ই-পেপার

মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম

কিছুদিন আগে দিশেহারা এক মা তার মাদকসেবী ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক মনোরোগ  বিশেষজ্ঞের কাছে সাইকোথেরাপি নেওয়ার জন্য।কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটি বিদেশে যাবে পড়াশোনা করতে।মেডিক্যাল চেকআপের সময় জানা যায় যে, ছেলেটি নিয়মিত মাদক নেয়।স্বভাবতই ছেলেটি মাদক নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকে এবং সেশন নিতে অস্বীকৃতি জানায়।তবু ছেলেটির মা তাকে জোর করে সাইকিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যান।সেশন চলাকালে সাইকিয়াটিস্ট যখন ছেলেটির ছোটবেলার ইতিহাস জানতে শুরু করেন তখন তিনি জানতে পারেন যে, তার ড্রাগ নেওয়া শুরু হয় একটি ঘটনার পর থেকে।অষ্টম শ্রেণিতে সে নতুন একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয় এবং প্রথম দিনই সে শারীরিক ও মানসিকভাবে বুলিংয়ের শিকার হয়।সেদিন থেকেই সে স্কুলে যেতে ভয় পেত।বিষয়টি তার স্কুলের শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো রকম সমাধান না পেয়ে ধীরে ধীরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলেও স্কুলে না গিয়ে সে এলাকার ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত এবং তাদের কাছ থেকে প্রথমে গাঁজা খাওয়া শুরু করে।

আমাদের সমাজে বুলিং এবং এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা নেই বললেই চলে।হয়তো অনেকেই এই শব্দটা প্রথম শুনে থাকতে পারেন।সাইবার স্পেসে ঘটা মারাত্মক অপরাধ ‘‘সাইবার বুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে আরও কয়েকটি ঘটনার ওপর আলোকপাত করা যাক।

ঘটনা-১:

সামান্থা (ছদ্মনাম) পঞ্চম শ্রেণি থেকেই বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠানে ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। বর্তমানে সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সাবলীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য স্কুলের জনপ্রিয় মুখ সে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বন্ধুও অনেক। মেয়েদের গ্রুপের সক্রিয় সদস্য সামান্থা।একদিন এক আড্ডায় বন্ধুরা তাকে নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়।তার নামে ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলে চ্যাট করে চ্যাট হিস্ট্রির স্কিনশটও বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।স্কুলে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে সামান্থার জন্য।ইনবক্সে আসতে থাকে অশ্লীল সব বার্তা।মেয়েটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না মেসেজগুলো তার নয়।ঘর থেকে বের হওয়া ছেড়ে দেয় সামান্থা।শেষমেশ তার বাবা-মা তাকে নিয়ে ঐ শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।কী নির্মম অভিজ্ঞতা !!!

ঘটনা-২:

অনলাইনে একটি বুটিক চালান বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এক তরুনী।তাঁর বিক্রি দেখে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দি¦রা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন।শুরু হয় তাঁর নামে ভিন্ন ভিন্ন পেজ খুলে নানা রকম অফার ও মেসেজ করা।কখনো বাজে পণ্যও বিক্রি করা হয়।কখনো অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য দেওয়া হয় না।এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রভাব শুধু তাঁর উদ্যোগেই নয়, পারিবারিক জীবনেও পড়ে।মেয়েটি তাই আজ দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে।

ঘটনা-৩:

মোহনা (ছদ্মনাম) একজন ডিজিটাল বিপণনকর্মী ও ফ্রিল্যান্সার। তাঁর ফেইসবুক আইডি ডিজএবল (নিষ্ক্রিয়) করে দিয়ে মোহনার নামে ভুয়া আইডি ও পেজ খোলা হয় । তাঁর ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে তাঁকে বাজেভাবে উপস্থাপন করে কিছু অসাধু ব্যক্তি। এর জন্য তাঁকে নানা ধরনের বিপদের সম্মুখীনও হতে হচ্ছে।

এগুলো তো ক্ষুদ্র ঘটনা। এমন অনেক ঘটনাই প্রতিদিন ও প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের সমাজে। সম্মান হারাচ্ছে নির্দোষ মানুষ। ব্যবসায়িক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। একটা সময় ছিল যখন তাঁরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন না। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। এখন সাইবার বুলিজমে আক্রান্ত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা খুব সহজেই গ্রহণ করা যায়।

বুলিং কি?

