ই-পেপার

আফতাব চৌধুরী

সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব, যথেচ্ছ ব্যবহার, অত্যাচার আর খামখেয়ালির কারণে পরিবেশ ও প্রকৃতি আজ বিপন্ন। তাই বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন, মানুষ যদি বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল না হয়, তবে প্রকৃতি অমোঘ নিয়মে প্রতিশোধ নেবেই। প্রাণহীন ও শীতল হয়ে যাবে এ পৃথিবী। তাই তো আজ হয়ত বিশ্ব জনমত দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়ার স্বপ্নে বিভোর। বাংলাদেশে বইছে তার সৃজনী হাওয়া। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত কর্মতৎপরতা ও সতর্কতা লক্ষণীয়।

জনসংখ্যার চাপে বসতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানির প্রয়োজন মিটাতে ক্ষুদ্রাকৃতি এ বাংলাদেশে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে-ক্রমেই, সংকোচিত হয়ে আসছে বনভূমির পরিমাণ। অভাব দেখা দিচ্ছে কাঠ, বাঁশ, ফল-মূল এবং ওষুধপত্র তৈরির প্রয়োজনীয় বনজ দ্রব্যাদির। এভাবে আর ক’বছর চলতে থাকলে দেশে বনভূমির পরিমাণ শূণ্যের কোঠায় এসে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যার পরিণাম হবে ভয়াবহ। মানুষসহ প্রাণীকুল বেঁচে থাকবে না, দেখা দিবে বিপর্যয়, বিধ্বস্ত হবে সভ্যতা, বিপন্ন হবে দেশ ও জাতির অস্তিত্ব।

আমাদের দেশে প্রতি বছর ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রচুর পরিমাণে গাছের চারা রোপণ করা হয় খরচ করা হয় কোটি কোটি টাকা। তার মধ্যে ক’টা গাছের চারা বেঁচে থাকে আর বড় হয় তা একটু পরীক্ষা, পর্যালোচনা করলে এবং পত্র-পত্রিকার সংবাদাদি নিয়ে গবেষণা করলে সার্বিক হাল অবস্থা সহজেই আঁচ করা যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে বৃক্ষ রোপণেই শেষ নয় প্রয়োজন যত্ন, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা এদিকে খুব কমই দৃষ্টি দান করে থাকি। বনভূমি ধ্বংসের বিপরীতে বনাঞ্চল সৃষ্টির প্রয়াসে যেটুকু করা প্রয়োজন, আমরা তা করছি না, প্রয়োজনীয় উৎসাহ-উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমি দীঘদিন ধরে বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং পরিবেশের উপর গবেষণা ও পর্যালোচনা করে আসছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ ও রোপণ করে তা রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে এ ব্যাপারে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তার আলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি নিচে কয়েকটি সুচিন্তিত সুপারিশ পেশ করছি; আর দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি-জরুরি ভিত্তিতে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা ও আন্তরিকতার সাথে এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে এলে সবুজের মহা প্রাচীর বা বনাঞ্চল সৃষ্টি করে দেশ ও জাতিকে মহা বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

