ইরানী বিশ্বাস
০১
দেশে হঠাৎ করে খুনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। আজ সকালেও একটি ঘটনা নজরে আসে সুমনের। পরকিয়ার জেরে স্ত্রীকে খুন করেছে। যথাযথ ফোর্স পাঠানো হয়েছে। লাশ পোস্টমর্টেম করে সুরতহাল রিপোর্ট নিয়ে থানায় মামলা হয়েছে। আসামীকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। গুম, মার্ডার, আত্মহত্যা, মারামারি, জোর-দখল এ ঘটনা নিত্যদিনের। অনেকটা গা-সহা বাংলাদেশ পুলিশের।
আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছে সুমন। অনেকদিন ধরে বিভিন্ন ঘটনার কারণে একদমই বাসায় সময় দেয়া হচেছ না। শ্বশুরবাড়ি থেকে লোকজন আসবে। তাদের জন্য একটু বাজার করতে হবে। সবচেয়ে বড় কারণ, ঘরে এখন শিশু সন্তান। রিয়া জন্মানোর পর থেকে বাসার প্রতি টানটা একটু বেড়ে গেছে। বয়স ৫ পেরিয়েছে মাত্র। তাতে কি এখনই গলার সুর চিনতে পারে। বাড়ির দরজায় পা রাখলেই যেন সে বুঝতে পারে, পাপা এসেছে। দেখলেই হাত, পা নাড়িয়ে কি সব বোঝাতে চায়। তার মা একদিন বলেছিল,
– ছেলেরা যেমন মা নেওটা হয়। মেয়েরাও ঠিক তেমন বাবার নেওটা হয়। সুমন এবার থেকে দেখবি কেমন মায়া। পরে তো এই বুড়ো মা’কে ভুলে যাবি।
পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের কাছে বুঝি সন্তানের চেহারা একই রকম। হৃদয়ের ভালবাসা দিয়ে সে চেহারা তৈরি হয়। সেদিন মায়ের কথা শুনে একটু রেগি গিয়েছিল সুমন। কিন্তু আজ মনে হয় মায়ের কথাগুলি সত্যি। মেয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে মায়ের খোঁজ নেওয়ায় যেন একটু ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে আজকাল। কথাটা ভাবতেই মাকে এবার ফোন করে কুশল জেনে নেয়। বাসায় আজ পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। অনেকদিন পর তাড়াতাড়ি বাসায় আসাতে হোমমিনিস্টার বেজায় খুশি। সারাদিনের ক্লান্তি ছাপিয়ে চোখ বেয়ে যেন ঘুম নেমে এলো সুমনের। মেয়ের পাশে বসে খেলা করতে করতে কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।
মেহেরিন ভীষণ শান্ত স্বভাবের একটি মেয়ে। স্বামীকে সব সময় হেল্প করার চেষ্টা করে। সে সুমনের চেহারা দেখলে বুঝতে পারে, তার কি দরকার। সংসারের অন্যান্য কাজ গোছাতে যাবার আগে দেখে গেছে মেয়ে, তার বাবার সাথে খেলা করছে। মেহেরিন চিন্তা করলো যাক ভালই হলো। এমনিতে সময় পায়না। আজ তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছে, মেয়েকে নিয়ে কিছুটা সময় কাটাক। সব কাজ সেরে রুমে ঢুকে যা দেখছে মেহেরিন তাতে তার হাসি কিছুতেই থাকছে না। বাবা ঘুমাচ্ছে, আর মেয়ে তার ঘুমন্ত বাবার চোখ খোলার চেষ্টা করছে। কখনো বা নাকের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ দুরে দাড়িয়ে মজা দেখতে থাকে মেহেরিন। তারপর কাছে গিয়ে মেয়ের বিছানা ঠিকঠাক করে মেয়েকে নিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়ে। সুমনকে ডির্স্টাব করবে না বলে তাকে ডাকা হয়নি। সে যেভাবে ছিল সেভাবেই ঘুমাচ্ছে।
রাত আনুমানিক ৫টা হবে। দুরে থাকা অফিসিয়াল মোবাইলটা বেজে ওঠে। ঘুম ভেঙ্গে যায় সুমনের। চিন্তা করে অফিসের মোবাইলে কল এসেছে এত রাতে। তার মানে কিছু ঝামেলা হয়েছে। ঘুম ভাঙ্গা চোখে উঠে পাশের টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করে সুমন,
– হ্যালো, সুমন স্পিকিং।
– আপনাকে এক্ষুণি একবার উত্তরা ১২ নম্বর আসতে হবে।
– আমি তো পল্টন থানায় আছি। পল্টন থেকে উত্তরা কেন? আপনি তো উত্তরা থানায় ইনফর্ম করতে পারেন।
– দেখুন কি পারতাম আর কি পারতাম না সেটা বলার সময় এখন না। এখানে একটি খুন হয়েছে।
– খুন!
