সালেহ আহমেদ
পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ নামক এক ছোট্ট ব-দ্বীপ রাষ্ট্রের দূরদর্শী এক রাষ্ট্রনায়কের অসীম সাহসিকতা ও পর্বতসম আত্মবিশ্বাসের অবিশ্বাস্য এক রূপকথা। এই রাষ্ট্রনায়ক আর কেউ নন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যিনি দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের ব্যুহ ভেদ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ করেছেন। বিশ্বাসীকে দেখিয়েছেন বাংলাদেশ ‘বটম লেস বাস্কেট’ নয়। বাংলাদেশ পারে।
তাই পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের অনন্য গৌরব, মর্যাদা আর অহংকারের প্রতীক। দেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণের অনবদ্য উপাখ্যান। মাথা না নোয়ানো বাংলাদেশের দিকে অবাক বিস্ময়ে বিশ্বাসীর তাকিয়ে থাকার এক স্বর্ণহার। এ সেতুর প্রতিটি পরতে পরতে বিম্বিত জাতির পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার প্রত্যয় আর দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অসাড় ও কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ আর চূড়ান্ত অসহযোগিতার সমুচিত জবাব দেন এদেশের মানুষের অবিচল আস্থার প্রতীক, আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকের ভ্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের জবাবে বাংলাদেশ বলে দেয়, এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কোনো অর্থ ছাড় হয়নি। অন্য কেউ অর্থ দেয়নি। দুর্নীতি হবে কীভাবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ আর ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার বিজয় হয়। কানাডার আদালতে বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা অহমিকার পরাজয় ঘটে।
সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- বিশ্বব্যাংককে বারবার আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের অভিযোগের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করার জন্য। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি সেই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যদি বিশ্বব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সেই কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ পরে আদালতের মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ।
২০১২-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। ২০১২ সালের ৪ জুলাই সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ জুলাই আবারও সংসদে দাঁড়িয়ে ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে’ বলে জানিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ জাতির সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি। ২০১৫-এর ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। করোনা মহামারীতে বিশ্ব অচল হয়ে গেলেও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে অবাক করে দেয় বাংলাদেশ। এর মধ্যেই সেতুটি উদ্বোধনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে সরকার। জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২৫ জুন সেতুটি উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে ৪ জুলাই ২০০১ তারিখে মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হওয়ার মাধ্যমে একদিকে যেমন অন্তর্দেশীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, ঠিক তেমনিভাবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগ এবং অর্থনীতির ওপর পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিকে ইতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করবে বলে সবার বিশ্বাস। এই সার্বিক কর্মকাণ্ড সাহসিকতার সাথে পরিচালনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া শেখ হাসিনা যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই সিদ্ধান্তের কারণে খরস্রোতা পদ্মার ওপর আজকের এই সেতু নির্মিত হয়েছে। পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার সুচিন্তিত ও দৃঢ় সিদ্ধান্তের ফসল এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার উপায় নেই। নিজের নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ না করে ঐতিহ্যবাহী খরস্রোতা পদ্মা নদীর নামে পদ্মা সেতু নামকরণের সিদ্ধান্ত প্রদানের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুনরায় প্রমাণ করলেন, ভোগে সুখ নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।
এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের হাল ধরেছেন বলে। শেখ হাসিনা আছেন বলেই বাংলাদেশ আজ শান্তি, সাম্য আর সম্প্রীতির দেশ। শেখ হাসিনা আছেন বলেই তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ। শেখ হাসিনা আছেন বলেই বাংলাদেশ আজ হতে যাচ্ছে উন্নত এক দেশ।
