আফতাব চৌধুরী
২১ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক শহীদ দিবস। এ দিবসে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তÍর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই গ্লোবালাইজেশনের প্রেক্ষিতে মাতৃভাষা সুরক্ষা সংগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য এবং সে সঙ্গে তৎপরবর্তীতে যে সব নতুন দিক বেরিয়ে আসছে, তা অনুধাবন করা জরুরি। গত শতাব্দীর শেষের দিকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, জাতীয় অর্থনীতির অতিজাতীয়করণ। জাতীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও সম্পর্কগুলোকে এখন আর আপন আপন ভৌগোলিক পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না। তা এক বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। এ বিশ্বাঙ্গিক অর্থনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মহিমান্বিত নাম হলো গ্লোবালাইজেশন। গ্লোবালাইজেশনের মাহাত্ম্য এমনভাবে প্রচারিত হচ্ছে যেন বিশ্বের বুকে এ এক অভিনব বার্তা, আলোর মতো যা স্বতঃপ্রতীয়মান, মধ্যাকর্ষণের মতো, স্বতঃসিদ্ধ, চন্দ্র-সূর্যের আবর্তনের মতো অবিকল্প, সংশয়াতীত যার গ্রহণযোগ্যতা।
আসলে সত্যিকার অর্থে এ বিশ্বায়িত অর্থনীতি পুঁজিবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। এ হল পুঁজিবাদের এক নতুন বিশ্বরূপ। অতি পুরাতন ভাব, নব আবিষ্কার। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের নাম উচ্চারণ না করে তার বিভিন্ন উপাদানের আলাদা নাম দিয়ে তৈরী করা হয়েছে এক নামের মালা। উন্মুক্ত বাজার, প্রতিযোগিতা, বাণিজ্য বিনিয়ন্ত্রণ, উদারীকরণ, কাঠামোগত পুনঃনির্মাণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ ইত্যাদি। জনগণের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নামের মালা-মানুষ তাই জপছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় বিস্তারে বিশ্ব পরিণত হয়েছে বিশ্বগ্রামে। এ প্রচারের মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের কোটি কোটি মানুষ। জাতীয় সীমানায় কোন বাঁধা কাজ করছে না। পুঁজির গতিশীলতা কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোন প্রান্তেÍ মুহূর্তে বিনিয়োজিত হচ্ছে। প্রকৃত বিশ্ব ও গ্লোবালাইজেশনের বিশ্ব এক নয়। গ্লোবালাইজেশনে বিশ্বকে দেখে পুঁজির দৃষ্টিতে। বিশ্ব তার কাছে পণ্যের বাজার এবং সমস্ত কিছু তার কাছে পণ্য অর্থাৎ দাম দিয়ে সবকিছু কেনা যায়। তাই পুঁজি যে কোন রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে যায় কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ তার রাষ্ট্রের সীমানা, চৌকাঠ পেরোতে পারে না। তাই গ্লোবালাইজেশনে হল পুঁজির গ্লোবালাইজেশনে, শ্রমের গ্লোবালাইজেশনে নয়।
বিশ্বপূজির স্বার্থে শাসকশ্রেণীগনও তাদের রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজে ‘রাষ্ট্রীয়’র জায়গায় ‘ব্যক্তিগত’ এবং ‘সরকারি’র জায়গায় বেসরকারি, গ্লোবালাইজেশনের এই সমস্ত বুলিকে সামনে এনে জনমনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহুজাতিক পূঁজির সামাজিক ভিত্তি রচনা করে দেয়। কাজেই গ্লোবালাইজেশনের ফলে রাষ্ট্র আদৌ ক্ষয় পাচ্ছে না। ক্ষয় পাচ্ছে পূঁজিগ্রহীতা জাতীয় রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এতে করে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর দাপট বেড়েই চলছে। এই বিশ্বাধিপত্যের পরিমন্ডলে দেশে দেশে গণতান্ত্রিক,
সংস্কৃতি প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। টেলিভিশন-সৃষ্ট এক নয়নাভিরাম সমাজ আমাদের আসক্তি ও আকাঙ্খাকে উদ্দীপ্ত করছে। তারা যে সাংস্কৃতিক খাদ্য খাওয়াবে সারা বিশ্বের মানুষ তাই খাবে। তারা যে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেবে মানুষ তাই কিনবে, তারা যেমনটি ভাবাবে মানুষ তেমনি ভাববে। রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে টিপে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে চ্যানেল ঘুরে আসা যাবেÑকিন্তু দর্শকেরা সাংস্কৃতিক খাদ্য পাচ্ছেন একই। আমাদের বাস্তব জীবন দূরদর্শনের পর্দায় রূপান্তÍরিত হচ্ছে যদিও এল কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে কোনও মিল নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশ ছাড়া বাকি বিশ্ব পরিণত হয়েছে তাদের সাংস্কৃতির অধীনে। সিনেমা, পপ মিউজিক, টিভি অনুষ্ঠান, পুস্তক, পত্রিকা, বিজ্ঞাপন এবং তৎসংশ্লিষ্ট জীবনধারা ও মূল্যবোধ বিপুল পরিমাণে রফতানি করছে সারা পৃথিবীতে। এক চিত্র পরিচালকের ভাষায় তারা আমাদের অবচেতনে উপনিবেশ বিস্তার করেছে।
