মোঃ আপেল মাহমুদ
দেশ মাতৃকার কৃতি সন্তান, অগ্নিপুরুষ, বিপ্লবী নেতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল অগ্রনায়ক, বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। শেখ মুজিব শুধু একটি নাম নয়। একটি চেতনা ও একটি আদর্শ। একটি জাতির স্বপ্ন, একটি জাতির ইতিহাস। শেখ মুজিব তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, একটি স্বতন্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই কেবল বাংলার ভাগ্য গড়ে উঠতে পারে। তিনি অনুভব করেছিলেন বাঙালির স্বপায়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এর জন্য দরকার মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা। আর সেই অনুপ্রেরণা তিনি তিল তিল করে বাংলার মানুষের মধ্যে তাদের হৃদয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এই মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণাকে পুঁজি করে মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে আপোষহীন নেতৃত্বে বাংলার মানুষের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই বলা যায় শেখ মুজিব মানেই বাঙালির মুক্তি, একটি জাতির সৃষ্টি।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বরেণ্য নেতা। তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ অন্যতম ভাষণ। বাঙালি শত শত বছর ধরে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে, সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে এবং তার ফলে স্বাধীনতার যে প্রত্যাশা উম্মুখ হয়ে উঠেছে তার প্রতিফলন এই ভুবনে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছে। করেছে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ। আর এই ভাষণে সৃষ্টি হয়েছে একটি দেশ, একটি জাতি। তাই তো বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।
তাঁর এই ভাষণ ছিল মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠত্বতায় গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জ্বল, নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতা অর্জন ও আর্থ সামাজিক মুক্তির এক অসামান্য দলিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে মুক্তি ও মুক্ত এই শব্দ দুটি গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। তার মানে স্পষ্টত তিনি বুঝাতে চেয়েছেন বাংলার মানুষ দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। তাই তিনি ভাষণের চতুর্থ লাইনে বলেছেন : ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’। আর এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে বাংলার মানুষের মনের কথাটি তিনি বলেছেন সেই লাইনে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অর্থাৎ তিনি পশ্চিমাদের বুঝিয়ে দিলেন বাঙালি জাতি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সর্বদিক দিয়ে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত তাই এ অবস্থার পরিত্রাণ দরকার। আর এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নাই। এই স্বপ্নই বাঙালি জাতির মধ্যে বুনন করতে বঙ্গবন্ধু সফল হয়েছিলেন এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সক্ষম হয়েছিলেন আনতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যখনই দেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশকে বিশে^র দরবারে তুলে ধরার জন্য দৃঢ় প্রচেষ্টায় রত ঠিক তখনই সেই পাকিস্তানি শত্রুদের মনের আশা পূরনের জন্য তাদের মনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দেশীয় ক্ষমতালোভী দোসরদের হাতে স্বপরিবারে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু খোদাতালার রহমতে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা- আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বোন শেখ রেহানা। জননেত্রী শেখ হাসিনা তিল তিল করে দলকে গুছিয়ে দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকের বাংলাদেশ ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র মুক্ত, নারী শিক্ষায়, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য, খেলায়, সর্ব দিকে বিশে^র দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজকের বাংলাদেশকে কেউ রুখে রাখতে পারবে না, আর পারছেও না যেটা তার ভাষণে বলেছিলেন, বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এটাই আমাদের স্বপ্ন, এটাই আমাদের চেতনা এবং এটাই আমাদের বেঁচে থাকার অগ্নি দিব্য।
আমার বাবা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাবার কাছে শুনতাম যুদ্ধের গল্পকথা, শুনতাম পাকিস্তানী হায়েনারা কীভাবে ১৯৭১ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের মা-বোনদের উপর। সবচেয়ে বেশি শুনতাম যে মানুষটির কথা, যার কথা বলতে বলতে আমার মরহুম বাবা তাঁর অশ্রু সংবরণ করতে পারতেন না, তিনি হচ্ছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা প্রায়ই বলতেন বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তির নাম নয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি চেতনা, একটি অনুপ্রেরণা ও একটি আদর্শ। যে আদর্শ, অনুপ্রেরণা এতটাই আকর্ষণীয় ও সম্মোহনী ছিল যে শুধু বাবা কেন, পুরো বাঙালি জাতি রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিল যেকোনো সময় এবং ১৯৭১ সালে দিয়েও প্রমাণ করেছে। বাবা বলতেন পৃথিবীতে এমন মানুষ আর আসবে না, যার ডাকে মানুষ রক্ত দিতে পারে। এমন মানুষ আর কোনোদিন আমরা খুঁজে পাব না যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন পৃথিবীতে একটি জাতিকে নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে সারা জীবনের তরে মুক্তির জন্য। বাবা বলতেন অনেকে স্বপ্ন, দেশ সৃষ্টির স্বপ্ন দেখা শুধু বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতৃত্ব ছাড়া আর অন্য কারও পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আজ বাবা নেই, বাবার কথা আজও বার বার মনে পড়ে। ঠিকইতো বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তি দাতা। আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গের পবিত্র স্মৃতি জড়িত। তাই বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কল্পনা না করে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে স্বীকার না করে, বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে ম্লান করে সবকিছুর অস্তিত্ব একটি অসাড়, অস্থির, হীন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই। তিনি পুরো জাতির সম্পদ।
তিনি বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একটি উজ্জ্বল আদর্শ। তিনিই একটি মৃতপ্রায় ঘুমন্ত জাতিকে তিল তিল করে রক্ত দিয়ে প্রাণের স্পন্দন এনে দিয়েছিলেন এবং যার অকল্পনীয় ত্যাগ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিচক্ষণতা, সাহস, বলিষ্ঠতা, দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার ফলেই বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায় তিনি অত্যাচারী পাকিস্তানীদের বুঝাতে চেয়েছিলেন বাঙালি কখনই পরাধীনতার শৃংখলকে অবনত চিত্তে মেনে নিবে না। বাঙালি জাতি মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হাসিমুখে শত নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছেন এই বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেই উন্নত, গণতান্ত্রিক অসম্প্রদায়িক, কারো কাছে মাথা নত না করার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এই সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেই আজ দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শই বলে দেয় কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে হয়, কীভাবে নিজের ভাষাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হয়, কীভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিতে হয়। আমার বাবা এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে আমার সামনে তুলে ধরতেন আর কান্না চোখে দীর্ঘশ্বাসে বার বার একটি কথাই বলতেন- ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই’।
লেখক : একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
পুলিশ সুপার, ট্যুরিস্ট পুলিশ, চট্টগ্রাম রিজিয়ন।