ইরানী বিশ্বাস
পরনে লুঙ্গি, পায়ে স্যান্ডেল, গায়ে মলিন শার্ট, গলায় একটি গামছা ঝুলিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছেন এক পান ব্যবসায়ী। খুলনা সদর থানায় মামলাকৃত সাজাপ্রাপ্ত আসামি ধরতে এভাবেই নিজের পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশ ধারণ করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি ঝিনাইদহ থানার পরিদর্শক। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারেন চুরির মামলায় দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ঝিনাইদহ সদর থানার চাঁদপুর নিজ গ্রামে অবস্থান করছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে তিনি পান ব্যবসায়ী সেজে গ্রামের মাঠে অভিযান চালিয়ে আসামি মমিনুলকে গ্রেফতার করেন।
‘প্রেমের ফাঁদে ফেলে আসামি গ্রেফতার’- এই শিরোনামেই জানা গেল রাজধানীর টঙ্গী এলাকার গৃহবধূ জুয়েনার ঘাতক রাজ্জাক আটকের কাহিনী। এক নারীকে নির্যাতন ও হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে এক নারী পুলিশ এভাবেই আসামি গ্রেফতার করেছে।
আমাদের সমাজে অনেক অপরাধই ঘটে থাকে। তবে সব অপরাধের তদন্তে অপরাধীকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায় না। এই বিশেষ ক্ষেত্রে ১৯৪৩ সালে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল অর্থাৎ PRB এর ২৮২ এর প্রবিধান মতে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্তকরণের জন্য শনাক্তকরণ মহড়া বা Test Identification Parade (TI Parade) প্রবর্তন করা হয়। এটি একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, বস্তু বা প্রাণিকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়া কেবলই পুলিশ বা অন্য কোনো ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ তাদের তদন্ত কার্যে ব্যবহার করে থাকে।
দীর্ঘদিন ধরে জনমনে পুলিশ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রতিষ্ঠিত। এমনকি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগও রয়েছে অনেক। একটা কথা সমাজে প্রচলিত আছে, তা হলো ‘পুলিশি হয়রানি’। অর্থাৎ অন্যায়ভাবে বা বিনা অপরাধে অনেকসময় জনগণকে আটক করা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বেকসুর খালাসও দেওয়া হয়ে থাকে। প্রচলিত কথায় আছে পুলিশে ধরলে সহজে নিস্তার নেই। এখানে পুলিশেরও দোষ নয়। কারণ তদন্তের স্বার্থে অনেক সময় নিরপরাধীকে আটক করে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে আসল অপরাধীর কাছে পৌঁছে যায় পুলিশ। কিন্তু সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয় তাই ঝামেলা মুক্ত থাকতে পুলিশকে এড়িয়ে চলে। হয়তো এভাবেই পুলিশ ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গেছে।
পুলিশ আইনে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার দেওয়া আছে। হয়তো অনেকেই বিষয়টি শুনে কপালে চোখ তুলবেন। কিন্তু বিষয়টি ন্যয়সঙ্গত উপায়ে পুলিশকে এই অধিকার দেয়া হয়েছে। খালি চোখে মানুষ যা অন্যায় হিসেবে বিবেচনা করে, পুলিশের ক্ষেত্রে সবসময় তা সঠিক নয়। ধারণা করা হয় আইনের এই ধারাটি সাধারণ জনগণের কাছে স্পষ্ট নয় বলেই মানুষের মনে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের কর্মকান্ড মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে মানুষ তার স্বাধীনতায় বাধা পায় পুলিশের কাছ থেকে। তাই মানুষের স্বাধীনতাকে প্রতিহত করাকে নিয়মবহির্ভূত কাজ হিসেবে বিবেচ্য করা হয়ে থাকে। হতে পারে এ কারণে পুলিশের এ কাজের প্রভাব মানুষের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। পুলিশের এই অধিকারটি মানুষের প্রতি সব সময় ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রয়োগ হয় না এমন অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানুষ বা জনগণের সঙ্গে পুলিশের সাপে-নেউলে সম্পর্ক আজীবন।
