আবিদা সুলতানা
২০২২ খ্রিষ্টাব্দ, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ। লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী থানার ওসির ফোনে জানতে পারলাম গণধর্ষণের একটা ঘটনা ঘটেছে। শুনে বললাম, ‘বলেন কি? গণধর্ষণ? কীভাবে জানতে পারলেন।’
ওসি-‘জি স্যার, ভিকটিম নিজেই থানায় এসেছে, এসে অভিযোগ দিয়েছে। আমরা এরমধ্যে দুজন আসামিকে গ্রেফতার করতে পেরেছি।’
বললাম ‘কতজন ছিল?’
ওসি- ‘ভিকটিম দুজনের কথা বলছে। তবে আরো একজন ছিল ঘটনার সময়, নাম রুবেল (ছদ্মনাম)। ভিকটিম বলছে সে তার পাশের বাড়ি সম্পর্কের ভাতিজা এবং সে ভিকটিমকে আসামিদের কাছ থেকে বাঁচিয়েছে।’
আমি- ‘কীভাবে গ্রেফতার করলেন?’
ওসি – ‘আসামিরা ঘটনা ঘটানোর পরে এলাকাতেই ছিল। ভিকটিম থানায় জানানোর সঙ্গে সঙ্গে টিম পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়।’
আমি-‘ঠিক আছে, ডাক্তারি পরীক্ষাসহ বাকি কাজ সম্পন্ন করেন।’
পরদিনই গণধর্ষণের পিওতে গেলাম। মূল পাকা রাস্তা থেকে সরু রাস্তা ধরে বেশ অনেকটা পথ যাওয়ার পর কাঁচা রাস্তা। বেশ কিছুদূর পথ হেঁটে ভিকটিমের বাড়ি মানে ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম। মোটামুটি অবস্থাপন্ন পরিবার বোঝা যায়। বেশ জায়গা নিয়ে চারদিকে চার চারটা ঘর, নিরাপত্তায় টিন দিয়ে ঘেরা সীমানা এবং প্রবেশগেটও রয়েছে বাড়িতে। বাড়ির উঠানে আমাদের বসার জন্য বেশ কয়েকটি চেয়ার দেওয়া আছে। বিভিন্ন বয়সি বেশ কয়েকজন নারীকে দেখলাম দাঁড়ানো। বোঝার চেষ্টা করছি ভিকটিম কে। একজন ভদ্রমহিলা সামনে এলেন, বললেন তিনি ভিকটিমের মা।
বললাম -‘আপনার মেয়ের সাথে কথা বলবো।’
মাথায় ঘোমটা দেওয়া, সালোয়ার-কামিজ পরিহিতা শ্যাম বর্ণের ডাগর চোখ আর মিষ্টি চেহারার ১৭-১৮ বছরের একটি মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। চেহারায় ক্লান্তি আর বিধ্বস্ততার ছাপ স্পষ্ট। তার উপর দিয়ে কঠিন ঝড় বয়ে গেছে সেটি সহজেই অনুমান করা যায়! তার নাম নিলীমা (ছদ্মনাম)। আমার সঙ্গের পুলিশের হাতে ক্যামেরা দেখে হঠাৎই মেয়েটি বলে বসল ‘আমি কোন ছবি তুলবো না।’ আমি সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বললাম- ‘আপনার সাথে আমি একাই কথা বলব, সমস্যা নেই। কেউ আপনার ছবি তুলবে না। আপনি কি আমাকে বলবেন কি হয়েছিল?’
