ড. সৌমিত্র শেখর
যে দিন বাংলা বানান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না, সে দিন ‘মৃতভাষা’য় পরিণত হবে বাংলা। তবে এটাও ঠিক, এ প্রশ্ন যতোটা কমিয়ে আনা যায় ততোই মঙ্গল। অনেকে বলেন, বাংলার চেয়ে ‘নচ্ছার’ ভাষা আর নেই। কারণ এর বানান খুবই ‘কঠিন’। এর চেয়ে অনেক সহজ ইংরেজি বা অন্য ভাষা। কথাটা প্রথম প্রথম ঠিকই মনে হয়। কারণ বাংলা ভাষার সমস্যার ক্ষেত্রটা মোটামোটি আমাদের জানা। জ/য; ন/ণ; শ/স/ষ; ত/ৎ; ি / ী; ু / ূ ; যুক্তব্যঞ্জনের অস্বচ্ছ রূপ এবং মুদ্রণ-সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীরা, প্রতিদিন। কিন্তু সত্য তো এটাও, এ সব নিয়েই বাংলা আজ আটাশ কোটি মানুষের ভাষা হয়ে উঠেছে! ‘কঠিন’ বলে বাংলাকে যে আমরা মিছেই গালমন্দ করি, এর নানা ধরনের বানান নিয়ে বাংলার ‘গোষ্ঠী উদ্ধার’-এ আমরা প্রায়ই যে মেতে উঠি- এটা কতটুকু ঠিক? ‘Put ’ যদি ‘পুট’ উচ্চারিত হয় তবে ‘But ’ কেন ‘বুট’ হবে না- এই কৌতুকপূর্ণ জিজ্ঞাসাটা পুরোনো। উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বানানের ক্ষেত্রেও কি প্রশ্ন নেই? ‘Tongue’ বানানে ‘ue’ বলতে হয় কেন? ‘Knee’ লেখার সময় ‘ee’-এর বদলে ‘i’ লিখলে ক্ষতি কী? ইংরেজি শেখার সময় বাঙালির এ সব মনে থাকে না। মুখস্থ করেই ইংরেজিতে বিদ্বান হতে চায় সে। বাংলা শিখতে গেলেই বানান নিয়ে নানা প্রশ্ন! আসলে কোটি কোটি মানুষের যে ভাষা, তা বাংলা হোক, হোক ইংরেজি বা অন্য কোনো কোটি মানুষের মনোভাব ধারণ করতে হলে, সেখানে অযুত শব্দমালার আগমন হবেই; আর এর কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নতা সৃষ্টি হতে পারে বানানে। মানুষের উচ্চারণ-প্রবণতাও বানান বদলে দেয় বানান বদলের পেছনে এটাও বড় কারণ। বাংলা বানানে যে সমস্যার কথা বলা হয়, সে কারণে তা সঙ্গত-সমস্যা। তবে সুখের বিষয়, বাংলা বানানের নিয়ম আছে, যা অন্য অনেক ভাষাতেই নেই। এই সুখ ও আনন্দের কথা অনেক বাঙালি জানেন না, যারা জানেন তারা এ নিয়ে গর্ব করতে কৃপণ!
বাংলা যখন পরিণত ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তার বেশ পরে অর্থাৎ উনিশ শতকের গোড়া থেকে বাংলা গদ্যে তদ্ভব, দেশি, বিদেশি শব্দের আধিক্য দেখা যায়। এর একটি কারণ ভারতীয় তথা বঙ্গীয় অঞ্চলে বিদেশি ও তাদের ভাষার আগমন। বিশ শতকে গদ্যে চলিতরীতি প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। এর নেতৃত্বে থাকেন প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। কিন্তু ভাবনাটা এর আগেই অনেক দূরে নিয়ে আসেন প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহ। তবে বাংলা ভাষায় একটি বানানরীতি থাকা প্রয়োজন, তা না হলে বাংলা বানানের সূত্র-ছিন্ন হতে পারে এই প্রয়োজন ও আশঙ্কা প্রকাশ প্রথম করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ব্যক্তিগত অভিপ্রায় অনুসারে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ একটি প্রাথমিক বানানরীতি তৈরি করলে রবীন্দ্রনাথ তা কিছুটা সংশোধন সাপেক্ষে অনুমোদন করেন।
রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ করেই বাঙালি বিদ্বৎসমাজে বাংলা বানান রীতি প্রবর্তন করেননি। তিনি এই রীতি প্রথম পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেন বিশ্বভারতীতে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বানান রীতির সামান্য পরিবর্তন করে প্রবাসী পত্রিকায় (অগ্রহায়ণ ১৩৩২; নবেম্বর-ডিসেম্বর ১৯২৬) তা প্রথম ছাপা হয়। এর পর বাংলা বানান নিয়ে সুধীমহলে ব্যাপক আলোচনা আরম্ভ হয় এবং অধিকাংশ বিদ্বান একে সমর্থন করেন। রবীন্দ্রনাথ তখন এই বানান রীতির স্বত্ব আর নিজের কাছে রাখলেন না। অনুরোধ ও প্রস্তাবসহ তুলে দিলেন তৎকালীন ভারতের বৃহৎ বিদ্যায়তন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। সেসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ ও প্রস্তাবের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা গ্রহণ করে প্রচারের ব্যবস্থা নিলেন। ঐ সময়ে খ্যাতির চরমে থাকা কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এটা সমর্থন করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৫ সালে ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার সমিতি’ গঠন করে। এটাই বাংলা বানান-সংস্কারে গঠিত প্রথম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। এই সমিতি ১৯৩৬ সালের ৮ই মে প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রকাশ করে। সেই থেকে সূচনা।
