মিলন সব্যসাচী
মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের জীবনে গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। দিন আর দিবস দুটি শব্দ এক অর্থ বহন করলেও এই দুটি শব্দের তাৎপর্য এক নয়। দিন সাধারণ যে কোনোদিনকে বোঝায়, আর দিবস বলতে আমরা কোন সাধারণ দিনকে বুঝি না। একটি ঘটনার কিংবা এর তাৎপর্য মানব জীবনে কি শিক্ষা বহন করে তা উপলব্দি করার জন্যেই আমরা ওই দিনটিকে স্মরণে রাখি। আর এই বিশেষ দিনটিকে আমরা অন্য সাধারণ দিন থেকে আলাদা করার জন্যেই দিবস হিসেবে উল্লেখ করে থাকি। যে কোনো দিবসই মানুষের একাকিত্বকে ভেঙ্গে একটা মহামিলনের উৎসবে পরিণত করে। সবাই মিলে সেই স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দ বেদনায় একাকার হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মে দিবসটা একটু ভিন্ন। কারণ মে দিবস পালিত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণিকে কেন্দ্র করে। তাই এ দিবস নিয়ে শ্রমিকদের অনেক আনন্দ বেদনা উৎসাহ উদ্দীপনা রয়েছে। তবে মালিক পক্ষ এ নিয়ে তেমন মাতামাতি করেন না। তা ছাড়াও এ দিনে শ্রমিকদের আনন্দ করার মতো কিছুই নেই। তাদের সেই পুরানো স্মৃতির সাগরে সাঁতরিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের কথা নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়। ১ মে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এ দিবসটিকে ঘিরেই শ্রমজীবী মানুষরা তাদের অধিকার ও মর্যাদার লড়াইয়ে সোচ্চার হন। শ্রমজীবী মানুষরা তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। ঘর্মাক্ত ও মেহনতি মানুষরা শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ে এভাবেই সংগ্রাম করেছেন। তাদের সেই রক্ত, সেই সংগ্রাম, সেই আধিকার প্রতিষ্ঠার আনন্দোলনের স্মৃতি বহন করছে মহান মে দিবস।
বিশ্ব জুড়ে যখন থেকে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে তখন থেকেই পুঁজিবাদ প্রথা চালু হয়। এ সময় থেকেই শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার জুলুম নির্যাতণ শোষণ শুরু হয়। এ সময় কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় সীমা ছিল না। আট ঘন্টার জায়গায় দশ, বারো, চৌদ্দ ষোল ঘন্টাও কাজ করতে হতো। অতিরিক্ত কাজের জন্যে কোন মজুরি প্রদান করা হতো না। মালিক শ্রেণির শোষণের যাতাকলে নিষ্পেষিত হতে লাগল শ্রমিক সমাজ। সেই অসহনীয় যন্ত্রণার ক্ষোভ দিনে দিনে পুঞ্জিভুত হতে লাগল শ্রমিক সমাজের ভেতর। সেই পুঞ্জিভুত ক্ষোভ ১৮৮৬ সালের ১ মে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে বহি:প্রকাশ ঘটল। শ্রমিক সমাজ এই অন্যায়ের প্রতিবাদে ও তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমে পড়ল। আট ঘন্টা কর্মদিবস পালনের দাবিতে তারা সাধারণ ধর্মঘট পালন করতে লাগল। ১৮৮৬ সালের এই শ্রমিক বিক্ষেভের ৩৮ বছর আগে ১৮৪৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক সমাজ তাদের আধিকার আদায়ের জন্য একত্রিত হযেছিল। তারা স্লোগান তুলেছিল দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো। পরবর্তীতে এই স্লোগান এশিয়া ইউরোপ আমেরিকা আফ্রিকা মহাদেশের সকল দেশেই শ্রমিকদের মাঝে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল। সেই নতুন প্রাণ নিয়েই শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে মাঠে নেমেছিল। শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের এ দাবি মালিক পক্ষ না মেনে উল্টো তাদেরকে শাসিয়ে এই যৌক্তিক আন্দোলনকে স্তিমিত করার আপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনড়। ১৮৬৪ সালের ৪ ঠা মে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। শিকাগোর হে মার্কেটের এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা তাদের চলমান