আমাকে অবাক করে দিয়ে খুবই স্পষ্ট এবং শুদ্ধ ভাষায় মেয়েটি আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল।
নিলীমা -‘চলেন, যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে গিয়ে পুরো ঘটনা বলি।’
তাকে অনুসরণ করে বাইরে বের হয়ে এলাম। বাড়ির সামনে ফসল ফলানোর জন্য জমি চাষের কাজ চলছে। কিছু জমিতে এর মধ্যে ধানের চারা লাগানো হয়েছে, আর কিছু জমিতে চাষ দেয়া আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিলীমা আমাকে বলল, ‘এই জমিগুলো আমাদের, মানে আমার বাবার। আমার বাবা বাড়িতে থাকেন না, কাজের জন্য তিনি ঢাকা আছেন। আমরা চার বোন, আমার কোনো ভাই নেই। আমার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু আমি এখানেই থাকি আমার স্বামী চাকরি করে! আমি এই জমি চাষ করার জন্যই আসামিদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করেছিলাম। তারা আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী।
আসামি দুজন এবং আমার পাশের বাড়ির সম্পর্কের ওই ভাতিজা রুবেল (ছদ্মনাম) গত কয়েকদিন সারাদিন আমার এই জমি চাষের কাজ করেছে। আগামীকালকে আমার আরেকটা জমিতে চাষ দেওয়ার কথা ছিল। সে জমিতে সারারাত পানি যাবে, সকালে সার দিতে হবে। তো সেই সার কী পরিমাণ লাগবে, সে বিষয়ে কথা বলার জন্য সন্ধ্যা ৭টার দিকে রুবেল আমাকে ফোন দেয়। এবং বাইরে আসতে বলে। তার ফোনের টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় কথা শেষ করতে পারেনি। আমি কয়েকবার চেষ্টা করেও তার ফোনে সংযোগ না পেয়ে গেইটের বাইরে আসি। কিন্তু এসেও তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, ওই পাশের বাড়িটাই তাদের। তাই আমি ওদের বাড়িতে যাই। সেখানেও খুঁজে না পেয়ে যখন চলে আসি তখন দেখি সে আমার বাড়ির সামনে এই গাছটার নিচে বেঞ্চে বসে আছে। তখন আমি তার সঙ্গে জমিতে সার দেওয়া নিয়ে কথা বলি। রুবেল কথা বলতে বলতে একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং এখানে পানি চেক করতে থাকে। সে যখন পানিতে নামে আমি দাঁড়ানো ছিলাম। হঠাৎ আমাকে একজন মুখ চেপে ধরে আর একজন পায়ে ধরে জোরাজুরি করে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। আমার মুখে হাত দিয়ে চাপে রাখার কারণে শব্দ করতে পারছিলাম না। কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে গেলে আমি ভাবি যে হয়তো আমার ফোন নেওয়ার জন্য এরকম করছে। আমি তখন আমার ফোনটি ঢিল দিয়ে ছুড়ে ফেলি। ওরা আমাকে গালিগালাজ করতে থাকে এবং ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানে না পেরে আবার ওখান থেকে তুলে নিয়ে আর একটু দূরে বিলের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আমাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এরপর ওরা বলে, ‘ওকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার নাই, তাহলে আর সাক্ষী থাকবে না।’
এ সময় পাশের বাড়ির আমার সেই ভাতিজা রুবেল সেখানে আসে এবং আমাকে ওদের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। এবং বলে, ‘তোদের যা কাজ তা তো হয়েই গেছে, এখন ওকে ছেড়ে দে, ওকে জানে মারিস না’
ওরা বলে ‘না, তুইও আয়’।
তখন রুবেল বলে, ‘এটা কখনো সম্ভব না উনি আমার ফুফু। এরপরে ওরা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমাকে কোনোমতে রুবেল আমার বাড়িতে নিয়ে আসে। এদিকে আমার মা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে যায়। বাড়িতে এসে আমি উঠানে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। একটু সুস্থ হলে সারারাত চিন্তা করি আমি কি করবো। একবার ভাবি ট্রিপল নাইনে ফোন দিই, ফোন দিইও, কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারিনা। ভীষণ ভয় করতে থাকে। পরে আমার স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলি। সব বিষয় তাকে জানাই। তাকে বলি তুমি যদি আমাকে আর গ্রহণ নাও কর, তবুও আমার কিছু করার নাই, আমি পুলিশের কাছে যাব, মন ঠিক করেছি। আমার মনে হয় আমি যদি এর প্রতিকার না করি তবে এরকম করে আমাকে বারবার এই ঘটনার শিকার হতে হবে। তাই আমি খুব ভোরে এই বিল পাড়ি দিয়ে সোজা থানায় চলে যাই। আর থানায় গিয়ে অভিযোগ করি।’
আসামিরা নীলিমাকে সদম্ভে বলে, যদি এই ঘটনা সে কাউকে বলে তবে তাকে জানে মেরে ফেলবে। যখনই তাকে ডাকা হবে তখনই তাকে তাদের ডাকে সাড়া দিতে হবে।
নীলিমা আমাকে সম্পূর্ণ জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলো এবং প্রত্যেকটি ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল। তখনও সে তার প্রতিবেশী ভাতিজা রুবেলকে আসামি হিসেবে চিন্তা করতে পারেনি। আমিও তাকে সময় দিচ্ছিলাম। তাকে নিয়ে যখন সামনে এগিয়ে এলাম, ততক্ষণে তার বাড়ির সামনে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সাধারণত যারা উপস্থিত হন তাদের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু আজকে কথা বলতে মন চাইছিল না। নীলিমার কথা শুনে মনটা বিষাদে পূর্ণ হয়েছিলো। ভাবতে পারছিলাম না, এটা কিভাবে সম্ভব! এমন একটি কঠিন ঘৃণিত অপরাধ করেও কি নির্বিঘ্নে আসামিরা পরের দিন আবার জমিতে চাষ করতে এসেছে! যেন কিছুই হয়নি, কতটা দম্ভ! তারা ধরেই নিয়েছে তাদের কিছুই হবে না!
