অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল
পাকিস্তানি শাসনের আঠারো বছরের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়। বাঙালি জনসাধারণ ছয় দফাকে ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা মুক্তির সনদ হিসিবে গ্রহণ করলেও পাকিস্তান সরকার ‘পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে প্রচার করতে থাকে ও এর বিপরীতে অবস্থান নেয়। যে-কারণে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছয় দফাকে নির্বাচনি ইশতেহার হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এতে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতার প্রশ্নে টালবাহানা শুরু করে। এর বিপরীতে বাঙালি জনগণ আর নিঃশ্চুপ থাকেনি। শুরু হয় স্বাধীনতার লড়াই। এক রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কাজেই ছয় দফা কর্মসূচি, সত্তরের নির্বাচন এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচি আকষ্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। ছয় দফা কর্মসূচিতে যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট এক দিনে রচিত হয়নি। স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ আঠারো বছরের সংগ্রামের পটভূমিতে এ কর্মসূচি গৃহীত হয়। বস্তুত এ ঘোষণা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবি।
ভারতীয় উপমহাদেশে স্বায়ত্তশাসনের দাবি দীর্ঘ দিনের। ১৯১৬ সালের লক্ষ্যে চুক্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়। কিন্তু ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেম্সফোর্ড সংস্কার আইনে এই দাবি পুরোটা গৃহীত হয়নি। এই আইন দ্বারা গভর্নর জেনারেল ও তার কার্যনির্বাহী পরিষদকে যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিধি ছিল গণ্ডীবদ্ধ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জনগণের ম্যান্ডেটে পরিণত হয়। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা- এ তিনটি বিষয়ে ফেডারেল সরকারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাকিস্তানে একটি ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু তাতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ততোটা প্রদান করা হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত সেই সীমিত স্বায়ত্তশাসনও কখনো বাস্তব রূপলাভ করেনি। সর্বশেষ ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্নকে সম্পূর্ণরূপে গুঁড়িয়ে দেয়।
স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে বাঙালির দীর্ঘ দিনের পথ-পরিক্রমার একটি প্রত্যক্ষ যোগসূত্র তৈরি করে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ। কাশ্মির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে মেতে উঠে। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে তাড়িত করে। যুদ্ধ চলাকালে ৭ কোটি বাঙালির জীবনকে সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত রেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে ব্যস্ত থাকে। ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে হওয়ায় এ-সময় দেশটি প্রায় এক মাসের মতো পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছন্ন ছিল। যুদ্ধ চলাকালে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ না করায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “চীনের ভয়ে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে জড়াতে সাহস করেনি।”এর জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন “পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধকালে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত লেফট রাইট করে হেঁটে যেত তবুও তাদেরকে বাধা দেওয়ার মতো অস্ত্র বা লোকবল কিছুই পূর্ব পাকিস্তানের ছিল না। আর চীনই যদি আমাদের রক্ষাকর্তা হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাধলেই হয়।” এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ক্ষেত্রে শূন্যতা বঙ্গবন্ধুসহ বাঙালি নেতৃবৃন্দকে দারুণভাবে আহত করে। এছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক শোষণ ছিল সীমাহীন। এইরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য করলেন যে, ব্যালটের মাধ্যমেও বাঙালির কোনো কিছু করার জো নেই। ফলে ছয় দফা পরিণত হলো বাঙালির বাঁচার দাবিতে।
১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের বিরোধী দলসমূহ তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতায় এক কনভেনশনে মিলিত হয়। কনভেনশনের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফা উত্থাপন করেন। আওয়ামীলীগের তরুণ নেতৃত্ব ছয় দফাকে সাদরে গ্রহণ করে এবং ঢাকার দেয়ালে ‘বাঁচার দাবি ছয় দফা’, ‘বাঙালির দাবি ছয় দফা’, ছয় দফার মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিহিত’
প্রভৃতি স্লোগান দ্বারা ভরে ফেলে। এই তরুণ নেতৃবৃন্দ ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ব্যানারে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে “আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি” শীর্ষক পুস্তিকা বিলি করে। ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এটি পাস হয়। ১৮-১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা কর্মসূচি অনুমোদিত হয়। এই সভায় বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আব্দুল মমিন কর্তৃক পুস্তিকাকারে ছয় দফা মুদ্রিত হয়। সংক্ষেপে ছয় দফার দাবিসমূহ ছিল নিম্নরূপ-
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন, যেখানে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা থাকবে;
২. বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় প্রদেশের হাতে ন্যাস্ত থাকবে। উল্লিখিত দুটি বিষয় থাকবে ফেডারেল সরকারের হাতে;
৩. পাকিস্তানের উভয় অংশের জন্য পৃথক তবে অবাধ বিনিয়োগযোগ্য মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে। যদি একক মুদ্রা হয় তাহলে মুদ্রা হস্তান্তর রোধ করার উপায় থাকতে হবে।
৪. প্রদেশসমূহের হাতে কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে।
৫. প্রতিটি প্রদেশের মুদ্রা আয়ের জন্য পৃথক একাউন্ট থাকতে হবে।
৬. প্রদেশসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেখানে প্যারামিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের অনুমতি দিতে হবে।