কথাটা বলার সাথে সাথে সুমন একটু নড়েচড়ে বসে। ততক্ষণে অপরপ্রান্তের লাইন কেটে যায়। পুলিশকে এত সময় নিতে নেই। ট্রেনিংয়ের সময় তাদের তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ঘটনা যত ভয়াবহ হোক, মাথা ঠান্ডা রেখে ডিসিশান নিতে হয়। তবে এই ডিসিশান নিতে সময় মাত্র দশ সেকেন্ড। লাইন কেটে যাবার পরও বার বার চেক করে নাম্বারটি খোলা আছে কি না। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। এভাবে দুইবার রিং হওয়ার পর মোবাইলটি সুইচঅফ বলছে। চিন্তায় পড়ে যায় সুমন।
আর সময় নেওয়া ঠিক হবে না। এক্ষুনি ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সেতো পল্টন থানায় কর্মরত। সুমন টেলিফোনে উত্তরা থানায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কাজ না থাকায় প্রায় সকল ডিউটি অফিসার ঘুমাচ্ছে। থানায় একজন হাজতী রয়েছে। সে কারণে একজন কনস্টেবল গার্ডে রয়েছে হাজতের সামনে। টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে, কেউ ধরছে না। অনেকক্ষণ পর কনস্টেবল এসে টেলিফোন ধরে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এসে যায় ডিউটিরত পুলিশ অফিসার মারুফ। তিনি টেলিফোনে কথা বলেন সুমনের সঙ্গে। বিস্তারিত জানিয়ে দেয় সুমন, কোথায় কতো নম্বর রোডে যোগাযোগ করবে। তবে প্রবলেমটা হলো হাউস নাম্বার দেওয়া হয়নি। এতক্ষণে সুমনের মনে খটকা লাগলো। কেউ কি তার সাথে দুষ্টামী করল, নাকি সত্যি সত্যি। উত্তরা থানা থেকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো,
– স্যার হাউস নাম্বার বলেছে?
– না, তেমন তো কিছু বলেনি।
– স্যার ব্লক নাম্বার?
