ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

শামস সাইদ

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, পারিবারিক জীবন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে বেগম মুজিব রেখেছেন ‘অনন্য ভূমিকা’। তিনি ইতিহাসের কোনো চরিত্র না। ছিলেন না রাজনৈতিক কোনো পদে। ছিলেন না রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে। তবু তিনি ছিলেন সর্বত্র। ইতিহাস তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। পারবে না। কারণ, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। বাংলাদেশের ইতিহাস কিংবা বঙ্গবন্ধুকে লিখতে গেলে বেগম মুজিবকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না।

ফজিলাতুন্নেছার জীবনে যেমন জড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু তেমনি বঙ্গবন্ধুর জীবনেও জুড়ে আছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন বেশ চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। সেই সময়ে বেগম মুজিবের ভূমিকা, বিচক্ষণতা, ত্যাগ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে স্ত্রীকে শুধু সহধর্মিনী নয়, পেয়েছিলেন সহযোদ্ধা ও সহকর্মী হিসেবেও। একজন মুক্তির মশাল জ্বালিয়ে জাতিকে মুক্ত করার চেষ্টায় ছুটছিলেন। অন্যজন সেই মশালে জ্বালানি সরবরাহ করেছেন। এভাবেই তাঁরা একে অপরের সম্পূরক/পরিপূরক হয়ে উঠলেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন নেতা। বজ্রকঠিন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। অন্তরালে থেকে সাহস, শক্তি এবং সব দুঃখ ও নির্যাতন বরণের ধৈর্য ও প্রেরণা জুগিয়েছেন মহয়সি এই নারী। যদি বেগম মুজিব আত্মসর্বস্ব হতেন, সংসারসর্বস্ব হতেন, ছেলেমেয়ে, স্বামী নিয়ে সুখে সংসার করতে চাইতেন, তাহলে শেখ মুজিবের পক্ষে সম্ভব বছরের পর বছর কারাগারে থাকা সম্ভব হতো কী-না তা প্রশ্ন সাপেক্ষে।

বঙ্গবন্ধু জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। মুক্ত হয়েও যে পরিবারের কাছে ফিরেছেন এমন নয়। তখন পুরো দেশ হয়ে উঠেছিল তাঁর পরিবার। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ছিল সেই পরিবারের সদস্য। তাই বেরিয়ে ছুটতেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কোনো সময়ই তাঁর মাথায় স্ত্রী-সন্তানের খাওয়া পড়ার চিন্তা ছিল না। সে চিন্তা থেকে তাঁকে মুক্ত করেছিলেন বেগম মুজিব। কখনো অভিযোগ তো করেনইনি, উল্টো সাহস জুগিয়েছেন। অর্থ দিয়েছেন। বেগম মুজিবের সেই ত্যাগের কথা, সংগ্রামের কথা বাঙালির অজানা নয়। বঙ্গবন্ধু যেন দুর্গের মতো, সেই দুর্গের কর্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা। স্বামীর মতোই কঠিন ও অনমনীয় ছিলেন তিনি। জীবনে অসহ দুঃখ ও ক্লেশ সহ্য করেছেন। ক্ষমতা কিংবা অর্থের মোহে কখনো আপস করেন নি। 

মুজিব-রেণুর দাম্পত্যজীবন ব্যতিক্রমী। পারিবারিক কারণে বাল্যবিয়ে হয়েছিল তাদের। সেকথা বঙ্গবন্ধুও লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে “আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের [১৯৩২/৩৩] হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পর ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড়ো ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’… আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।”