ছয় দফার প্রতিটি দফা প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সদূরপ্রসারী চিন্তার পরিচয় লক্ষণীয়। ছয় দফার উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘ দিনের বিবাদমান সংঘাতকে সীমিত করে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সদ্ভাব তৈরি করা এবং একইসাথে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তুমি তোমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করো, আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এসোনা- ছয় দফার দফাগুলো বিশ্লেষণ করলে এটিই প্রতিয়মান হয়। ছয় দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন- “আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নেছো (নিয়েছ), কতো দেবা (দিবে), কবে যাবা?”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে সহজে মেনে নেবে না। এজন্য আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে পাস হবার পর তিনি ছয় দফার সপক্ষে জনমত গড়েতোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে জনসভায় বক্তৃতা দেন এবং ছয় দফা তুলে ধরেন। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত পঞ্চাশ দিনে ৩২টি জনসভায় ভাষণ দিয়ে তিনি ছয় দফা ব্যাখ্যা করেন। মাত্র পঞ্চাশ দিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফার প্রতি যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয় তা রাজনৈতিক প্রচারণার ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এই সাফল্যের মূলে ছিল বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ ও তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্ব। আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তিনি তরুণদের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব সৃষ্টি করেন। ফলে মে মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বঙ্গবন্ধুসহ দলের প্রায় ৩৫০০ জন নেতা-কর্মী গ্রেফতার হলেও ছয় দফার আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু তাঁর ডাইরিতে লিখেন- “তারা [পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ] ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়।” (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ২০১৭, পৃ.৬৯) এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছয় দফা ব্যাপক জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত হয়। ছয় দফা কর্মসূচি সমগ্র বাঙালির চেতনামূলে বিস্ফোরণ ঘটায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে কতটা শঙ্কিত করে তুলেছিল তা আইয়ুব খানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে অনুধাবন করা যায়। জেনারেল আইয়ুব খান ছয় দফাকে ‘হিন্দু আধিপত্যাধীন যুক্তবাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেন। তিনি ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিদেশি মদদপুষ্ট, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি আখ্যায়িত করেন এবং এর প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘এক নম্বর দুশমন’ হিসেবে চিহ্নিত করে ছয় দফার সমর্থকদের ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেন। এমনকি, ছয় দফা আন্দোলনের পেছনে ভারতের সম্ভাব্য কোনোপ্রকার সহানুভূতি যাতে না থাকে সেজন্য আইয়ুব খান মন্তব্য করেন, Òছয় দফার… স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা গঠনের দাবি আমরা মানিয়া লইলেও ভারত সম্মত হইবে না।” ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খান ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বলেন, Òযারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য চেঁচামেচি করছে তারা পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা কামনা করে। যদি এটা ঘটে তাহলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে।” আইয়ুব খানের মত জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানও মনে করেন- “Six point programme is nothing, but an unjust plan to divide the Country” (Hasan Zaheer, The Seperation of East Pakistan: The Rise and Realization of Bengali Muslim Nationalism, UPL, 2001, p.127).
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ছয় দফার প্রচারণাকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টায় পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে তাঁকে একাধিকবার গ্রেফতার করা হয়। ছয় দফার প্রচারকালে কখনো ঢাকা, কখনো সিলেট, কখনো নারায়ণগঞ্জ, আবার কখনো ময়মনসিংহ-থেকে বঙ্গবন্ধুকে তিন মাসে আটবার গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ ৮ মে তাঁকে গ্রেফতার করে দীর্ঘ সময়ের জন্য কারা-অভ্যন্তরে রাখা হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন দেশব্যাপী হরতালের আহ্বান করা হয়। মিছিলরত জনতার উপর পুলিশের গুলিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু লোক প্রাণ হারায়। এভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা চালায়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ছয় দফা কর্মসূচিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে দুবছরের মাথায় (১৯৬৮ সালে) বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা দায়ের করে, যার সরকারি নাম দেয়া হয় রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ (State vs Sheikh Mujibur Rahman and the Others)। কারণ, পাকিস্তান সরকার দেখল যে বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। কেবল ঘোষণা দিলেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে বিদায় নিতে হবে। অথচ তখনও তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে ছিলেন, কোনো হটকারী সিদ্ধান্তে জড়িত হননি। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্ররা আন্দোলন করে। জনগণ স্লোগান দিল- Òজেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব”। এভাবে আইয়ুব সরকারের জেল-জুলুম, হত্যা-নির্যাতন ছয় দফা আন্দোলনের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটায়। পাকিস্তানি ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি হয় এবং গণঅভ্যুত্থানে (১৯৬৯ সালে) আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে যে সচেতনতা ও ঐক্য গড়ে ওঠে, তার প্রভাব পড়ে সত্তরের নির্বাচনে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয়দাফে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। দলের প্রচারণায় পাকিস্তানের দু’অংশের বৈষম্য তুলে ধরে ছয় দফার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তির আশ^াস দেয়া হয়। ফলে বাঙালি ব্যালটের ভাষায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিবর্তনের জবাব দেয় এবং বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে। অপরদিকে ছয় দফা বিরোধী দলগুলোকে জনগণ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে। ’৭০-এর নির্বাচনি ফলাফল প্রকৃতপক্ষে ছয় দফার প্রতি গণসমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ। এভাবে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বাধীনতা অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে স্বাধীন-সাবভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।