সাধারণত বুলি (Bully) অর্থ উৎপীড়ক অথবা যে ব্যক্তি দুর্বলকে ভয় দেখানো বা পীড়ন করার জন্য বল প্রয়োগ করে অথবা বল প্রয়োগ বা ভয় দেখিয়ে কাউকে কিছু করতে বাধ্য করে।

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, বুলিং হলো অপ্রত্যাশিত এবং আক্রমণাত্মক আচরণ, যা স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায়। এ আচরণের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার অসামঞ্জস্য প্রকাশ পায়। এই আচরণ আক্রান্ত শিশু বা কিশোরের ওপর ক্রমাগত চলতে থাকে। তবে এ আচরণ সাধারণত স্কুলে যাওয়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেখা গেলেও যেকোনো বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যেও দেখা যেতে পারে। যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী বা অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেও এমন আচরণ দেখা যায়।

বুলিংয়ের সংজ্ঞা  থেকে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়, তা হল-

                বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তি  বুলিং আচরণকে মেনে নিতে পারে না।

                যে বুলি করছে এবং যে বুলির শিকার হচ্ছে, উভয়ই বুঝতে পারে এই ধরনের পরিস্থিতিতে বুলি করা ব্যক্তির ক্ষমতা        বেশি।যিনি বুলির শিকার হন তিনি বারবারই হতে থাকেন।

কিন্তু এইসংজ্ঞা হয়ত বুলি আচরণকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

ন্যাশনাল বুলিং প্রিভেনশন সেন্টারের মতে, কিছু বুলিং শারীরিকভাবে শনাক্ত করা গেলেও এটি কখনো কখনো নীরবে বা মানসিকভাবেও চলতে পারে।যেমন- কোন গুজব বা ইন্টারনেটে কোনো মিথ্যা কথা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বুলিং হওয়া ব্যক্তির মানসিকভাবে ক্ষতি করা।বুলিং আচরণের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো, এই আচরণের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিভিন্ন অবস্থানের ভিত্তিতে বুলিং হতে পারে।যেমন- শারীরিক বা মানসিক আঘাতের মাধ্যমে, অপমানের মাধ্যমে, কোনো তথ্যের মাধ্যমে, শারীরিক বা মানসিক হয়রানির মাধ্যমে।বুলিং হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে।যেমন- জাতিগত বৈষম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্য, শারীরিক বা যৌন হয়রানিমূলক কারণে বুলিংয়ের শিকার হতে পারে।

সাইবার বুলিং কি?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এখন নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন নেটিজেনরা।ফেইসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ট্যুইটার, ভাইবার, হোয়াটস্অ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে তারা সাইবার অপরাধীদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন।ইন্টারনেট যেমন আমাদের সব কাজকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, ঠিক তেমনি এর অপব্যবহারে হতে পারে নানান অপরাধ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘সাইবার বুলিং’। নারী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা এর প্রধান শিকার।

সাইবার বুলিং হচ্ছে কোনো শিশুকে অনলাইনে প্রলুব্ধ বা হেয়প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো এবং মানসিক নির্যাতন করা। শুরুতে কিশোর-কিশোরীরাই কেবল এ ধরনের কাজে জড়িত ছিল বলে বুলিংকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। পরে দেখা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রে স্বনামে বা ফেইক আইডির আড়ালে প্রাপ্তবয়স্ক অনেকেই এধরনের হীন কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘটলেও ফোনে কিংবা ই-মেইলেও অনেক সময় এধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে।

সাইবার বুলিংয়ের ধরনঃ

সাইবার বুলিং বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন-

                ইন্টারনেট চ্যাট রুমে অন্য ইউজারকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা।

                ইনস্যান্ট মেসেজিং এর সময় অনবরত বিরক্ত করা।

                ফেসবুক বা মাইস্পেস কিংবা এ ধরনের সাইট ইউজারদের পেজে অপমানজনক উক্তি করা।

                সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মিথ্যা গুজব ছড়ানো।

                নিজস্ব  ব্লগে অন্য কারো চরিত্রকে খারাপভাবে উপস্থাপন ।

                স্প্যাম ছড়ানো।

                ই-মেইল-এর মাধ্যমে হুমকি দেওয়া।

                অনবরত আরেকজনের সেল ফোন-এ কল করা।

                একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃত করে অনলাইনে তুলে ধরা।

সাইবার বুলিং এবং সাইবার-হ্যারাসমেন্ট বা সাইবার স্টকিং:

সাধারণত সাইবার বুলিং বলতে বোঝায় দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর বা টিনএজারের মাঝের কর্মকাণ্ডকে। কিন্তু যখন প্রাপ্তবয়স্ক কেউ এর সাথে যুক্ত হয় তখন তাকে আর সাইবার বুলিং বলা হয় না, বলা হয় সাইবার-হ্যারাসমেন্ট (Cyber-harassment ) বা সাইবার স্টকিং (Cyber staking) ।

কারা বুলিংয়ের শিকার হয়?

