শোয়েব আহাম্মদ পিপিএম
যে দিন বাবাকে হারালাম সেদিন মনে হল পৃথিবীর সব কিছুই হারিয়ে ফেলেছি। যা’ আর ফিরে আসবেনা। এক বিশাল শুন্যতা কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো আমাকে। যার বাবা নাই সেই বুঝে বাবা কি জিনিস, অথচ এ দেশে এমন হতভাগা সন্তানও আছে, যারা তাদের বাবাকে ভাবে অভাজন। পিতার বুক ফাটা আর্তনাদ না শোনার মত সন্তানও এ সমাজে আছে। নিজের জন্মদাতা পিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে নিজ সংসারে সুখ খোঁজে অনেক সন্তান। হায়রে হতভাগা!
বছরে একদিন ঘটা করে বাবার কথা স্মরণ করে “হ্যাপী ফাদারস ডে” পালন করে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বাবা দিবস ঘটা করেই পালিত হচ্ছে। কেউ কেউ বলে থাকেন বাবা দিবসটা ঠিক আমাদের জন্য নয়। এটি মূলতঃ পাশ্চাত্যের। নথি পত্র ঘেঁটে যতদূর জানা যায়, বাবা দিবসের তথ্যটি খুব এক টা আনন্দের নয়। বরং এর পিছনে রয়েছে সংগ্রামের একটি গল্প। একশ বছরের বেশী সময় ধরে বিশ্বে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসার গল্পটা বেদনার ই বলা যায়।
মা দিবস প্রথম পালিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে। সে তুলনায় বাবা দিবসের বয়স কমই বলা যায়। আমেরিকাতে মা দিবসকে জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে পালন করা শুরু হয় সেই ১৯১৪ সাল থেকে। মা দিবস যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে, বাবা দিবসের এ ক্ষেত্রে একটু সময়ই লেগেছে বলা চলে।
১৯০৮ সাল। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার এক গির্জায় একটি স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে। এর আগের বছরই একটি কয়লার খনিতে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলো ৩৬২ জন কয়লা শ্রমিক। তাদেরকে সম্মান জানাতে সন্তানরা মিলে এই প্রার্থনা সভার আয়োজন করে। এটিই ছিল বাবাকে সন্মান জানাতে ইতিহাসের প্রথম আয়োজন। ইতিহাস এমনটাই বলছে। যদিও বাবা দিবসের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। তবে ঠিক এর পরের বছর ১৯০৯ সনে সনোরা স্মার্ট ডড নামের এক নারী বাবা দিবসের স্বীকৃতির জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেন। ডড তার বাবা কে অসম্ভব ভাল বাসতেন। মা ছিল না তাদের। তাদের সাত ভাই বোনকে বড় করে তুলেছিলেন তাদের সিঙ্গেল বাবা। বাবার এই ত্যাগ দেখে ডডের মনে হোল মা দিবসের এতো আয়োজন হলে বাবা দিবস কেন বাদ থাকবে? বাবাকে সম্মান জানানোর জন্য একটা বিশেষ দিন থাকা দরকার।
অনেক চেষ্টা চরিত্র করে দীর্ঘ এক বছরের সাধনায় স্থানীয় কমিনিউটিগুলোতে বাবা দিবস পালন করতে সক্ষম হন ডড। ১৯১০ সালের ১৯শে জুন বিশ্বে প্রথম বারের মত পালিত হয় বাবা দিবস। শুরুটা ওয়াশিংটনে হলেও ধীরে ধীরে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আস্তে আস্তে মা দিবসের পাশাপাশি বাবা দিবসের প্রতি সচেতন হতে থাকেন সন্তানেরা। দীর্ঘ ছয় দশক পর মিলে বাবা দিবসের স্বীকৃতি। ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদে বাবা দিবসের ছুটি ঘোষণার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে সেই সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। পরে ১৯৬৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিনডল বি জনসন জুন মাসের ৩য় রবিবারকে বাবা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সসন প্রতি বছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন। তিনি একটি আইনে স্বাক্ষর করে বাবা দিবসকে জাতীয় মর্যাদা দেন। বিশ্বের প্রায় দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করা হয়।
তবে এর মাঝে বেশ কিছু আন্দোলনও হয়ে গেছে মা দিবস ও বাবা দিবসকে এক সাথে করে প্যরেনট ডে পালনের জন্য। তবে বেশিরভাগ মানুষ আলাদা আলাদা দিন পালনেই রত থাকলো। নিন্দুকেরা অবশ্য কেউ কেউ এটিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ধান্দা বলতেও কার্পণ্য করেনি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করা হয়। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাবা দিবস হচ্ছে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার। দক্ষিণ আমেরিকায় এটি পালিত হয় ১৯ শে মার্চ। অস্ট্রেলিয়া ও ফিজিতে পালন করা হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রবিবার। [তথ্য সূত্রঃ নিউজ জি ডেস্ক, জুন ১৬, ২০১৯]
এতো গেলো বাবা দিবসের ইতিহাস। এবার দেখা যাক ইসলাম কি বলে?