পুলিশের প্রতি যতই ভ্রান্ত ধারণা থাকুক; জনগণ বিপদে পুলিশকেই সবচেয়ে বেশি ভরসা করে। কারণ জনগণের বিপদে পুলিশই তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বর্তমান সময়ে পুলিশ তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। নানা রূপে, নানা মহিমায় বাংলাদেশ পুলিশ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে পুলিশ বহুরূপী। আসামি গ্রেফতারে যেমন চৌকস, জনগণের বিপদে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতেও জুড়ি নেই।
একবার সংবাদে প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি বাস দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে পাশের পানিভর্তি খালে ডুবে যায়। সেখানে কর্মরত পুলিশ তাৎক্ষণিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারী জুতা এবং পোশাক পরা অবস্থায় পানিতে লাফিয়ে পড়ে অনেক জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। এক্ষেত্রে ওই পুলিশ সদস্য মারাও যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাৎক্ষণিক নিজের পরিবার এমনকি নিজের জীবন সংশয়ের কথা জেনেও জনস্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
কিছুদিন আগে একটি অবৈধ শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ময়লার স্তূপ থেকে উদ্ধার করেন এক পুলিশ। সমাজের চোখে অবৈধ সেই নিষ্পাপ শিশুটিকে নিজের ঘরে নিজের পরিচয়ে বড় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এক মানবিক পুলিশ। সম্প্রতি ওটিটি প্লাটফর্মে একটি মুভি মুক্তি পেয়েছে নাম ‘দাগ’। সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে এক পুলিশের মানবিক গুণাবলি নিয়ে। আমরা প্রায় সবাই করোনাকালীন ইউটিউবে একটি ক্লিপস দেখেছি গর্ভবতী এক নারী যানবাহনের অভাবে ভ্যানে করে হাসপাতালে আসছিল। দেরি হওয়ায় হাসপাতালের সামনে রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে বসেছিলেন। টহলরত এক পুলিশ এ দৃশ্য দেখার পর নিজে সেই নারীকে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে যান। মানবিক এই পুলিশ নিজ দায়িত্বে গর্ভবতী মায়ের ভর্তিসহ অন্য সব সহযোগিতা করেন। আমরা দেখেছি পুলিশের ইউনিফর্মে রক্তের দাগ। শুধু তা-ই নয়, আগুনের মধ্য থেকে জীবন বাঁচানোর মতো বহু উদাহরণ রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর ঝুলিতে।
আমরা সবসময় একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবো, যে কোনো বিষয়েরই দুটি দিক থাকে। যার পজেটিভ থাকবে তার নেগেটিভ থাকতে বাধ্য। ব্যতিক্রম কোনো ঘটনাই উদাহরণ হতে পারে না। বাংলাদেশ পুলিশে যেমন মানবিক পুলিশ রয়েছে আবার অনেকেই মানবিক নন। এখানেও রয়েছে কিছু ব্যতিক্রম মানসিকতার মানুষ। তাই বলে গুটিকয়েক মানুষের জন্য পুরো পুলিশ বাহিনীকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে এমন ব্যবস্থা চালু রয়েছে, যাতে বাহিনীর কেউ অপরাধে বা অনিয়মে জড়িয়ে না পড়েন। এর পরও কোনো অভিযোগ পেলে জনস্বার্থে বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে।
বিগত পাঁচ বছরে তুলনামূলক অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, নারী নির্যাতন, অপহরণের মতো অপরাধ অনেক কমে গেছে। এছাড়া আরো একটি দিক বিশেষভাবে পরিলক্ষিত, তা হলো পুলিশ যথাসময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া। প্রচলিত প্রবাদে একটিা বিষয় ছিল অপরাধী পালানোর পর ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি। সম্ভবত পুলিশের উপর থেকে বর্তমান সময়ে এই অপবাদমূলক প্রবাদটি ঘুচে গেছে। সেখানে যোগ হয়েছে ভালো কাজের জন্য পুরস্কারস্বরূপ ‘আইজিপি পুরস্কার’।
অতীতে মামলার তদন্তে কেটে যেত বছরের পর বছর। সঠিক তদন্তের কারণে মামলার রায় পেতে অসুবিধা হতো। একটি মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকতো। বর্তমানে সেই অপবাদটাও ঘুচে গেছে। অপরাধের নিউজ পড়ার কয়েকঘণ্টার মধ্যেই অপরাধ ধরা পড়ার নিউজটাও পেয়ে যায় জনগণ। বাংলাদেশ পুলিশ নিজস্ব মেধার সঙ্গে কিছু প্রযুক্তি ব্যবহারের তৎপরতায় সহজেই কঠিন সমস্যা সমাধান করে চলছে।
লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।