আনন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এসময় বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকরা এসে মিছিলে যোগ দেয়। মিছিলে অংশ নেয়া শ্রমিকদের প্রাণের দাবিগুলো স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলল। হে মার্কেটের সামনে বিশাল সমাবেশ আনুষ্ঠিত হলো। সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পীজ। তিনি তার বক্তব্যে শ্রমিকদের প্রাণের দাবিগুলোর স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরছিলেন। এ সময় পুলিশ বাহিনী সমাবেশকে ঘিরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। হঠাৎ পুলিশের সামনে একটা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলে একজন পুলিশ সদস্য মারা যান। শ্রমিকদের নিক্ষিপ্ত বোমা বিস্ফোরণে এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু খবর পুলিশের উপরস্থ অফিসারদের কানে গেলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে শ্রমিকদের ওপর অ্যাকশনে যেতে পুলিশদের নির্দেশ দেন। পুলিশ বাহিনী হিংসাত্মকভাবে নির্বিচারে শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় হে মার্কেটের সামনে ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়। মালিক পক্ষ নিজেদের পিঠ বাঁচাতে পুলিশের পক্ষ নেয়। শ্রমিকদের দাবি দাওয়া না মেনে ১১ শ্রমিকের মৃত্যু ভিন্নদিকে প্রভাবিত করার জন্যই শ্রমিকনেতা আগস্ট স্পীজসহ মোট আট জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মালিক শ্রেণি অর্থের প্রভাব খাটিয়ে সরকারের ওপর মহলকে প্রভাবিত করে অভিযুক্তদের প্রহসনমূলক বিচারের সম্মুখীন করে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর আটজনের মধ্যে ছয়জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করে। লুইস লিং নামের এক শ্রমিক ফাসি কার্যকর হওয়ার আগের রাতে কারাগারের ভেতর আত্মহত্যা করেন। আরেকজন শ্রমিককে পনের বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়। ফাসি কার্যকর হবার আগে ফাঁসির মঞ্চে শেষ বারের মতো শোষিত শ্রমিকদের নেতা আগস্ট স্পীজ অকুন্ঠচিত্তে দুনিয়ার সব শ্রমিকদের উদ্দেশে একটি বাণী উচ্চারণ করলেন। তিনি বললেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা তোমাদের আওয়াজ আপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে।”
পরে এই নিষ্ঠুর আবিচার শ্রমিক হত্যা ও শ্রমিকদের ফাঁসি সবটাই ছিল মালিক পক্ষ ও পুলিশের একান্ত কারসাজি তা প্রকাশ পেয়ে যায়। ইলিনয়ের গভর্ণর ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন এক বিবৃতিতে বলেন ১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে হে মার্কেটের সামনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের যে অ্যাকশন হয়েছিলো তার ঘোষণা দেন সে সময়ের পুলিশ কমান্ডার। তিনি আরো বলেন পুলিশের ওপর যে বোমাটি ছোড়া হয় সেটি কোন শ্রমিক ছোড়েনি। এই লোকটার পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি ছিলেন অজ্ঞাত। সে সময়ের সংবাদপত্রগুলো এভাবেই রিপোর্ট করেছিল যে পুলিশের ওপর বোমা ছোড়ে কোন এক অজ্ঞাত ব্যক্তি। এ সময় পুলিশ অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করেছিল। আর শ্রমিকদের দিকে সমস্ত বুলেট আসছে পুলিশের দিক থেকে।
এরপর এ বিচার সবার কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। যে ছয় শ্রমিকের ফাঁসি হয়েছিলো প্রহসনের বিচার। যা পৃথিবীর সব মানুষকেই ব্যাথিত করেছে। এর পর মালিক পক্ষ অনেকটা নমনীয় হয়। শ্রমিকদের আট ঘন্টা কাজ ও ন্যায্য মজুরি প্রদান করেন। এভাবে শুরু হতে থাকে শ্রমিকদের মর্যাদা ও আধিকার প্রতিষ্ঠা। তবে আজও যে শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে না এমন নয়। আজও শ্রমিকদের আন্দোলন থেমে নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আজও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শ্রমিকরা এখনো তাদের শ্রমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোই নয়। পৃথিবীর সবদেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় মে দিবস। তবে তৃতীয় বিশ্ব ছাড়াও অনেক দেশেই এখনো মে দিবসের সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্যতিক্রম বলা যায়। বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। মে দিবসের তাৎপর্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সরকার।
বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৮০ ভাগের বেশি শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছেন। এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অসংগঠিত শ্রমিকদের দিয়ে নামমাত্র মজুরিতে একসময় কাজ করানো হতো। এমনকি তাদের নিয়োগপত্রও দেওয়া হত না। ছুটির বিধান ছিল না, নিয়ম অনুযায়ী ওভারটাইম দেওয়া হত না। নারী-পুরুষ সমমজুরি দেওয়া হত না। পথে-ঘাটে-বাসায় নারী শ্রমিকেরা নির্যাতনের শিকার হতেন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদেও পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। ছিল না শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা। পোশাক কারখানা, চাতালসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন শ্রমিকদের আইনগত বাধা না থাকলেও, ছলে-বলে কৌশলে শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা হয়েছিল। মালিকদের খামখেয়ালিপনায় শ্রমিকদের ইচ্ছে মতো ছাঁটাই-নির্যাতন করা হত। এসবের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা আন্দোলন করত। রাজপথে নামত। শ্রমিকদের ভিতরে একটা অস্থিরতা কাজ করত। বর্তমান সরকার শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে নতুন করে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেন। ১৯৬৯ সালে শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার ১২৫ টাকা ন্যূনতম মূল মজুরি ঘোষণা করে। তারপর আর শ্রমিকদের মজুরি সে তুলনায় বাড়েনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে ঘোষণা করেছেন মজুরি কাঠামো। ন্যূনতম মূল মজুরি ৩০০০, ভাতাসহ ৫৩০০ টাকা। বাংলাদেশের শ্রমিকদের আইনগত অধিকারগুলো এখন অনেকটাই বাস্তবায়িত হচ্ছে। শ্রম আইনে রয়েছে।
১) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ১০৯ ধারা অনুযায়ী, নারী শ্রমিককে তার বিনা অনুমতিতে কোন প্রতিষ্ঠানে রাত ১০ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কাজ করতে দেয়া যাবে না। তবে শ্রমিকের সম্মতি থাকলে কোন বাধা নেই। সম্মতি ছাড়া নারী শ্রমিকদের রাত ১০ টার পর কাজ করানো সম্পূর্ণ বেআইনি।
২) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ৯৪ ধারা অনুযায়ী, ৪০ বা তার চেয়ে বেশি নারী শ্রমিক নিযুক্ত আছেন, এমন যেকোন প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকদের অনধিক ৬ বছর বয়সী সন্তানদের জন্য এক বা একাধিক শিশুকক্ষের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে যাতে প্রয়োজনে নারী শ্রমিক তার সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে পারেন এবং তার শিশু যাতে মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত না হয়। ৩) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী, অন্তঃসত্ত্বা শ্রমিকের সন্তান প্রসবের আগে ৮ সপ্তাহ এবং প্রসবের পরে ৮ সপ্তাহ, মোট ১৬ সপ্তাহ পূর্ণ মজুরিতে ছুটি পাবার অধিকার রাখেন। মালিক এই ছুটি দিতে বাধ্য। ৪)বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ২৮৬(১) ধারা অনুযায়ী, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা সংক্রান্ত বিধান লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি বা মালিক ৫০০০ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এই ধরণের অর্থদন্ড আরোপ করা হলে আদালত রায় প্রদানকালে আদায়কৃত দন্ডের অর্থ সম্পূর্ণ বা আংশিক সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেয়ার আদেশ দিতে পারেন।