গত ৩০ আগস্ট, ২০২০ খ্রিঃ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া সরকারি  মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী রোকাইয়া রূপা।তামিম খান নামে এক বখাটে যুবক রোকাইয়াকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল।এতে রূপা রাজি না হওয়ায় তার ছবি ফটোশপের মাধ্যমে সম্পাদনা করে বিভিন্ন গ্রুপে দিয়ে ভাইরাল করা হয়।নিজের সেই আপত্তিকর ছবি দেখে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় মেয়েটি।

এ রকম ঘটনা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটে থাকে।ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার নিপীড়নের শিকার।বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার।এক হিসাবে দেখা যায় যে, দেশের প্রায় ৪৯ শতাংশ স্কুলপুড়য়া শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের নিয়মিত শিকার হচ্ছে।

কারা বুলিংয়ের শিকার হবে তা আগে থেকে অনুমান করা অনেকটাই অসম্ভব।তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা বুলিংয়ের শিকার হন তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।যেমন-

                এরা সাধারণত ভীতু, লাজুক, আত্মমুখী, কম আত্মবিশ্বাসী, অসুখী এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে থাকে।

                তাদের সাধারণত কোনো বড় নেটওয়ার্ক  বা খুব বেশি বন্ধুবান্ধব থাকে না।

                এসব মানুষ নিজের চেয়ে বয়সে বড়দের সঙ্গে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

                শারীরিকভাবে তারা ক্ষীণদেহের অধিকারী এবং দুর্বল প্রকৃতির হতে দেখা যায়।

                তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বুলিং হওয়ার হার বেশি (টিজিং বা ইমোশনাল আক্রমণাত্মক আচরণের মাধ্যমে)।

সাইবার বুলিংয়ের ফলে কি কি ক্ষতি হয়?

সাইবার বুলিংয়ে কোন সূত্র পাওয়া গেলে বা এ ধরনের ঘটনা একবার ঘটলে বিকৃত ও অসুস্থ মানসিকতার আরও অনেকের কাছে আক্রান্ত ব্যক্তির খোঁজ বা যোগাযোগের তথ্য চলে যায় বলে ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়তেই থাকে। যে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে এবং যে বুলিং আচরণ করছে উভয়ের পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।আমরা যদি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব বুলিংয়ের কারণে দীর্ঘমেয়াদি কিছু সমস্যা ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়, সেটা সামগ্রিকভাবে তাদের পরিবারও সমাজে নেতিবাচক  প্রভাব ফেলে।যখন কোনো শিশু বুলিংয়ের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করে, সে হৃদয়গতভাবে নিজেকে একা করে ফেলে। সে আরও বেশি চুপচাপ হয়ে নিজেকে নিয়ে থাকা শুরু করে এবং সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে সমস্যা হয়।ক্রমাগত বুলিংয়ের সম্মুখীন হতে থাকলে সে সমাজ থেকে নিজেকে আলাদা করতে থাকবে এবং একসময় সে তার নিজের জগতের মধ্যে ডুবে থাকবে। শিশু বা টিনএজার যারা এর শিকার হয় তারা মানসিক আঘাত পেতে পারে, যা তাদেরকে নিজের সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা কিংবা বিষণœ করে তুলে।এর ক্রমবর্ধমান চাপে শিশুর মাঝে হতাশা, লেখাপড়ার প্রতি অনীহা, ইনসম্নিয়া বা অনিদ্রা থেকে শুরু করে আত্মহত্যার প্রবনতা পর্যন্ত তৈরি হতে পারে।

যে বুলিং করছে

যে শিশু বা ব্যক্তি বুলিং করছে তারাও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা অন্যদের বুলিং করে, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীরা তাদের এড়িয়ে চলে, ভয় পেতে শুরু করে। সাধারণত একটি বড় দল বা নেটওয়ার্ক থাকলেও সত্যিকার অর্থে তাদের কোনো বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মী থাকে না, যার সঙ্গে তারা মিশতে পারে বা কথা বলতে পারে। তাদের মধ্যে কিছু আবেগজনিত সমস্যা দেখা যায়। তারা নিজেদের সব সময় শক্তিশালী বা ক্ষমতাধর মনে করতে পছন্দ করার ফলে সহজে অন্যের কাছে এমনকি কাছের মানুষের কাছেও তাদের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। তাদের মনের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে বা আবেগকে প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সময় আক্রমণাত্মক আচরণ করে ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বুলিং করা শিশু বা কিশোর বড় হয়ে বিভিন্ন মাদকে আসক্ত বা মদ্যপানের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে তাদেরকেস্কুল বা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া হয়। বুলিং আচরণকে অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা কিভাবে দেখে?               