এর কিছু কাল পর ভারতভাগের কারণে সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাংলাকে নিয়ে নানা ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ আরম্ভ করে পাকিস্তানি শাসক ও তাদের অনুসারী কিছু তোশামোদকারী বাঙালিজন। বলা হয়, এই বাংলা হিন্দুদের ভাষা। বাংলাকে ‘পাকিস্তানের মানুষের প্রতিভা ও কৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ’ করতে হবে। সে কারণে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ সরকার মৌলানা আকরম খাঁ-র নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে ‘ইস্ট বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ কমিটি’ গঠন করে। ব্যক্তিগত জীবনে চরম সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আকরম খাঁ এবং তাঁর এই কমিটি বেশ কিছু বানান সংস্কার, বাংলার প্রচলিত বর্ণমালার পরিবর্তে আরবি বা রোমান বর্ণমালা ব্যবহার ইত্যাদির প্রস্তাব করে। আসলে এই কমিটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত। বাংলা ভাষা এবং বাংলা বানান নিয়ে চিন্তা করা তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। এর পর সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে ১৯৬৩ সালে পুনরায় বানান-সংস্কার কমিটি গৃহীত হয়। এই কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঙ, ঃ, ঈ, ী বাদ দেবার সুপারিশ করে। কিন্তু কী বা কোন কারণে এগুলো বাদ দেয়া হবে তা তাঁরা সুস্পষ্টভাবে দেখাতে ব্যর্থ হন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পর্ষদ ১৯৬৭ সালের ২৮শে মার্চ ভাষা ও বর্ণ সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করে এবং সেই কমিটির সদস্য ছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী সহ সাত জন। এই কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে : বাংলা বর্ণমালা থেকে ঈ, ঊ, ঐ, ঔ, ঙ, ঞ, ণ, ষ, ী, ূ , ৈ , ে ৗ ইত্যাদি বর্জন করতে হবে; যুক্তবর্ণ তুলে দিতে হবে; ,ে ি ব্যঞ্জনের ডান দিকে বসাতে হবে ইত্যাদি। এই প্রস্তাব ছিল খোলনলচে পাল্টে দেবার মতো।
এই প্রস্তাব একবারে গ্রহণ করলে বাংলার লেখনরূপের যে পরিবর্তন দৃশ্যগোচর হতো তাতে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাইকে যেন আবার বাংলা শিখতে হতো! তাই সর্বমহল থেকে এই প্রস্তাবের দারুণ বিরোধিতা হয়। কমিটির তিন সদস্য মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী তাঁদের পূর্ব অবস্থান থেকে সরে এসে ১৯৬৮ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি যৌথ বিবৃতিতে বলেন : ‘আমরা মনে করি যে, বাংলা লিপি ও বানান সরলায়ন ও সংস্কারের কোন আশু প্রয়োজন নাই।’ আসলে তাঁদের মূল প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময় ও স্তর নির্দিষ্ট ছিল না বলেই সমস্যা ব্যাপকতর হয়।
বাংলাদেশেও বাংলা বানান সংস্কারের একাধিক কমিটি হয়েছে। ১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে বাংলা বানানে সমতা সাধনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর হয়নি। ১৯৭৬, ১৯৮৪, ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সট বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন, এনসিটিবি-র উদ্যোগে কুমিল্লা বার্ডে অনুষ্ঠিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার আলোকে সেমিনারে বাংলা বানান নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও সুপারিশ প্রণীত হয়। তাঁদের এই কার্যক্রমের সুপারিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচার বা প্রকাশ করা হয়নি। সেই ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ সংক্রান্ত সুপারিশ প্রবর্তন করে। ১৯৯৪ সালে তা সংশোধিত আকারে প্রকাশ করা হয়। ২০০৫ সালে এপ্রিল মাসে এনসিটিবি বাংলা বানানরীতি সমতাবিধান কমিটি গঠন করে। অবশ্য তারা পাঠ্য বইয়ের বানানগুলোর প্রতিই বিশেষ লক্ষ রাখে। এই কমিটির বানানের সঙ্গে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত বানান সুপারিশের দু-এক ক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। এমন কেউ কেউ আছেন যাঁদের নাম দুই কমিটিতেই দেখা যায়। একই ব্যক্তি দুই কমিটিতে অথচ বানানের ক্ষেত্রে ভিন্ন সুপারিশ সত্যি বিষয়টি বোধগম্য নয়। ২০১৬ সালে সংস্কারকৃত বানানরীতি অনুসারে বাংলা একাডেমি ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ নামে একটি অভিধান বাজারে প্রকাশ করে, যেখানে শুদ্ধ বানান হিসেবে লেখা হয় : গোরু, ছোটো, বড়ো ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের চিরচেনা গরু, ছোট, বড় বানান আর চলবে না। এসব নিয়ে অবশ্য ব্যাপক বিতর্কও হয়।
বাংলা বানান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চিন্তা করেছিলেন, দুঃখের বিষয়, তা এখন আর অব্যাহত নেই। সে চিন্তা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ার কারণে বাংলা বানান সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়নি। যদি সম্ভব হতো তা হলে বাংলা ভাষা নিয়ে সাধারণের এতো প্রশ্ন থাকত না। মুক্তিযুদ্ধের পর পঞ্চাশ বছর অতিক্রমকালে আমরা বিশ্বাস করি, সবরকমের সমস্যা অতিক্রম করে আমরা একটি সুন্দর বানানবিধি তৈরি করতে পারবো এবং সে অনুসারেই দেশের সবধরনের বাংলা লেখা ও পড়া এগিয়ে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
0 Comments