সুপারিশমালাঃ

  • আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাস থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তাই এ সময় হতেই যত বড় আকারে সম্ভব গাছের চারা রোপণ করা উচিত। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে না দিয়ে পহেলা মে থেকে সারা বর্ষাকাল বৃক্ষ রোপণ মৌসুম হিসেবে গণ্য করে এ সময়ে বৃক্ষচারা রোপন করতে হবে। তাহলে রোপিত চারা বৃষ্টির মৌসুমে (চার/পাঁচ মাসের মধ্যে) বড় হয়ে গরু-ছাগলের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
  • স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা-মসজিদ সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, বসতবাড়ী, রাস্তার পাশে, নদীর তীরে, বেড়ি বাঁধে, উপকূল বেষ্টনীতে বাধ্যতামূলকভাবে ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপন করার ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণকৃত এসব গাছের চারা দেখাশুনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মহলসমূহের উপর ন্যস্ত করতে হবে। পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সরকারী খাস জমি, টিলা বা মহাল সমূহ, পতিত জমি এবং চা বাগানগুলোর অনাবাদী জমিতে বনাঞ্চল সৃষ্টির দায়িত্ব বন বিভাগের উপর ন্যস্ত করতে হবে। বনাঞ্চল সৃষ্টির জন্য এ জমি লভ্যাংশের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী লিজও দেয়া যেতে পারে।
  • শহরে বাসা-বাড়ীর আঙ্গিনা ও গ্রামাঞ্চলে গাছের চারা রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সব শ্রেণীর মানুষকে সচেতনার মাধ্যমে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং মওসুমের শুরু হতে সরকারি নার্সারি থেকে বড় আকারের পর্যাপ্ত গাছের চারা স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা এবং এরপর সব বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ে নার্সারী প্রতিষ্ঠা করে পর্যাপ্ত বৃক্ষচারা মজুদ রাখতে হবে- যাতে সাধারণ মানুষ তা সহজেই স্বল্পমূল্যে পেতে পারে।
  • বৃক্ষচারা রক্ষণাবেক্ষণে কড়া নজর রাখতে হবে এবং বিভাগীয় প্রধান ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কম করে হলেও মাসে একবার রোপিত বৃক্ষচারা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা, বিভাগ ও জাতীয পর্যায়ে ‘ভিজিলেঞ্চ টিম’ থাকতে হবে- যাতে রোপিত চারা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা হচ্ছে কি না তা মাঝেমধ্যে তদারকি ও এ মহৎ কাজে সংশ্লিষ্ট মহলকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিবেন। রোপিত বৃক্ষের চারা রক্ষণাবেক্ষণে বা পরিচর্যায় কোনো প্রকার গাফিলতি বা আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হলে অথবা অযত্ন-অবহেলায় গাছের চারা নষ্ট হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখতে হবে-তাহলেই বনাঞ্চল সৃষ্টিতে সফলতা আসবে।
  • দেশে কর্মরত সব এনজিওকে (বেসরকারি সংস্থা) প্রতিবছর তাদের কর্ম এলাকায় যে কোনো স্থানে দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তায় বাধ্যতামূলক বৃক্ষ চারা রোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। রোপিত চারা পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ-এর দায়িত্বও তাদের উপরই ন্যস্ত থাকতে হবে।
  • অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিকে জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে ক্ষুদ্রাকারে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
  • আগামী তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত স্থানভেদে গাছ ও বাঁশ কাটা বন্ধ রাখতে হবে। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় ও বিলাস দ্রব্যাদির মতো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে প্রয়োজনীয় কাঠ আমদানি করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমরা জানি মালয়েশিয়া ও জাপানের মতো উন্নত দেশও যেখানে তাদের মোট জমির বেশিরভাগই বনে আচ্ছাদিত তারাও তাদের বনাঞ্চল ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে বিদেশ থেকে কাঠ আমদানি করে থাকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও প্রচুর কাঠ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে থাকে অথচ তাদের দেশে বনভূমির অভাব নেই। তাদের দেশে বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত করে রাখা হচ্ছে।
  • স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যাকে পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ছুটির দিন শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণে উদ্বুদ্ধকরণ কাজে সহায়তা করতে পারেন। মাঝে মধ্যে অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাঠ পর্যায়ে এমনকি হাট-বাজারগুলোয় সেমিনার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে-সবাইকে বুঝাতে হবে বৃক্ষ নিধন এবং বনভূমি উজাড়ের পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে।
  • মসজিদের ইমাম সাহেবরা প্রতি শুক্রবার জু’মার নামাজের সময় এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে গাছপালা বা বনভূমির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে বক্তৃতা বা ওয়াজ করতে পারেন যা অত্যন্ত ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হবে, কারণ আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ এখনো ইমামদের শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে, সম্মান করে এবং মনোযোগ সহকারে তাদের কথা শুনে। এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। অথচ তারা ইমাম সাহেবদের এজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ- এর ব্যবস্থা রেখেছেন।
  • ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার এবং অন্যান্য সব সার্ভিস ক্লাব ও সমাজ উন্নয়নমূলক সংগঠনকে বৃক্ষ রোপন, রক্ষণাবেক্ষন ও পরিচর্যায় সক্রিয় করে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোতে বিশেষ করে পত্র-পত্রিকা, বেতার-টেলিভিশনে বৃক্ষরোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সপক্ষে জোর প্রচারণা চালাতে হবে এবং বৃক্ষ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধনকৃত সব ক্লাব ও সংগঠনকে বাধ্যতামূলকভাবে বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত করতে হবে। এসব ক্লাবকে নিবন্ধন ও অনুদান দেওয়ার সময় বৃক্ষ রোপণের শর্ত আরোপ করা যায়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত ক্লাব, সমিতি, প্রতিষ্ঠানগুলো, মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায়, বিপথগামী তরুণদের সংগঠিত করে বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে। জনস্বার্থে তরুণদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা গেলে সমাজের বহু সমস্যার সমাধানও হবে। এক্ষেত্রে জবাব দিহিতার ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের নার্সারি ব্যবসা এবং বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
  • প্রতি জেলা এবং বিভাগীয় শহরে এবং থানা পর্যায়ে মওসুমের শুরুতে বৃক্ষমেলার আয়োজন করতে হবে এবং মেলা হতে সাধারণ মানুষ যাতে স^ল্পমূল্যে বৃক্ষচারা সংগ্রহ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • পৌরসভা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন পরিষদ, আয়কর বিভাগ প্রভৃতি সংস্থা জনগণ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে একটি নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। যেমন একটি বাড়িতে কটি গাছ আছে- তা রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে কি না? তার প্রজাতি ও সংখ্যা অনুপাতে কর রিবেট দেওয়া যেতে পারে। এতে করে জনগণ স্বতঃফুর্তভাবে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় উৎসাহিত হবেন। পরোক্ষভাবে দেশ, জাতি ও প্রকৃতি লাভবান হবে।
  • নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাড়ির প্ল্যান পাস করার সময় প্রতি বাড়িতে জায়গার অনুপাতে বিভিন্ন ফলজ ও ওষুধি গাছ রোপণ করার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারেন। এতে লোকজন উৎসাহী হবেন।
  • জাতীয়ভাবে ছাড়াও বিভাগীয় পর্যায়ে বৃক্ষ রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে পুরস্কৃত করতে পারলে লোকজন আরো উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত হবেন।
  • একটি গাছ কাটার আগে তিনটি গাছ রোপণ করি’ তাঁর মধ্যে দুটো ফলজ ও একটি বনজ – এ স্লোগানে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

নিশ্চিত করে বলা যায়, উপরে বর্ণিত সুপারিশমালা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়িত করতে পারলে বনাঞ্চল সৃষ্টি করে দেশ ও জাতিকে মহা বিপর্যয় বা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে, সমৃদ্ধ হবে দেশ ও জাতি। পরিবেশ থাকবে সুস্থ, সুন্দর, সবল। প্রাণীকুলের বসবাস উপযোগী বণাঞ্চল সৃষ্টির প্রয়াসে এবং পরিবেশের উন্নয়নে সকলকে অবশ্যই আন্তরিক ও উদ্যোগী হতে হবে, তাহলে সফলতা আসবেই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x