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম ছিল বন্ধুর পথে বিচরণের; বাড়ি ছিল তাঁর জন্য স্বল্পদিনের মুসাফিরখানা; কারাগারে কেটেছে তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। তাহলে বঙ্গবন্ধুর পরিবার চলতো কীভাবে? কে এতসব সামলাতো? আমাদের অনেকের জানা নেই ৩২ নম্বর বাড়ির ইতিহাস। ইট বহন করা থেকে শুরু করে সব কিছু দেখভাল করেছেন বঙ্গবন্ধুর ‘রেণু’। বঙ্গবন্ধু তখন কারগারে, না হয় দেশ-মানুষলগ্ন। বাড়িলগ্ন হতে পারেননি। সংসার সামলানো, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া আবার কখনো দল সামলানো, দলের নেতা-কর্মিদের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়ানো। সবটাই হাসিমুখে করেছেন বেগম মুজিব।

বঙ্গমাতা নিজেই বলেছেন সেসব কথা, কীভাবে ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করেছেন, ‘আমি চুবনি খাইয়া খাইয়া সাঁতার শিখছি, বাচ্চাদের এতটুকু বিলাসিতা শিখাই নাই।’ তাঁকে কখনও সুসজ্জিতা দেখা যায়নি; গ্রামের সাধারণ নারীর মতো ছিল তাঁর চলাফেরা। ছেলেমেয়েদেরকেও কখনও বিলাসপ্রবণ মনে হয়নি।

কারাজীবন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুশ্চিন্তায় না থাকলেও বেগম মুজিব ভাবতেন সময়টা কাজে লাগুক। শুয়ে-বসেই তো কাটাচ্ছে। নতুন বই নিয়ে যেতেন। কখনো বঙ্গবন্ধু বলতেন নতুন বইয়ের কথা। সেসব নিয়ে হাজির হতেন তিনি। নিঃসঙ্গ জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলো বই। একদিন বেগম মুজিব নিয়ে গেলেন চারটা খাতা। যা দেখে রীতিমতো বঙ্গবন্ধু অবাক। এসব দিয়ে কী করবেন!

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতে বঙ্গবন্ধুর তুলে ধরেছেন সেকথা, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।’ বঙ্গবন্ধুর লেখালেখির অনুপ্রেরণায় যে বেগম মুজিব সেটা আমরা দেখতে পাই। রাজনীতিবিদ-রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর পেছনে ষোলআনা অবদান না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর লেখক হয়ে ওঠার পেছনে ষোলআনা অবদান বেগম মুজিবের।

বেগম মুজিব রাজনীতি না করলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল তাঁর। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আন্দোলন কীভাবে করতে হবে, সেটা মায়ের কাছ থেকেই শেখা।’ প্রকাশ্যে নয়, আড়ালের রাজনীতিবিদ ছিলেন বঙ্গমাতা। স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত না থেকেও দেশে কী ঘটছে, জনগণ কী ভাবছে আর বলছে, তার খোঁজ-খবর রাখতেন। ৩২ নম্বরে খাটের ওপর বসে শুধু পান বানাতেন না। সারা দেশের রাজনীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কার্যক্রম সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন তিনি।

ছয়দফাভিত্তিক আন্দোলন নিয়ে বঙ্গবন্ধু দ্বিধান্বিত ছিলেন। বঙ্গমাতা পরামর্শ দিলেন, ‘আমি বলেছি, বুড়াদের নিয়ে আপনি এত ঘাবড়ান কেন? আপনার রয়েছে হাজার হাজার তরুণ কর্মী, ছাত্র, যুবক। তারা আপনার ডাক শুনলে হাসিমুখে আন্দোলনে ঝাঁপ দেবে।’

ঊনসত্তরে যখন গণ-অভ্যুত্থানে সারাদেশ উত্তাল তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি বঙ্গবন্ধু প্যারোলে আইয়ুব খানের সঙ্গে আলোচনা করতে যাবেন, এমন একটি প্রস্তাব দেওয়া হলো। আওয়ামী নেতারাও রাজি। বঙ্গবন্ধু দ্বিধাগ্রস্ত। তা দূর করলেন বেগম মুজিব। শেখ হাসিনাকে দিয়ে বার্তা পাঠালেন, ‘আপনি যদি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের গোলটেবিলে যান, তাহলে বত্রিশ নম্বরে আর ফিরবেন না। হাতে বটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন; কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে আসবেন না।’ বেগম মুজিবের কথা রাখলেন বঙ্গবন্ধু। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা।

৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। কিন্তু ভাষণের আগের সময় ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে কঠিনতম। সারাদেশ তাঁর দিকে তাকিয়ে। আওয়ামী নেতারা একমত ছিলেন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা সমীচীন হবে না; তবে পূর্বশর্ত ঘোষণা করে আন্দোলন চলমান রেখে ইয়াহিয়াকে চাপে রাখতে হবে। সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সামরিক জান্তা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে। আবার ছাত্রনেতাদের দাবি, স্বাধীনতা ঘোষণা করতেই হবে। মানসিক চাপের মধ্যে বঙ্গবন্ধু, দ্বিধা তো ছিলই। এই পরিস্থিতিতে কী বলতে হবে তা বলে দিলেন বেগম মুজিব। প্রশ্ন করলেন, আপনার মন কী চায়?

বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চাই। বঙ্গমাতা বললেন, আপনার মন এবং বিবেক যা চায়, আজ তাই করুন। ভয়ে পিছিয়ে যাবেন না। তাঁর শেষ কথা ছিল, মনে রাখবেন, আপনার পেছনে বন্দুক, সামনে জনতা। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেন দ্বিধা থেকে। ঠিক তাঁর মন যা বলতে চেয়েছে তাই বলেছিলেন সেদিন।

২৩ মার্চ ঘিরেও বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মতো উভয় সঙ্কটে পড়েছিলেন; সেদিন ৩২ নম্বর বাড়িসহ সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। আওয়ামী নেতারা ভিন্নমত পোষণ করলেন। তাদের কথা ছিল, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো মানে তাদের উসকানি দেওয়া, যা বঙ্গবন্ধুও করতে চাচ্ছিলেন না, কিন্তু ছাত্রনেতাদের চাপও সামলাতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গমাতা বললেন, ‘আপনি ছাত্রনেতাদের বলুন, আপনার হাতে পতাকা তুলে দিতে। আপনি সেই পতাকা ৩২ নম্বরে ওড়ান। কথা উঠলে বলতে পারবেন, আপনি ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।

স্বাধীনতা লাভের পরে রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যখনই সংকটে পড়েছেন সেখানে পথের সন্ধান দিয়েছেন বেগম মুজিব। ১৯৭৪ লাহোরে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ বৈঠক যাবেন কিনা বঙ্গবন্ধু দ্বিধায় ছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সম্মেলনে যেতে রাজি হন বঙ্গবন্ধু। এবার স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ালেন বেগম মুজিব। তাঁর দ্বিমতের সপক্ষে দুটো যুক্তি তুলে ধরলেন। বঙ্গবন্ধু লাহোরে গেলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভুট্টোকে ফিরতি সফরের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। ভুট্টো ঢাকায় এসে বাংলাদেশ-বিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ দৃঢ় করবে। পাকিস্তানে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় বঙ্গবন্ধুর দেখভাল করবে পাকিস্তান, যা বিপজ্জনক। এই সন্দেহ অমূলক ছিল না। ভুট্টো বাংলাদেশে এসে ঠিক সে কাজটি করেছিলেন, যার কথা বঙ্গমাতা আগেই বলে দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্য বেগম মুজিব ছিলেন শক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির বটবৃক্ষ; আর বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর ছায়াবৃক্ষ। তাই বঙ্গামাতা বা বঙ্গবন্ধুর রেণুকে বাদ দিয়ে বাংলার ইতিহাস পূর্ণতা পেতে পারে না।  আট আগস্ট বঙ্গবন্ধুর রেণুর শুধু জন্মদিনই নয়; ইতিহাসের নির্মম পরিহাস এই যে ১৫ আগস্ট বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সপরিবারে শাহাদাৎ বরণও করেন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x