মানুষের তো শ্রেণী চরিত্র থাকে। আর্থিক অবস্থান তার মাপকাঠি। ভাষার নিজস্ব কোনও শ্রেণী চরিত্র থাকে না। কিন্তু ভাষাকে শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। এক সময় বৈদিক ভাষাকে অভিজাততন্ত্রের একচেটিয়া বিষয় বলে মনে করা হত। একই যুগের লৌকিক ভাষায় কথা বলা মানুষদের মনে করা হত ব্রাত্য। এই অপভ্রংশ থেকে এল মারাঠি, গুজরাটি, হিন্দি, অসমিয়া, ওড়িয়া এবং বাংলা প্রভৃতি।
বিগত শতাব্দীর বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে লড়াই এই বাংলাভাষা নিয়ে- যা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো সেই দিন। এই লড়াই ভাষার বিবর্তন নিয়ে ছিল না, লড়াই ছিল প্রশাসনিক কাজকর্মে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে। সে জন্য ভাষার লড়াই শেষ পর্যন্তÍ রাজনৈতিক লড়াইয়ের চেহারা নেয়। ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে লড়াইটা চূড়ান্তÍ রূপ পায় যদিও কিন্তু মাতৃভাষায় শিক্ষা ও প্রশাসনিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইটা শুরু হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ-শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সময়েই ভাষাগত অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো মৌলিক সাংস্কৃতিক মত্তা নির্মাণের লড়াইকে পেছনে ঠেলে দেয়। স্বাধীনতার মূল শর্ত দাঁড়ায় দেশভাগ এবং তা ভাষার নিমিত্তে না হয়ে ধর্মের ভিত্তিতে হয়ে পাকিস্তান নামে দু’টি টুকরো অংশ কেটে পাকিস্তান হল। পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা হল বাংলা। আর পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পস্ত, বেলুচ ও গুজরাটি ভাষা ছাড়া কিছু উপ-ভাষারও চলন ছিল। পাকিস্তানের সরকারি প্রবক্তাদের এমন ধারণা ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তান মানেই উর্দু ভাষার দেশ। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ধারণা সঠিক ছিল না।
মহাম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তানের ভাষা ফর্মূলার ক্ষেত্রে ধূম করে ১৯৪৮ সালে অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির একটি বছর যেতে না যেতেই উর্দু ভাষার সাম্রাজ্যিক স্বৈরাচার চাপিয়ে দিতে চাইলেন জোর করে গোটা পাকিস্তানের উপর। তবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে উর্দুকে প্রাধাণ্য দেওয়ায় ব্যাপারটা ছিল একটু তাজ্জুবের। তার কারণ, উর্দু ভাষার উৎপত্তি মূলত ভারতীয় ভূ-ভাগেই এবং তা ত্রয়োদশ শতকের সুলতানি আমলে। ভারত থেকে অভিবাসী হয়ে যে পাঞ্জাবিরা নতুন সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল, তারা পাঞ্জাবি ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করেনি। তার জায়গায় উর্দু ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইল এবং তা পাকিস্তানের পূর্বখণ্ডেও যেখানে ৯৮ শতাংশ মানুষই বাংলাভাষিক সেখানেও।
পাকিস্তানের পূর্বখন্ড অর্থাৎ পূর্ব বাংলার মানুষ এই মৌলিক স্বাতন্ত্রকে সুচিহ্নিত করে। প্রথমত, জাতি গঠনের অনাধুনিক, অনৈতিহাসিক ও অযৌক্তিক ব্যাখ্যাকে পূর্ব বাংলার মানুষ অস্বীকার করে। এ ক্ষেত্রে ভাষাগত আবেগ জাতি গঠনের আবেগে মূর্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তান গঠনের এক বছরের মধ্যেই। দ্বিতীয়ত, জাতি গঠনের আবেগ থেকে জাতিগত শোষণের রূপ সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই সচেতন হয়ে ওঠেন, আর এই সচেতনতা জাতীয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পথ প্রশস্ত করে দেয়।
একুশের ভাষা সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি তরম্বিত করেছে। মানুষকে স্বদেশ সচেতন করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় বাংলাভাষার উন্নতি সূচিত হয়েছে। প্রকাশনা, গবেষণা, লুপ্ত সাহিত্য পুনরুদ্ধার, মননশীল সাহিত্য রচনা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় বাংলাদেশ পৃথিবীর সব মাতৃভাষার অধিকার আরও সুরক্ষিত, আরও উজ্জ্বল আরও সুদৃঢ় হোক, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।