– না, তাও তো বলা হয়নি।
এবার সুমন নিজেকে একটা আহম্মক ভাবতে লাগলো। এতবড় একটা ভুল সে কি করে করতে পারলো। পুলিশের আরেক নাম ইনফরমেশন। কিন্তু সে তো ইচ্ছে করে ভুল করেনি। এটা হয়ে গেছে, না তা ঠিক নয়। মেয়েটি আসলে কিছু জানার সুযোগইতো দেয়নি। তাতে সুমনের দোষ কি?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুমন একটু কড়া সুরে অপর প্রান্তে থাকা পুলিশ অফিসারকে বলে,
– এত ডিটেইলস জানার তো দরকার নাই। অন্তত একটা ক্লু পাওয়া গেলেই ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দেওয়া উচিত।
– জ্বী স্যার। নো টেনশান আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ছি।
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে অনেকগুলি রোড রয়েছে। পুলিশের তিনটি গাড়ি তিনদিক থেকে তল্লাশী শুরু করে। প্রত্যেক রোড, ব্লক, বাড়ি তল্লাশী শেষে একটা হোটেলের খোঁজ মেলে। সেখানে কক্ষগুলি তল্লাশী করে দেখা যায় একটা দরজা ভেতর থেকে লক করা। অনেক ডাকাডাকি করেও কোন সাড়া মেলেনি। অবশেষে পুলিশের সন্দেহ গিয়ে পড়লো সেখানে। হোটেলের রিসিপশনে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখা গেল একটি ইয়াং ছেলের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে সোফার উপরে।
তাৎক্ষণিক লাশ ময়না তদন্তে পাঠানো হয়। হোটেল রুমের মধ্যে থাকা বিশেষ জিনিসপত্র খুনের আলামত হিসাবে সংগ্রহ করা হয়। আগের দিনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হলো। সেগুলি ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল যে ছেলেটি খুন হয়েছে তার নাম রেজিষ্টার্ড খাতায় শুভ লেখা রয়েছে। তবে ছেলেটি একাই এসেছে। তার সঙ্গে অন্য কোন মানুষ ছিল না। আরো ভাল করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো মুল গেইট দিয়ে প্রবেশ করা সকল সদস্যদের ফুটেজ। অনেক দেখার পর সেদিন রাত ১১টার দিকে প্রবেশ করতে দেখা যায় একজন ছেলে অতিথি প্রবেশ করে। সঙ্গে একটি কাপড়ের হ্যান্ড ব্যাগ যেটা পিঠে ঝোলানো ছিল। একে একটু সন্দেহজনক মনে হতে লাগলো মারুফের। কয়েকবার দেখার পর সন্দেহটা বেড়েই চলতে লাগলো। কেন যেন ফেইক মনে হচ্ছে। সাজ পোশাক দেখে ছেলে মনে হলেও চলন বলনে অনেকটা মেয়ে মনে হতে লাগলো। আপাতত কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না। সেদিন রাতে রিসিপশনে থাকা ছেলেটিকে ডাকা হলো। তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, রাত ১১টায় আসা সদস্য সম্পর্কে। ছেলেটি বলল,
– তিনি আসার আগে হোটেল ৩০৩ নাম্বার রুম থেকে আমাকে জানানো হলো নাইম নামে একজন বিদেশি অতিথি তার রুমে যাবে। আমি যেন পাঠিয়ে দেই।
– কি নাম ছিল ছেলেটির?
– স্যার ওনার নাম ছিল নাইম।
– ঠিকানা কি ছিল?
– তিনি তো বিদেশি মানুষ। বলছিল কোন দেশ থেকে যেন এসেছিল।
– তাহলে তো পাসপোর্টের কপি থাকবে।
– না স্যার, ওনার পাসপোর্ট হারাইছে, তাই দেখাতে পারে নাই।
একটু উদ্বিগ্ন হয়ে মারুফ তাকায় ছেলেটির দিকে,
– কি বললে, পাসপোর্ট হারায়ে গেছে? ও মুখে বলল, আর তুমি সেটা বিশ্বাস করে তাকে থাকতে দিলে?
একটু বিনয়ের সুরে ছেলেটি বলে,
– কি করবো স্যার, রুম থেকে তো আমাকে তার সম্পর্কে বলা হয়েছিল। তাছাড়া ছেলে মানুষ তাই আর তেমন ঝামেলা করিনি। এ ছাড়া রাত তখন বাজে ১১টা। কি করতাম বলেন?
দুশ্চিন্তার রেখা কপালে ফুটে ওঠে মারুফ সাহেবের। আপাতত এই ছেলেটিকেই সন্দেহের তালিকায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ প্রশ্ন করে,
– আচ্ছা ওই ছেলেটি এখন কোথায়?
– তাতো জানি না স্যার। আপনারা এসে কি দেখেছেন? তিনি ছিলেন রুমে?
– কি ব্যাকুবের মতো কথা বলছো। ওই ছেলেটি থাকলে কি আর তোমাকে জিজ্ঞাসা করতাম?