৫) কোন কারখানায় ৬ মাস যাবত কাজ করেছেন এমন নারী শ্রমিক প্রসূতিকালীন সুবিধা পাবার অধিকার রাখেন। তবে কোন নারী শ্রমিক প্রসূতি কল্যান সুবিধা পাবেন না যদি তার সন্তান প্রসবের সময় ২ বা ততোধিক সন্তান জীবিত থাকে। তবে এক্ষেত্রে তিনি অন্য কোন ছুটি পাবারঅধিকারী হলে তা অবশ্যই পাবেন।
৬) সন্তান প্রসবকালে শ্রমিক মৃত্যুবরণ করলে এবং সন্তান জীবিত থাকলে সেক্ষেত্রে মালিক সন্তান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রসূতিকালীন সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবে। ৭) সন্তান প্রসবের ৮ সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের পরবর্তী ৮ সপ্তাহ যথেষ্ট কারন না থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শ্রমিকের চাকুরী অবসান করতে পারবেন না।
৮) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ৯১(১) (খ) ধারা অনুযায়ী, কারখানায় নারী শ্রমিকদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং তা যথাযথভাবে পর্দাঘেরা থাকতে হবে। ৯) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ৯৩(৩) ধারা অনুযায়ী, কোন প্রতিষ্ঠানে ২৫ জনের অধিক নারী শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে তাদের জন্য পৃথক বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২৫ জনের কম হলে পৃথক পর্দাঘেরা জায়গার ব্যবস্থা থাকবে। ১০) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ৩৩২ ধারা অনুযায়ী, মহিলাদের প্রতি আচরণের ব্যাপারে বলা হয়েছে, “কোন প্রতিষ্ঠানে কোন কাজে মহিলা নিযুক্ত থাকলে তিনি যে পদমর্যাদার অধিকারী হোন না কেন, তার প্রতি উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ এমন কোন আচরন করতে পারবেন না যা অশ্লীল কিংবা অভদ্রজনোচিত বলে গণ্য হবে কিংবা যা উক্ত মহিলার শালীনতা বা সম্ভ্রমের পরিপন্থী। ১১) বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ – এর ৩৪৫ ধারা অনুযায়ী, সমকাজে সম মজুরী প্রদানের কথা বলা হয়েছে। উক্ত ধারা অনুযায়ী, কোন শ্রমিকের জন্য কোন মজুরি নির্ধারণ বা নূন্যতম মজুরির হার স্থিতিকরনের ক্ষেত্রে, একই প্রকৃতির বা একই মান বা মূল্যের কাজের জন্য নারী এবং পুরুষ শ্রমিকদের জন্য সমান মজুরি নীতি অনুসরন করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে নারী পুরুষে কোন ভেদাভেদ করা যাবে না। শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করায় কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। নিয়োগপত্র দেয়া হচ্ছে। অফিসের আইডিকার্ড দেয়া হচ্ছে। শ্রমিক নির্যাতন, বেতন ভাতার অনিয়ম দূর হয়েছে। তাই এখন আর তেমন একটা শ্রমিক আন্দোলন কিংবা অসন্তোষ চোখে পড়ছে না। শ্রমিকরা রাজপথে নেমে নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করছে। এমন চিত্র কমই দেখা যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার শ্রমজীবী নারীর জন্য ২৪ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি অনুমোদন করেছে এবং অন্যান্য আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এই ছুটি অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ দিয়েছেন। যা প্রশংসার দাবি রাখে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে একসময় শ্রমিকরা প্রোটিন এবং আমিষ জাতীয় খাদ্য সঠিক পরিমান খেতে পারত না। শতকরা ৮৭ ভাগ শাক-সবজি, শতকরা ৯০ ভাগ ঝাল, শতকরা ৮৮ ভাগ স্নেহ বা চর্বি জাতীয় খাবার, প্রোটিন জাতীয় খাবার ডিম শতকরা ৩১ ভাগ, দুধ শতকরা ৫ ভাগ, মাংস শতকরা ৪ ভাগ, ফল শতকরা ৫ থেকে ৯ ভাগ এবং মিষ্টি শতকরা ১৭ ভাগ খেতেন। এর ফলে পুষ্টিগত বিচারে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এর