যেসব শিশু বা কিশোর বুলিং আচরণকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করে, তখন বা পরবর্তী সময়ে তাদেরও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। বেশির ভাগ সময় তারা প্রতিবাদ করে না বা ঘটনাটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যেসব কারণে তারা এড়িয়ে যায় তা হল-

১. তারা ভয় পায় প্রতিবাদ করতে।তারা মনে করে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হবে না বা করলে তাদেরও বুলিং করা হবে।

২. তারা বিশ্বাস করে, এটা তাদের নিজেদের কোনো বিষয় নয়।

আমরা কীভাবে ভিকটিমকে সাহায্য করতে পারি?

অভিভাবক ও শিক্ষক উভয়কেই বুলিং ঘটনা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে।তারা এসব ঘটনাকে প্রশ্রয় দেবেন না, এই ধারণাটা ভিকটিম এবং বুলিং আচরণকারী উভয়ের মধ্যে থাকতে হবে।এমন একটা পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ভিকটিম নিজেকে অসহায় এবং একা মনে করবে না। অভিভাবক ও শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের পাশে আছেন, এই ধারণা নিশ্চিত করতে হবে।ছোট শিশুরা যখন বুলির শিকার হয়, তখন তাদের আত্মসম্মান এবং নিজের প্রতি ইতিবাচক ধারণা ভেঙে যায়।এই ক্ষতি থেকে উত্তরণ করতে ভিকটিমকে নিজস্ব শক্তিশালী এবং প্রতিবাদী সত্তা তৈরিতে সাহায্য করতে হবে, যাতে তার নিজের জীবনে কোনো বাঁধা-বিপত্তি এলে তা নিজেই মোকাবিলা করতে পারে।

নিরাপত্তার স্বার্থে ভিকটিমের করণীয়:

∙              প্রথমেই নিজেকে বোঝাতে হবে, এটি আপনার দোষ নয়।কেউ যদি আপনাকে খুব খারাপভাবে আক্রমণ করে তবে           এই নিষ্ঠুর আচরণের জন্য আপনি নিজেকে দোষী ভেবে কষ্ট পাবেন না।

∙              সাইবার বুলিংয়ে আক্রান্ত হলে কখনই আপনি সাড়া দেবেন না এবং নিজেও পাল্টা আক্রমণ করবেন না।

∙              আপনাকে বুলিং করা হয়েছে বা আপনি আক্রমণের শিকার হয়েছেন, এর সপক্ষে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ       করবেন।

∙              প্রাথমিকভাবে যে বা যার দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন এবং আপনার সপক্ষে যুক্তিগুলো গুছিয়ে জানাতে পারেন। আপনি না পারলে আপনার বন্ধু বা আত্মীয়কেও এই আলোচনাটুকু করতে     অনুরোধ করতে পারেন।

∙              বুলিংয়ের শিকার যেহেতু নারীরা বেশি হন এবং তারা তাদের সমস্যাগুলো এখনও পরিবারের সঙে শেয়ার করতে           স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, তাই বুলিংয়ের শিকার হলে অবশ্যই একজন বন্ধু, আত্মীয়, ভাই বা বোনকে জানাতে       হবে।

∙              সব সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টেই বøকের অপশন থাকে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও              অসংলগ্ন কথা বললে তাকে বøক করে দিতে পারেন।

∙              যদি বুলিং থেকে সেটি বড় ধরনের হুমকিতে পরিণত হয়, যা শারীরিক আক্রমন, জীবননাশের হুমকি বা বড়                ধরনের সম্মানহানির কারণ হতে পারে; সেই ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনের সাহায্যে নিতে হবে।

অভিভাবকদের জন্য করণীয়ঃ

∙              নিজের সন্তানদের প্রতি আস্থা হারাবেন না। আপনারাই তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসের আশ্রয়।

∙              সন্তানের প্রতি মনোযোগি হোন, তাদের কথাকে গুরুত্ব দিন, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।

∙              কোনো ঘটনা শুনেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। ইতিবাচক সমাধানে আসুন। পারস্পরিক          সুসম্পর্ক     ও আত্মসম্মান বজায় রাখুন ।

∙              যে কোনো ধরনের বুলিংয়ের শিকার হলে নিকটস্থ থানায় আইনি সেবার জন্য যোগাযোগ করুন।

       বুলিং আচরণটি কীভাবে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি?