– স্যার আমাকে তো এখন ডেকে আনা হয়েছে। আমি কাল রাত ১২টায় বাসায় গেছি। আজ আমার বিকালে আসার কথা ছিল। হোটেল থেকে সকালে টেলিফোন করে আসতে বলেছে জরুরী। তাই আসলাম।
ছেলেটির কথা শুনে একটু বেশি দুশ্চিন্তা হতে লাগলো মারুফের। লাশের সাথে থাকা মোবাইল মানিব্যাগ নিয়ে এসেছে। আর জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে আনা হয়েছে উত্তরা থানায়।
সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ ভাল করে দেখতে লাগলো ইনভেস্টিগেশন টিম। খুনি ভিষণ চালাক আর বুদ্ধিমান। লাশের সাথে থাকা মোবাইলের সিম নেই। আর যে নম্বরটি দিয়ে পল্টন থানায় কল করেছিল সেটাও বন্ধ।
আজকের সকালটা নাইমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হলো। শরীরে মনে আর কোন অবসাদ লাগছে না। বেশ ফুরফুরে মনে হতে লাগলো। আজ অনেক দিন পর বেডরুমের পর্দা সরিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখার ইচ্ছে হলো। সুর্যটা অনেক উপরে উঠে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে টেবিলে রাখা ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখলো, তাতে ১০টা বাজে। গোসল সেরে ন্যাপথালিনের সুগন্ধি ছড়ানো নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। শাড়িটির দিকে একবার তাকালো। মায়ামাখা এই শাড়িটা। এতে জড়িয়ে আছে কতোশত স্মৃতি। মনে হয় এর প্রতিটি সুতার ফাঁকে যেন এক একটা গল্প জড়িয়ে আছে। শাড়িটি তার শরীরে লেপটে আছে ভালবাসার মানুষটির মতো। কাঁধ ছাড়ানো বাদামী চুল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে পড়ছে। এই জলগুলি মেঝে বিছানো কার্পেটে পড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গে তা মিলিয়ে যাচ্ছে। সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাইমা। মানুষও বুঝি এমন, কষ্ট, সুখ সবই ধারণ করতে পারে। প্রতিদিনের সকালের সূর্য কতোশতো মানুষের স্বপ্নের জন্ম দেয়। আবার কতোশতো মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নেয়। তবুও মানুষ বেঁচে থাকার আশায় ঘুম ভাঙ্গে, প্রথম সূর্য আলিঙ্গন করে। কখনো বাঁধভাঙ্গা হাসি ছড়িয়ে, কখনো কান্নার জলে।
সূর্য উপরে উঠে যেতে যেতে পূব আকাশটা নীল ছড়াতে লাগলো। নাইমা নিজের নীল শাড়ির আঁচল ছড়িয়ে, নীল আকাশের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিচেছ। দরজায় দাঁড়িয়ে জবা বললো,
– খালাম্মা, নাস্তা খাইবেন কখন। টেবিলে খাবার ঠান্ডা হইয়া যায়।
জবার কথা শুনে নিজেকে চটপট স্বাভাবিক করে ফিরে তাকায় তার দিকে। তারপর মুখে একটা হাসি দিয়ে বলে,
– একদম ভুলে গেছি নাস্তা খাওয়ার কথা। তোর খালু খেয়েছে?
– জ্বী খালাম্মা। নাস্তা খাইয়া, অসুধ খাইছে। অহন আবার ঘুমাইতাছে।
জবার কথা শুনে কি যেন ভাবছে মনে মনে। তারপর তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কি দিয়েছিস টেবিলে?