সুতরাং ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন এবং এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো হটকারী ঘটনা নয়। বহু পথপরিক্রমার মধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাঙালি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে নয়। ছয় দফা কর্মসূচি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি অনস্বীকার্য যে, ছয় দফা পরবর্তী আগরতলা মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাঁথা। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস কেবল ২৬ মার্চ, ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এই নয় মাসের যুদ্ধের ইতিহাস নয়। এই যুদ্ধের পূর্বের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেয়। বস্তুত, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ধাপে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। অতএব, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব অনিবার্য ও অপরিহার্য উপাদান। Newsweek ম্যাগাজিন-এর ভাষায়Ñ “But Mujib’s emergence as the embattled leader of a new Bengali; ‘nation’ is the logical outcome of a lifetime spent fighting for Bengali nationalism his presence there is not an accident.” (‘Poet of Politics’, Newsweek, 5 April, 1971)
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি রাজনৈতিক দর-কষাকষির কোনো ব্যাপার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, “ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নাই। যে-কোনো ত্যাগের বিনিময়ে ছয় দফা বাস্তবায়িত করাই আজ আওয়ামী লীগের সংগ্রাম।” সুতরাং এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় লাহোর প্রস্তাব যেরূপ ভূমিকা পালন করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশর অভ্যুদয়ে ছয় দফার ভূমিকা ছিল তদ্রƒপ। বঙ্গবন্ধুর জীবনীকার বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়দুল হকের ভাষায়, ছয় দফা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের ‘অগ্রিম জন্মসনদ’।
ছয় দফা কর্মসূচি ও ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছিলÑ এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলে আসে প্রবীণ রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে আওয়ামীলীগের তরুণ নেতৃবৃন্দের হাতে। আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আশা-আকাঙ্খার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মধ্যম সারির নেতা থেকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
বস্তুতপক্ষে ছয় দফা ছিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘ আঠারো বছরের অর্থনৈতিক শোষণের পরিসমাপ্তির অঙ্গিকার; বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু দেখলেন ছয় দফা বাস্তাবায়িত হলে এদেশের ভাগ্য এদেশবাসী’ই নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে। এর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দফা বাস্তিবায়িত হলে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার বন্ধ হয়ে যেত, দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতো। প্রথম দফায় কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার প্রয়োগক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে দেয়ায় গণতন্ত্রকে হত্যা করে স্বৈরতন্ত্র চালুর সকল সম্ভাবনার দুয়ার চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতো।
প্রকৃতপক্ষে ছয় দফা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপতুল্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়: ‘ছয় দফা বাংলার শ্রমিক-কৃষক, মজুর-মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ, ছয় দফা শোষকের হাত থেকে শোষিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার, ছয় দফা মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি… ছয় দফার সংগ্রাম আমাদের জীবন-মরণের সংগ্রাম।’ যে-কারণে ছয় দফা ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা’য় পরিণত হয়। মূলত ‘ম্যাগনাকার্টা’ হলো ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন কর্তৃক প্রণীত ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের একটি দলিল, যেখানে শোষণহীন সমাজকে কল্পনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে সেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তোলার রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন। সেই অর্থে ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা।
ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিশালী প্রতিবাদ, যে-কারণে বাংলাদেশের সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। বস্তুত, ছয় দফার মধ্যদিয়েই পূর্ব বাংলাকে একটি পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। ছয় দফা ঘোষণার পর ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি)-এর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অ্যধাপক মোজাফ্ফর আহমদ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি এই যে ছয় দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী” উত্তরে বঙ্গবন্ধু আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, “আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।” আর সেটি ছিল স্বায়ত্তশাসন।
ঐতিহাসিক ছয় দফা একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট দাবিমালা, যেখানে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশবাদ থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে জনগণ পাবে অর্থনৈতিক মুক্তি। ছয় দফার মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্থির থেকে অর্থনৈতিক দিকটি সামনে নিয়ে আসার কৌশল তৈরি করেন।
অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল
লেখক : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়