অনিবার্য প্রভাব পড়ত পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। এখন শ্রমিকরা পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে। এ সমস্যা না থাকায় দিন দিন শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। নারী আজ শুধু শিক্ষা নয়, সমাজের প্রতিটি কাজে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই দেশের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সমান অংশগ্রহণ থাকা উচিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে এখন পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি কাজ করছে। এক সময় নারী পুরুষের বেতন বৈষম্যের কথা থাকলেও এখন আর সে তুলনায় তারা বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন না। গার্মেন্ট শিল্প থেকে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এখানে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৮০ ভাগের বেশি। এছাড়া আবাসন ক্ষেত্রে এবং গ্রামীণ কৃষি কাজে নারীর রয়েছে সক্রিয় অংশগ্রহণ। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের নারীরা এখন রাজনীতি, শিক্ষা, আইন, ব্যাংকিং, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, বিমান চালনা, ট্রেন চালনা, কর্পোরেট, সাহিত্য রচনা-সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র-নাটক নির্মাণ,শিল্পকলাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে দেশকে একটি গতিশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করছে। যেটা আমাদের মতো উন্নয়শীল দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
বাংলাদেশ সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমতার মাধ্যমে সবাই এক সঙ্গে কাজ না করলে দেশের এ অগ্রগতি বাঁধাগ্রস্ত হত।এদেশে নারী রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করছে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা দু’জনই নারী। বিশ্বের অন্য কোন দেশে এমনটি দেখা যায় না। প্রথম বারের মতো বাংলাদেশে নারী স্পীকার পদে আসশীন হয়ে সংসদ কার্য পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশের নারী আনসার, পুলিশসহ বর্তমানে সেনাবাহিনীতেও দক্ষতার সঙ্গে অংশ নিচ্ছে। নারী বৈমানিকরা আকাশে উড়ছে অনবরত। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের দুজন তরুণী এভারেস্টস জয় করতে সক্ষম হয়েছে। এটা বাংলাদেশের নারীর একটি বড় অর্জন। আর এসব হচ্ছে সরকারের আন্তরিকতা ও কর্ম পরিবেশ সৃষ্টির কারণে। বর্তমান সরকারের নারী মন্ত্রীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র জয়ের অর্জন এসেছে সাবেক নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে। আর কৃষি সাফল্যও একজন নারী
নেতৃত্বের অসাধারণ অর্জন। বাংলাদেশের অনেক ইতিবাচক উন্নয়নের মধ্যে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী শ্রমিক বৃদ্ধি অন্যতম।
তবে পোশাকশিল্পে নারী তার জায়গাটি করে নিয়েছেন। এই শিল্পে শ্রমিক হিসেবে নারীর অভিগম্যতার ফলে তারা আজ কথা বলতে পারছেন, নিজের জন্য কিছু অর্থ ব্যয় করতে পারছেন। নারীরা আজ দলবেঁধে রাস্তায় হেঁটে তাদের কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এটা নারী সমাজের জন্য এক বিশাল অর্জন। এগুলো সবই নারীর অবস্থানের ইতিবাচক দিক। শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে ইসলাম ধর্মে যে বিধান রয়েছে সেখানে মহানবী হযরত মুহম্মদ স: বলেছেন শ্রমিকের ঘাম মুছে যাওয়ার আগেই তার পারিশ্রমিক প্রদান কর। মহানবী সমাজে শ্রমিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কেন না ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে অর্থাৎ জাহেলি যুগে শ্রমিকদেরকে মনিবরা চাকর হিসেবেই দেখতো। তাদেরকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিত না। মর্যাদা দূরে থাক জুলুম অত্যাচার আর নির্যাতনের শেষ ছিল না। ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মহানবী শ্রমিক ও অন্য সব মানুষের মাঝে সমতা ফিরিয়ে আনেন। তখন থেকেই মানুষের মাঝে বৈষম্য কমে আসে। এর পর থেকেই সমাজে শ্রমিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ন্যায্য মজুরি প্রদানের তালবাহানা মালিক পক্ষের বন্ধ হয়নি। এসব বন্ধ করতেই মহানবী বললেন, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি প্রদান কর। রাসুলের যুগে শ্রমিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেও সময়ের বিবর্তনে পুঁজিবাদীদের আগ্রাসনে আবার শ্রমিকরা শোষণের যাতাকলে নিষ্পেষিত হতে লাগল। তাই শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার আদায় ও মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে আন্দোলন করে রক্ত দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছে। বিশ্বব্যাপী সেই ইতিহাস স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। মে দিবসের মাধ্যমে। মে দিবসে বাংলাদেশের শ্রমিকরাও রাজপথে নেমে আসে। তাদের অধিকারের দাবিতে স্লোগান দেয়। তবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে জনসংখ্যার আধিক্য থাকার কারণে এখানে শ্রমিকও বেশি। তাই কিছু না কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। তবে বর্তমান সরকার শ্রমিক বান্ধব সরকার। শ্রমিকের যে কোন অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার সোচ্চার। যার ফলে বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য দেয়া হচ্ছে। তারা শ্রমিকদের জিম্মি করে ইচ্ছা মতো বেতন-ভাতা দিতে পারছেন না। নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় শ্রম খাটিয়ে রাখতে পারছেন না। একসময় এই সুযোগটা গার্মেন্ট সেক্টরে বেশি ছিল। এখন আর সেরকম নেই। অতিরিক্ত কাজের জন্য তাদের আলাদা মজুরি প্রদান করতে হচ্ছে। গার্মেন্ট বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম একটা মাধ্যম। আর এ অর্জনের ক্ষেত্রে অনেকটাই নির্ভর করে শ্রমিকদের ওপর। তাই শ্রমিকদের পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তবে বেতন-ভাতার জন্য মাস শেষে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হচ্ছে না। আন্দোলন করতে নেমে রাজপথে পুলিশের গুলিতে প্রাণও দিতে হচ্ছে না। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের চিত্র ছিল অন্যরকম। আজ সেটা কল্পনাও করা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদ ও তরুণ প্রজন্ম যদি গার্মেন্ট সেক্টরে সম্পৃক্ত থাকেন, তবে গার্মেন্ট শিল্পের উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশে নারী শ্রমিকদের মজুরি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে এগিয়ে নিতে হবে। নারী পোশাক শ্রমিকদের অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যসব ক্ষেত্রে সরকার সহায়তা দিচ্ছে। এমনকি বিজিএমইএ গার্মেন্টে শিশু-শ্রমিক নেয়া নিষিদ্ধ করেছে। যে গার্মেন্টে শিশু শ্রমিক পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পোশাককর্মীর সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে বিজিএমইএ পাঁচটি স্কুল খুলেছে। ব্যবস্থা করেছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের। পোশাক শিল্পের ফলে নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে তাদের কথা বলা এবং নিজে সিদ্ধান্ত নেয়ার মত জায়গা তৈরি হয়েছে। পোশাক শিল্পের কারণে নারীরা উপার্জন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। অবদান রাখছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে। এমনকি বিশ্ব অর্থনীতিতেও তাদের অবদান রয়েছে।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক
ও বঙ্গবন্ধু গবেষক।
0 Comments