মোঃ এনায়েত করিম
স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের কালজয়ী অবদান সর্বজনবিদিত। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধযোদ্ধা বাংলাদেশ পুলিশের বীর সদস্যগণ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণদান ও অস্ত্র-গুলি সরবরাহ করে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। এই বীর পুলিশ সদস্যদের সেইসব বীরত্বগাঁথা, আত্মদানের অবিদিত কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াসে আমাদের এই আয়োজন।
পর্ব-০১
খেতাবপ্রাপ্ত বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা
মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অসংখ্য বাঙালি কর্মকর্তা দেশ ও জাতির জন্য নিজের জীবন ও চাকরির মায়া ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের অবিস্মরণীয় করে রেখেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম মাহবুব উদ্দিন আহমেদ।
জনাব মাহবুব উদ্দিন ১৯৪৫ সালে বরিশাল জেলায় কোতয়ালি
থানাধীন আমানতগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থর্নীতিতে এমএ ডিগ্রি সম্পন্ন করে ১৯৬৭ সালে এএসপি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চে তৎকালীন যশোর জেলায় ঝিনাইদহ মহকুমায় পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিনি অসহযোগ আন্দোলনে সমমনা সহকর্মীদের সাথে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সম্ভাব্য করণীয় সম্বন্ধে মতবিনিময় করেন। ২১ এবং ২২ মার্চ ঝিনাইদহ ওয়াপদা রেস্ট হাউসে মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী, নড়াইলের এসডিও কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, মাগুরার এসডিও ওলিউল ইসলাম, গোয়ালন্দের এসডিও শাহ মোহাম্মদ ফরিদের সাথে মিলিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের সম্ভাব্য আক্রমনের বিরুদ্ধে করণীয় বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে যে কোন সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করা, নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা এবং সম্ভাব্য যে কোন পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশব্যাপী আক্রমণ শুরু করলে স্থানীয় পুলিশ সদস্য, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-জনতা সমন্বয়ে তিনি সবাইকে সংগঠিত করেন এবং অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩০ মার্চ রাতে কুষ্টিয়া শহরে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যবাহিনীর উপর আক্রমণ করে কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত করেন। এরপর তিনি ১০, ১১ এবং ১২ এপ্রিল মাদারতলা এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্বদান করেন।
এরপর মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনঃ
১৯ এপ্রিলঃ সহযোদ্ধাসহ বেনাপোল এলাকায় ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে সংযুক্ত হন।
২০ এপ্রিলঃ মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এমএজি ওসমানী এর সাথে বেনাপোল ডিফেন্স পরিদর্শন করেন।
২৩ এপ্রিলঃ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এর সাথে বেনাপোল ডিফেন্স পরিদর্শন করেন।
২৪ এপ্রিলঃ তিনি ভোর ৪ টায় বেনাপোল এলাকা কাগজপুকুর ডিফেন্সের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এরপর তিনি ৮ নম্বর সেক্টর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে সাতক্ষীরাতে নিযুক্ত থেকে নিম্নলিখিত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনঃ
২৮ মেঃ সাতক্ষীরার ভোমরা বাঁধে আক্রমন পাল্টা আক্রমন করে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রভূত ক্ষতিসাধন করেন।
২০ সেপ্টেম্বরঃ পাকিস্তানি বাহিনীর বৈকারী ঘাঁটির উপর আক্রমণ করেন। ১০ ঘন্টাব্যাপী এই যুদ্ধে তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে ভারতের ব্যারাকপুর সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হন।
১৬ অক্টোবরঃ সুস্থ হয়ে পুনরায় সেক্টরে যোগদান করে সাতক্ষীরা তালা ও পাটকেল ঘাটার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে “বীর বিক্রম” উপাধিতে ভূষিত করেন। স্বাধীনতার পর তিনি ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ নিজেকে আওয়ামীলীগের রাজনীতিসহ ব্যাক্তিগত ব্যবসা ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রেখেছেন।
শহীদ তৌহিদ আলী বীরবিক্রম
তৌহিদ আলী ১৯৫৫ সালে সিলেট জেলার গোপালগঞ্জ
থানাধীন মুকিতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মিশির আলী এবং মাতা মরহুমা সুলক চান বিবি। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি বাবার-মার দ্বিতীয় সন্তান।
তিনি ১৯৭০ সালে কনস্টেবল পদে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে যোগদান করেন। তার কনস্টেবল নং ছিল ৭৯৬। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর অমানবিক নির্যাতন নিপীড়ন শুরু করলে, বঙ্গবন্ধুর আহবানে দেশ ও দেশের মানুষকে বর্বর হানাদার বাহিনীর নাগপাশ হতে মুক্তি করার প্রত্যয়ে তিনি পাকিস্তানি সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর রাজশাহী পুলিশ লাইন্স দখলের পর তিনি কর্মস্থল ত্যাগ করে রাজশাহী অঞ্চলে পুলিশ-ইপিআর-জনতা সম্মিলিত মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভয়নগড় ব্রিজ এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন এবং শাহাদতবরণ করেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে তৌহিদ আলীর অসামান্য বীরত্ব ও সাহসীকতা এবং আত্মোসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে “বীর বিক্রম” খেতাবে ভূষিত করে।