ওখান থেকে চলে আসতে চাচ্ছিলাম কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে। কিন্তু নীলিমার মা সামনে এসে আমার হাত ধরে বললেন, ‘এখন কেমন হবে? আসামিরা কি জামিন পেয়ে যাবে? ওরা বের হয়ে তো আমাদেরকে ক্ষতি করবে। এরই মধ্যে আমাদেরকে নানাভাবে ভয় দেখাচ্ছে।’ দেখলাম নীলিমার চোখেও শঙ্কা। তাই যারা উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের কাছে ডেকে কথা বললাম কিছুক্ষণ।
বললাম, ‘যিনি অপরাধ করেন তিনি ঘৃণিত, কিন্তু যার উপর অপরাধ হয় তিনি কোনোভাবেই ঘৃণিত হতে পারেন না। আপনার নিশ্চয়ই সে বিষয়টি বুঝেন। যদি কেউ অপরাধ করে তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার শাস্তি প্রাপ্য। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা অথবা তাকে সমর্থন দেয়াও অপরাধ। আপনারা দয়া করে এই ধরনের ঘৃণিত অপরাধকে সমর্থন করবেন না। এই পরিবারের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে বিষয়টি আপনারা সবাই মিলে নিশ্চিত করবেন।’
নীলিমার পরিবার এবং আরো উপস্থিত সবাইকে ভালোমতো বুঝিয়ে বললাম যদি কোনো সমস্যা হয় অথবা যদি কেউ কোনো ভয়-ভীতি দেখায় তাহলে তারা কি করতে পারেন, আমাদের কী কীভাবে জানাবেন ইত্যাদি।
পরদিন ফায়ারিং এ গিয়েছি রংপুর, এমন সময় এ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, মারুফার ফোন ‘স্যার, নীলিমার প্রতিবেশী ভাতিজা ওই রুবেল সেও তো আসামি। সে এই ঘটনার সাথে জড়িত।’
আমি- ‘কীভাবে বুঝতে পারলে?’
মারূফা- ‘স্যার, নীলিমার মোবাইল পনের সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। যেখানে ওর ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। এই মোবাইল ফোন টি রুবেলের হাতে ছিল। যখন নীলিমা ফোনটি ছুড়ে ফেলে দেয়, তখন রুবেল এই ফোনটি নিয়েছিল। কিছু সময় পর সে ঘটনাস্থলে আসে এবং ভিডিও করে।
বললাম -‘ভেরি গুড! তাহলে তো কোনো সমস্যা নাই, ওকে অ্যারেস্ট করো।’
ঘটনাটা মনে এত বেশি নাড়া দিলো যে এরপর কয়েকদিন অন্য কোনো কিছু নিয়ে আর ভাবতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এ ধরনের অপরাধ এভাবে হতে পারে। একজন সাহসী নীলিমার কারণে হয়তো এই ঘটনাটি আমাদের পর্যন্ত এসেছে, মামলা হয়েছে, আসামি ধরা পড়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এরকম ঘটনা যে আরও ঘটতে পারে এবং সাহসের অভাবে রিপোর্টেড না-ও হতে পারে, সেটা ভাবাটা অমূলক নয়।
লালমনিরহাট জেলার আদিতমারি থানার মামলা নং-০৪ তারিখ ০৮/০২/২০২২, ধারা-২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী ২০০৩) এর ৯(৩) ধারার মামলা।
লেখক : পুলিশ সুপার, লালমনিরহাট।