মহান জাতীয় সংসদ সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে দৃঢ় প্রত্যয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে এক প্রস্তাব উত্থাপন করে। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের জবাবে বলেন, পদ্মাসেতু আমাদের আত্ম বিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। টেকনোলজি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের জ্ঞান হয়েছে। ভবিষতে আরও উন্নত কাজ করতে পারব। গোটা পৃথিবীতে এই ষ্ট্রাকচারের কোন সেতু নির্মিত হয়নি। বাংলাদেশ যে নিজেরা পারে, এই ধারণাটাই বাংলাদেশের মর্যাদা সারা বিশ্বে উজ্জ্বল করেছে। হ্যাঁ আমরা পারি! বাংলাদেশ পারে। জাতির পিতা বলেছিল, কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না। তো কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারে নাই। পারবেও না ইনশাল্লাহ। এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এগিয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আমার সততাটাই হচ্ছে আমার শক্তি আর বাংলাদেশের জনগণ। এই জনগণকে অপমান করে আমি কোন কিছু করব না। আমি জানি এই একটা সিদ্ধান্ত (নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার) যখনই সেতু নির্মাণ শুরু করে দিলাম তখনই সকলের টনক নড়ল। তখন বাংলাদেশকে সবাই সমিহ করতে শুরু করল। এসময় স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন বলেছি নিজের টাকায় করব, এদেশের মানুষরা কিন্তু এগিয়ে এসেছে। এখনও আমার কাছে সেসব চেক আছে। যে যা পেরেছে দিয়ে গেছে। আমি চেকগুলো ভাঙাইনি। রেখে দিয়েছি। কারণ আমরা তো টাকা জোগার করে শুরু করে দিয়েছি, আমি তো পারব করতে। আমরা নিজেদের অর্থায়নে করেছি। তিনি বলেন, এটা শুধু সেতু নয়, ডাবল ডেকার সেতু। সেতুর নিচে দিয়ে রেলওয়ে উপর দিয়ে চলবে গাড়ি। এসময় তিনি জানান, একসাথে ব্রিজে ট্রেন ও গাড়ি পূর্ণ থাকলেও সেতু যেন ভার বইতে পারে সেভাবে পিলার এমনভাবে করা হয়েছে যেন ৫ হাজার টনের জাহাজ ধাক্কা দিলেও পিলারের কোন ক্ষতি হবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার পদ্মা সেতুর খরচ বৃদ্ধির বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেন। নকশা পরিবর্তন, রেলসংযোজন, গ্যাসলাইন ও বিদ্যুৎ লাইন সংযোজন, পুরো সেতু জুড়ে একই রকম শক্তিশালী পিলারের সংযোজনসহ কিভাবে সেতুর খরচ বেড়েছে তা সংসদকে জানান। এসময় তিনি আরো বলেন, অনেকে কেন দাম বেড়েছে এটা সেটা নানা কথা বলে। মেগা প্রজেক্ট কেন করা হচ্ছে? অর্থনীতিবিদ প্রফেসর তাদের মুখ থেকে এসব কথা শুনলে কেমন লাগে? কি মানসিকতা এদের! কত হীনমণ্যতায় ভোগে এরা! জানি তারা কনসালটেন্সি পাবে না এই তো? আর তো কিছু না। অথবা ইউনূস যদি কিছুটা উচ্ছিষ্ট বিলায়।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আরো বলেন, ড.ইউনূস তার একটা এমডি পদের লোভে সে বিশ্ব ব্যাংককে দিয়ে হিলারি ক্লিনটিনকে দিয়ে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করিয়েছিল। তারা ভেবে ছিল আমরা এখানে সারেন্ডার করব আমি শেখ মুজিবের মেয়ে এটা মনে রাখবেন। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি, করব না। এই দেশকে আমরা ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। দেশের মাথা কোনরকম হেট হোক এটা কোন দিন করব না। তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারি না, একটা এমডি পদের জন্য এরা দেশের এতো বড় ক্ষতি কিভাবে করে? যেসমস্ত ইমেইল দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের কাছে সব সেন্ড করা আছে। এই যে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা। আমরা বিশ্ব ব্যাংকের দোষ দিচ্ছি কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক দিয়ে করানো হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তাঁর শেষ কর্মদিবসে এটা সাক্ষর করে বন্ধ করে দিয়ে গেছে টাকা। তারপর চাপ আসল অমুককে গ্রেফতার করতে হবে তমুককে গ্রেফতার করতে হবে তাহলে টাকা দেবে। আমি বলেছি আমার কোন অফিসারকে বা আমার কাউকে আমি অপমান করতে দেব না। সেসময় যোগাযোগ মন্ত্রীকে অপসারণ করতে বলা হলো। মোশাররফকে তো গ্রেফতার করেই দিলো। তিনি বলেন, আমি জানি কোন টাকা ছাড় হয়নি। তাহলে দুর্নীতিটা কোথায় করা হলো? আমি চাচ্ছি একটা কাগজও দিতে পারেনি। তারপর আসল অমুককে গ্রেফতার করলে টাকা দেবে। এধরণের প্রস্তাবে আমি বললাম পদ্মা সেতু আমি করব না। যে দিন নিজের টাকায় করতে পারব সেই দিন করব কিন্তু আমার দেশকে অপমান করে টাকা নিয়ে করতে হবে আমাকে ভয় দেখায়, যদি এটা না হয় আপনার নির্বাচনের কি হবে, জনগণ ভোট দেবে না ক্ষমতায় আসব না। তিনি বলেন, ২০০১ সালে আমেরিকার চাপে গ্যাস বিক্রি না করলে ক্ষমতায় আসতে দেবে না। আমি রাজি হইনি। তখন আমি ক্ষমতায় আসতে পারিনি। খালেদা জিয়া মুচলেকা দিয়েছিল সে ক্ষমতায় এসেছিল। এটা তো চোখের সামনে আমার।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আরো বলেন, ক্ষমতা আমার কাছে বড় কিছু না ক্ষমতা আমার কাছে মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ সেটাই করে যাচ্ছি। এই দেশের মানুষ যেন গরীব না থাক দরিদ্র না থাকে। কোন মানুষ ভূমিহীন গৃহহীন থাকবেনা। দেশবাসীর সর্মন বড় শক্তি। তিনি বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। আমাদের একটা খারাপ সময় গেছে। তারপর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আছি বলে উন্নয়ন করতে পেরেছি পদ্মাসেতুও করতে পারলাম। আজ আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এসময় তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণের সাথে জড়িত সবাইকেও ধন্যবাদ জানান।
লেখক : সাংবাদিক।