       বুলিং আচরণটি আমাদের সমাজে ততটা গুরুত্ব পায় না। তবে এর কারণে ভিকটিম এবং বুলিং আচরণকারী উভয়ের জীবনেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যেটা অনেক সময় তাদের সারা জীবন বয়ে নিয়ে চলতে হয়। নিচের              ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করেও এই আচরণকে প্রতিরোধ করা যেতে পারেঃ

১.             ভিকটিমকে নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ভাবতে অভিভাবকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে                বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

২.             বুলিংয়ের শিকার ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ঘটনাকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

৩.            কোনো সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে এর প্রচার করা বন্ধ              করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

৪.             অনেক অভিভাবক মনে করেন যে, বাচ্চাদের ঝামেলা বাচ্চারাই মিটিয়ে ফেলবে। এই ভেবে বড়রা কোনো পদক্ষেপ           নিতে চান না। এই ধারণা থেকে ভিকটিম বাচ্চারা নিজেদের একা ও অসহায় মনে করে। তাই অভিভাবকদের এ                ব্যাপারে সরাসরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

৫.             আপনার শিশুর আচরণ লক্ষ করুন। সে হঠাৎ যদি চুপচাপ থাকে, মন খারাপ করে থাকে, একা একা থাকতে পছন্দ করে এবং স্কুলে যেতে অনীহা প্রকাশ করে তবে তাকে কারণ জিজ্ঞেস করুন।

৬.            বুলিং আচরণ করা শিশু বা কিশোরকে একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলতে সুযোগ করে দিতে             হবে। যাতে সে তার এই আচরণকে পরিত্যাগ করতে পারে।

আইনি সহায়তাঃ

সাইবার বুলিং প্রতিরোধে এ বিষয়ে মা-বাবার ধারণা থাকা, সন্তান ইন্টারনেটে (কম্পিউটার এবং মোবাইলে) কী করছে তা জানা খুবই জরুরি। তথ্যমতে, অনলাইনে যারা  হেনস্থার শিকার হন তাদের মধ্যে ২৬ শতাংশ ভিকটিম বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে অভিযোগ করে এবং বাকিরা সামাজিক ও লোক-লজ্জার ভয়ে বিষয়টি চেপে যায়। এসব অপরাধ দমনে আইন রয়েছে দেশে। দরকার শুধু সচেতনতা।

যদি বিষয়টি পারিবারিক গন্ডির বাইরে চলে যায় তবে আইনের আশ্রয় নিতেই হবে। এক্ষেত্রে পুলিশি ঝামেলা এড়িয়ে চললেই বরং বিপদ। আর তা আপনাকে বিপদেই পরিচালিত করবে। কিছু ধাপ অনুসরণ করলে এই কঠিন কাজই খুব সহজ হয়ে যায়। এর মধ্যে প্রথম কাজ হচ্ছে হয়রানির প্রমাণ হিসেবে স্ক্রীন শট কিংবা মেসেজ রেখে তা নিয়ে নিকটস্থ থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। সাইবার বুলিং কিংবা ভার্চ্যুয়াল হয়রানি ঠেকাতে বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই দু’টি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যার একটি  হলো পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এবং অপরটি ডিজিটাল নিরাপত্তা  আইন, ২০১৮। কাজেই সাইবার হয়রানির শিকার হলে অবশ্যই অবশ্যই আইনি সহায়তা গ্রহণ  করতে হবে।

শেষ কথাঃ

আমাদের একটি কথামনে রাখা প্রয়োজন, শিশুদের অনেক সময় নিজেদের কথা বলার জন্য কণ্ঠস্বর থাকে না বা তারা বুঝতে পারে না, তাদের সঙ্গে কী হচ্ছে- তখন আমাদের তাদের কণ্ঠস্বর হতে হবে। সাইবার বুলিং অতি জরুরি একটি সামাজিক সমস্যা, যা আমাদের সবার সচেতনতা এবং যুগোপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

  লেখক : উপ-পুলিশ কমিশনার

  ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ

  ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x