রয়েছে। নারী পুলিশ সদস্যরা শান্তিরক্ষা মিশনে লাল-সবুজের পতাকা সমুন্নত রেখে দৃঢ় মনোবল ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যথেষ্ট সুনাম ও গৌরব অর্জন করেছেন। বিরাজমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও বিগত ১১ মাস ধরে তারা দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন এবং এ ধারা চলমান রয়েছে। সংঘাতপূর্ণ দরিদ্র এই দেশটিতে স্থানীয় এতিমখানায় শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার ও উপহার সামগ্রী বিতরণ, চিকিৎসা সেবা ও নানান কাজের মাধ্যমে স্থানীয়দের সাথে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের তৈরি হয়েছে এক অনন্য সাধারণ মেলবন্ধন।

নারী পুলিশ সদস্যগণ তাদের পুরুষ সহকর্মীদের পাশাপাশি সকল দায়িত্ব; যেমন রাজধানী কিনশাসা হতে ১১০৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কানাঙ্গায় অস্থায়ী ক্যাম্প পরিচালনা, সীমানা নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তা টহলসহ সকল ধরনের অপারেশনাল কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশী নারী পুলিশ সদস্যগণ স্থানীয় এতিমখানায় ০৯ মে ২০২১ খ্রিঃ তারিখ উপহার সামগ্রী বিতরণের আয়োজন করে। UNPOL WOMEN NETWORK এর প্রেসিডেন্টসহ একটি প্রতিনিধি দল ব্যানএফপিইউ-১ এবং ইজিপ্টএফপিইউ-২ এর শান্তিরক্ষীদলের সাথে মত বিনিময় সভায় অংশ নেয় যাতে তারা পুলিশের কঠিন পেশায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ডিআর কঙ্গোর মত দেশে দায়িত্ব পালনে অর্জিত সফলতার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বাংলাদেশী নারী শান্তিরক্ষীদের তৎপরতা মনুস্ক মিডিয়া যেমন : ওয়েবসাইট, ফেসবুক ইত্যাদিতে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনগন বাংলাদেশী পুলিশের নারী শান্তিরক্ষীদেরকে শুধু সাদরেই গ্রহণ করেননি বরং বাংলাদেশী এই নারী দলের কার্যক্রমকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে তারা নিজেদের নারী জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করত আর্থসামাজিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। নারী শান্তিরক্ষীগণ যুদ্ধপীড়িত নারীদের সমস্যা অনুধাবন এবং সমস্যা সমাধানে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।

কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতা আনয়নের নৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নারীদের ক্রমবর্ধমানহারে সম্পৃক্তকরণে জাতিসংঘে ও বৈশি^ক প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো ব্যানএফপিইউ-১ এ নিয়োজিত শান্তিরক্ষীগণের কর্মতৎপরতা। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের ক্রমোন্নতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পুলিশেও সর্বক্ষেত্রে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নারী পুলিশ শান্তিরক্ষীদের সমন্বিত কর্মদক্ষতা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে বৃহত্তর ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এরই ফলশ্রুতিতে কঙ্গোতে বাঙালি ও বাংলা ভাষার পরিচিতি বেড়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্য পেছনে ফেলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে এ পর্যন্তÍ জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশে পুলিশের ২২ জন গর্বিত সদস্য। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সাফল্যের মূলে রয়েছে আমাদের প্রতিটি শান্তিরক্ষীর ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা, পেশাগত দক্ষতা, দায়িত্ববোধ, মানবিক আচরণ ও সহনশীল মনোভাব। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি সদস্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশের দূতের কাজ করছেন। স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেদিনের সেই পরিবেশে তার স্বপ্নকে হয়তো অলীক মনে হয়েছিল; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই দূরদর্শী চিন্তা আজ বাস্তবরূপ লাভ করেছে। তার অকুতোভয় সুচিন্তিত নেতৃত্বে বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত না হতো, তাহলে হয়তো বাঙালির এ কৃতিত্ব অর্জন অধরাই থেকে যেত।

লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, (ব্যানএফপিইউ-১ রোটেশন-১৪) MONUSCO, DR Congo তে কর্মরত)।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x