শহীদ আব্দুল মান্নান বীরবিক্রম
আব্দুল লতিফ এবং মিসেস রাবেয়া খাতুনের চতুর্থ সন্তান আব্দুল মান্নান ১৯৪৮ সালে বি-বাড়ীয়া জেলার নবীনগর থানার নোয়াগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নোয়াগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শ্যামগ্রাম মোহিনী কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় হতে শিক্ষাগ্রহণ শেষে তিনি ১৯৬৭ সালে কনস্টেবল পদে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে যোগদান করেন। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন্সে নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গামাটি পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ছিলেন। তার কনস্টেবল নম্বর ছিল ৬২১। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ২৬শে মার্চে প্রতিরোধযুদ্ধে যোগদান করেন। ইপিআর বাহিনীর সাথে কালুরঘাট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমনে কালুরঘাটের পতন হলে অন্যদের সাথে ভারতে অবস্থান পরির্বতন করেন। ভারত থেকে পুনরায় এক নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন। ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মদিনাঘাট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং শাহাদাতবরণ করেন। তার মরদেহ রাউজান থানার আবুল মিল গ্রামে বৌদ্ধভূষণ বরুয়ার বাড়ীর পাশে সমাহিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য সাহসিকতা ও কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার এই বীর পুলিশ সদস্যকে “বীর বিক্রম” খেতাবে ভূষিত করেন । তার পরিবারকে ১৯৯৭ সালের ৭মার্চ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বীর বিক্রম সনদ প্রদান করা হয় এবং এককালীন বিশহাজার টাকা সম্মাননা দেওয়া হয়।
মোহাম্মদ সোলাইমান বীরপ্রতীক
মোহাম্মদ সোলাইমান ১৯৫৩ সালের ৫ আগষ্ট নাটোর জেলার সদর থানার কাপুরিয়াপট্টি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৃত আব্দুল হাই। তিনি ১৯৭০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কনস্টেবল পদে রংপুর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণ গ্রাহণের পর রংপুর জেলার নীলফামারী থানায় তার নিযুক্তি হয়; তার কনস্টেবল নং ১৬০০। তিনি ১৯৭১ সালে ২৫মার্চ নীলফামারি পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন।
২৬মার্চ তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন; নীলফামারি মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট এম শফিউজ্জামানের নির্দেশে জনগণ, আনসার, ইপিআর, প্রাক্তন সেনাসদস্যদের সাথে তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে পরাজিত হয়ে অস্ত্রসহ দিনাজপুরের পঞ্চগড় এলাকায় অবস্থান পরিবর্তন করেন। মোহাম্মদ সোলাইমান ইপিআর সৈনিক নূরুল আলমের নেতৃত্বে প্রাথমিকভাবে ০২টি এলএমজি, ২টি রাইফেল নিয়ে ভজনপুর এলকায় ক্যাম্প স্থাপন করেন; এরপর তিনি স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় তিনি বিপুল পরিমান অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জগদল, মীরগড়, ভেতরগড়, বধুগাঁ, হাড়িজশা, ময়নাকুড়ি এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ্য, জাবরীদুয়ার গ্রামে পাকবাহিনীর উপর অ্যামবুশে অংশগ্রহণ করে ১০জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেন। এই যুদ্ধ শেষে স্থান পরিবর্তনের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হলে তাকে শিলিগুড়ি আর্মি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সুস্থ হয়ে পুনরায় ৬ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন। সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার এম কে বাশার (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল এবং বিমানবাহিনীর প্রধান) এর নির্দেশে দেবনগড় সাবসেক্টরে নিযুক্ত হন। এরপর সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশীদ খানের নেতৃত্বে অত্র এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কারণে স্থানীয় রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা তার পিতা এবং ভাই শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতা, বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অসামান্য কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে “বীর প্রতীক” খেতাবে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধাহত হওয়ার কারণে তিনি স্বাধীনতার পর পুনরায় কর্র্মস্থলে যোগদান থেকে বিরত থাকেন।

তথ্যসূত্রঃ
* আরেফিন, এ এস এম সামছুল (সম্পা.) (২০১৭)। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা (১ম খন্ড)। ঢাকা: বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
* রহমান, মতিউর (সম্পা.) (২০১২)। একাত্তরের বীরযোদ্ধা (১ম ও ২য় খন্ড)। ঢাকা: প্রথমা
* একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা (২০১২)। ঢাকা: জনতা ব্যাংক লি:
পর্ব-০২ তে প্রকাশিত হবেঃ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা
লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
0 Comments