– রুটি, সবজি, ডিম।
– এক কাজ কর, আমার জন্য শুধু এক গ্লাস দুধ নিয়ে আয়। আজ আমার আর ডাইনিংয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
– জ্বী খালাম্মা।
জবা ফিরে যায় কিচেনে অথবা ডাইনিংয়ে। নাইমা জানালার পর্দা আবার টেনে দিয়ে বিছানায় এসে বসে। মনে মনে ভাবে চারটা বছর জীবন থেকে কেটে গেল। শুরু আর শেষ এই দুরত্বটা খুব বেশি না। অথচ এরই মধ্যে জন্ম হয়েছে কতো ঘটনা-দুর্ঘটনা। মানুষ আসলে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকে না।
তখন নাইমা সবে মাত্র ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয়বর্ষ। বান্ধবীদের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল বসুন্ধরায়। সিনেমা শেষে ফেরার পথে রাকিবের সাথে দেখা। রাকিবের কেন ভাল লেগে গেল নাইমাকে। তার সঠিক ব্যাখ্যা এখনো জানতে পারেনি নাইমা। সত্যি বলতে ভাললাগা কখন, কোথায়, কিভাবে আসবে কেউ বলতে পারে না। তেমনটাই ঘটেছিল রাকিবের ক্ষেত্রে। এক সময় বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসে নাইমা। রাকিব বিজনেসম্যান। উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়ি পেয়েছে ধানমন্ডিতে। এ ছাড়াও আরো দুই-তিনটা বাড়ি আছে ঢাকা-ঢাকার বাইরে। বেশ হেসে খেলে কেটে গেল ৬ মাস।
রাকিবের অফিসে নতুন প্রডাক্ট লঞ্চিং করা হবে। তার জন্য একজন ব্র্যান্ড এম্বাসিডর দরকার। প্রডাক্টের বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল হান্টিংয়ের আলোচনা হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন বিজ্ঞাপন দিয়েও মনের মতো মডেল খুঁজে পায়নি। এর অবশ্য কারণও আছে। এ কোম্পানী চাচ্ছে কোন নতুন মেয়েকে মডেল হিসাবে উপহার দেবে তারপর তাকে ব্রান্ড এ্যম্বাসেডর করা হবে। যে ভাবনা সেই কাজ। আর এতে সাহায্য করছে কোম্পানীরই ম্যানেজার। তিনি একটি মিডিয়া হউসকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তারা আয়োজন করেছেন প্রাথমিক নির্বাচনের। যারা বা যে সকল মডেল পছন্দ করে সিলেকশান করা হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই রাকিব সাহেবের সামনে এসে ডিসকলিফাই হচ্ছে।
একদিন ম্যানেজার শফিক এসে দাঁড়ায় রাকিব সাহেবের টেবিলের সামনে। ট্যাবটবে চোখ রেখে রাকিব সাহেব বসতে বলেন ম্যানেজারকে। প্রথমে কোম্পানীর ভাল মন্দ নিয়ে অনেক কথা বলেন শফিক সাহেব। তারপর ধীরে ধীরে শুরু করেন আসল কথা।
– স্যার এত কিছু করেও আমরা মডেল পেলাম না।
– হু। সেটাই তো দেখছি। কি করা যায় বলেন তো?
মুখে অনেকটা হাসি ঝুলিয়ে অনেকটা বিনয়ের সুরে আস্তে আস্তে বলতে থাকে শাফিক সাহেব,
– স্যার যদি অনুমতি দেন তাহলে একটা কথা বলতে চাই।
– কি কথা। বলে ফেলেন।
– স্যার আামার খোজে একজন ভাল মেয়ে আছেন। তারও খুব ইচ্ছে মডেলিং করার। স্যার আমি বলছি না তাকেই আমরা নেবো। কিন্তু যদি একবার দেখতেন।
– কি করে মেয়েটি?
– স্যার, পড়ালেখা করে। অনেক ভাল ঘরের মেয়ে। কোন সমস্যা হবে না। আপনি স্যার যেমন চাচ্ছেন ঠিক..
– আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন আসতে বলেন।
– জ্বী স্যার। থ্যাংক ইউ স্যার। স্যার তাহলে কি কাল আসতে বলি?