একজন বাবার মাধ্যমে সন্তানের জীবনের শুরু। সন্তানের জীবনে বাবার অবদান অনস্বীকার্য। কোন সন্তান তার বাবার ঋণ কখনো পরিশোধ করতে পারে না। কঠোর শাসন, কোমল ভালবাসা আর ত্যাগে অগ্রগামী যিনি, তিনি ই তো বাবা। বাবারা যে কোন ধরনের দুঃখÑ কষ্ট অকাতরে সহ্য করেন। সব সময় চেষ্টা করেন সামান্য কষ্টও যেন সন্তানকে স্পর্শ না করে।
পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা ইরশাদ করেন যে, “তোমাদের রব তায়ালা তিনি আদেশ করেন যে, উনার ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত করোনা এবং পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। উনাদের কে “উহ” শব্দটিও বলোনা এবং উনাদেরকে ধমক দিওনা এবং বলো উনাদেরকে শিষ্টাচার পূর্ণ কথা। উনাদের সামনে মুহাব্বতের সাথে হাত বিছিয়ে দাও এবং বলো; হে আমার রব তায়ালা! উনাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন, যেমন উনারা আমাকে শৈশব কালে লালন পালন করেছেন। “(সুরা বনী ইসরাইলঃ আয়াত ২৩-২৪)।
অন্য আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল যোগ হতে থাকে। ১। সদকায়ে জারিয়া, ২। কল্যানময় শিক্ষা ও ৩। এমন সৎ সন্তান, যে মৃত পিতা মাতার জন্য দোয়া করে। (সহিহ মুসলিম।)
জন্মদাতা পিতাকে আমরা বাবা বা আব্বা বলে ডাকি। সম্বোধন হিসেবে এটা নতুন নয়। পিতা কিংবা বাবার সমার্থবোধক অনেক শব্দ সমাজে প্রচলিত। তবে অঞ্চল ও ভাষাভেদে এর হেরফের অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইসলাম জন্ম পরিচয়ের সূত্র প্রকাশের সময় আপন পিতা ছাড়া অন্যের দিকে নিজের পরিচয়কে সম্পর্কযুক্ত করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে।
এমনকি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, ভক্তি-শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনসহ অন্য যে কোনো কারণ দেখিয়েই হোক না কেন, জন্মদাতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে ডাকতে বা পরিচয় দিতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামের এই অবস্থান থেকেই বোঝা যায়, বাবার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। এভাবেই ইসলাম পিতৃত্বের পরিচয়কে সুসংহত করে পিতার মর্যাদাকে উচ্চাসনে বসিয়েছে।
মা ও বাবা দিবসের প্রচারণা মূলত এটাই প্রমান করে যে, উক্ত দিবস পালনকারীরা মাতৃপিতৃ ভক্তি ও তাদের প্রতি ভালোবাসার চেতনায় উজ্জীবিত নয়। তারা মা-বাবার ভালবাসার বন্ধনহীনতায় ভুগছে। অশান্তিতে ভুগছে, যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে। তার থেকে উত্তরণ লাভের জন্য তারা তথাকথিত মা বা বাবা দিবসে ক্ষণিকের জন্য মাতৃ ভক্তি বা পিতৃ ভক্তির চেতনায় উজ্জীবিত হবে। অথচ ইসলাম প্রতিটি দিনে প্রতিটি মুহূর্তেই মাতা ও পিতার প্রতি মুহাব্বতের প্রেরণা ও শক্ত বন্ধনের নির্দেশ দেয়। ধর্মীয় কারণই হোক আর সামাজিক কারণেই হোক আমাদের বঙালি সংস্কৃতিতে মা-বাবা-র সাথে সন্তানের বন্ধন অত্যন্ত শক্তিশালী।
মা-বাবার জন্য আমাদের অনুভূতি প্রতিদিনকার, প্রতি মুহূর্তের। তার জন্য আলাদা দিনের প্রয়োজন নাই। তাই আসুন মা-বাবা কে আমরা শ্রদ্ধা করতে শিখি, ভালবাসতে শিখি। যার মা-বাবা নাই সেই বুঝে, কিন্তু তখন আর সময় থাকেনা। প্রতি নিয়ত যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হয়।
লেখক : পুলিশ সুপার (অপ্স এন্ড ইন্টেলিজেন্স),
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ হেডকোয়ার্টারস,
উত্তরা, ঢাকা।
0 Comments