– কাল ? না না কাল হবে না। কাল তো দুপুরে মিটিং আছে।
– স্যার কোন প্রবলেম নাই স্যার। বিকালে আসতে বলি। আফটার লাঞ্চ।
– আফটার লাঞ্চ ! ওকে ঠিক আছে।
– থ্যাংক ইউ স্যার।
খুশি মনে চলে যায় শফিক সাহেব। আবার ল্যাবটবে মনোযোগ দেয় রাকিব সাহেব।
পরদিন যথারীতি অফিস শুরু হয়। দুপুরের মিটিং শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ৪টা। মিটিং শেষে নিজের রুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হবে চেয়ারে গা এলিয়ে আরাম করে বসে। চোখটা বুজে আসে। এমনিতে রাকিবের অনুমতি ছাড়া কখনোই কেউ এ রুমে ঢোকে না। তাই চোখ বন্ধ হয়ে আসতেই ঘুম এসে যায় দুচোখ জুড়ে। হঠাৎ আধা ঘন্টা পরে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। ম্যানেজার শফিক সাহেবের কল। তিনি জানালেন, মেয়েটি এসেছে রিসিপশনে। তাকে নিয়ে ভেতরে আসবে কি না। কথা শেষ হতেই রাকিব সাহেব ম্যানেজারকে জানিয়ে দেয়, মেয়েটিকে নিয়ে তার রুমে যেন আসে।
মেয়েটির আসার খবর শুনে অনেকটা প্রস্তুতি নেয় রাকিব সাহেব। মেয়েটি দেখতে নিশ্চয়ই সুন্দরী হবে। মডেল হবার জন্য তো আর যে-কেউ আসবে না। তাছাড়া এ পর্যন্ত কতো মেয়ে বাদ পড়েছে শফিক সাহেব সে সব কথা জানে। এবার যখন তিনি নিজে প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন নিশ্চয়ই সেটা ভাল না হয়ে যায় না। অপেক্ষার মাত্র ২০ মিনিট পরে দরজা ঠেলে ভেতরে আসে ম্যানেজার শফিক এবং মেয়েটি। শফিক সাহেব বসার অনুমতি নেবার আগেই রাকিব সাহেব চোখ তুলে তাকায় তাদের দিকে এবং বসতে বলে।
স্বভাবে রাকিব সাহেব খুবই গম্ভীর প্রকৃতির। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলেন না। আর মেয়েদের দিকে তিনি তাকাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না। মাঝে মাঝে নাইমা এ নিয়ে খুব খোটা দেয়, ‘তুমি আমার সঙ্গে প্রেম করেছো এটা কেউ বিশ্বাস করবে। এমনকি আমিও এখন অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি। পৃথিবীতে কাজ ছাড়া তুমি আসলে আর কাউকে ভালবাসো না।’ নাইমার এমন অভিযোগ মোটেই অযৌক্তিক নয়।
প্রথমবার তাকিয়ে আবার তাকানোর উৎসাহ পেয়েছে রাকিব। ম্যানেজার শফিক দাড়িয়ে আছে। প্রায় তার কাঁধ ছাড়িয়ে গেছে মেয়েটি। লম্বা, হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটির গায়ের রং মোটেই ফর্সা নয়। চোখ দুটি নেশা ধরায়। ঠোট সেতো চুম্বকের মতো টানে। অন্যদিন হলে রাকিবকে হয়তো শফিক সাহেব পরিচয় করিয়ে দিতেন। কিন্তু আজ কি হলো? রাকিব সাহেব নিজেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। কি দেখছে এমন খুটিয়ে খুটিয়ে, তাহলে কি পছন্দ হয়ে গেলো। সাত পাচ ভাবতে ভাবতে শফিক সাহেব মনে করলেন এটাই উপযুক্ত সময়, কেটে পড়ি। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– স্যার আমার একটু কাজ আছে। আমি যেতে পারি?
– তাহলে উনি?
– স্যার কোন সমস্যা নাই। আপনি যা যা জিজ্ঞেস করার করেন। আমি আসছি।
কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন রাকিব সাহেব। তারপর বললেন,
– ঠিক আছে আপনি যান।
শাফিক সাহেব চলে গেলেন। রুমের মধ্যে রাকিব সাহেব আর তার সামনে বসে আছে সুন্দরী এক তরুনি। মেয়েটির গলায় সরু একটা সোনালী চেইনে ছোট্ট একটা লকেট ঝুলছে। শালিনতা বজায় রেখে পোশাক পরেছে। হয়তো এ কারণে রাকিব সাহেবের পছন্দ হয়েছে। তারপর রাকিব সাহেব দৃষ্টির প্রখরতা বাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,
– কি নাম আপনার?
– লোটাস।
(চলবে)
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক,
নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।