ই-পেপার

তানভীর সালেহীন ইমন পিপিএম

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে, মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে, দেশপ্রেমের দৃপ্ত শপথে চেতনার বহ্নিশিখা প্রজ¦লিত হয় সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের প্রাণে-প্রাণে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের সূচনা করেন বাঙালি পুলিশের অকুতোভয় বীর সদস্যগণ। রাজারবাগের পবিত্র মৃত্তিকা শহীদ পুলিশ সদস্যদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত, সিক্ত ও চির পবিত্র।

রাজারবাগসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ লাইনস্ থেকেই সূত্রপাত স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখ সমরের। বীর পুলিশ সদস্যগণ দেশমাতৃকার স্বাধীনতার তরে, উন্নতশিরে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন অকাতরে ও সগৌরবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, বীরত্বগাথা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস নিয়ে আমাদের এই সংখ্যা থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ধারাবাহিক পর্ব-

‘মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ

আত্মত্যাগ ও বীরত্বের অম্লান দেশাত্মবোধ’

(১ম পর্ব)

বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জনের ধারাবাহিকতায়, কালশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, বাঙালি পুলিশ সদস্যরা চেতনে-মননে-কৌশলে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনবদ্য অবদান রেখেছেন।

’৬৬ এর ছয় দফা, ’৬৯ এর গণ আন্দোলন, ’৭০ এর নির্বাচন ইতিহাসের প্রতিটি মাইলফলকে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা ছিলো। ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে গণ অভ্যুত্থানে পুলিশ সদস্যরা সভা সমাবেশ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা নেপথ্যে নিরন্তর ভূমিকা রেখেছেন। ৭০ এর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে সারাদেশে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের স্বাধীনতাকামী জনতার পক্ষে একাত্মতা ও সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিলো।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পক্ষে পুলিশের মনোভাব উৎকন্ঠিত করেছিলো পাকিস্তানি শাসকদের। জেনারেল রাও ফরমান আলী “How Pakistan Got Divied” গ্রন্থে তার লেখায় মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে পুলিশের প্রতি ক্ষোভের প্রতিফলন করেন নিম্নোক্তভাবে-

“পুলিশ প্রধান সবার আগে তার বাহিনীসহ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ কমান্ডের হাতে ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিলেন।” “গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ যোগ দিয়েছিলো আওয়ামীলীগ শিবিরে। পুলিশকে পুরোভাগে নিয়ে একটা ছায়া সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো।”

২৫ মার্চের পূর্বেই সারাদেশের আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের নীল নকশা ব্যর্থ হওয়া প্রসঙ্গে রাওফরমান আলী আরো বলেন, “পুলিশের সহযোগিতা ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মির পক্ষে তাদের চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।”

“পুলিশ রাত ১০ টার দিকে বিদ্রোহ করে এবং পুলিশ লাইনস্রে পাশের রাস্তা দিয়ে গমনরত আর্মির ওপর প্রথম গুলিবর্ষণ করে।”

১৯৭১ সালে পহেলা মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই বস্তুত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা বাঙালি পুলিশ সদস্যরা অনুসরণ করছিলেন। প্রতিদিনের সংবাদ ও ঘটনার প্রবাহচিত্র পর্যবেক্ষণ করে পুলিশ সদস্যরা সুযোগ বুঝে তা নিকটস্থ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে দিতেন। অনেকেই আগাম তথ্য সংগ্রহে স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তাদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতা না পাওয়ায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এক ধরনের অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলো।

মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তাঁর ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন “পাকিস্তান সরকার বুঝতে পেরেছিলো যে, ইপিআর এবং পুলিশ বাহিনী হইবে এ অঞ্চলের লোকের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রধান উৎস। এও পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক কার্যক্রমে ইপিআর এবং পুলিশ অস্ত্র ধরবে না।”

অসহযোগ আন্দোলনে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যহীন তার অভিযোগে তসলিম উদ্দিন আহমেদকে আইজিপি পদ থেকে সরিয়ে অবাঙালি মুজাফফর আহম্মেদ চৌধুরীকে আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

৭ই মার্চ জাতির পিতার জ্বালাময়ী শতাব্দী শ্রেষ্ঠ ভাষণে পুলিশ সদস্যরা স্বাধীনতার ও মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন তাঁর ভাষণে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ভার সম্পূর্ণভাবে পুলিশ এবং বাঙালি ইপিআর বাহিনীর নিকট হস্তান্তরের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই রাজারবাগসহ সারাদেশের পুলিশ লাইনস্গুলোতে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মুক্তিকামী জনতার সাথে একাত্মতা পোষণ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে নিজেরা প্রস্তুত ও জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্রে সামনে বাংলাদেশের পতাকাও উত্তোলন করা হয়েছিলো। ৭ই মার্চের ভাষণ রেডিওতে শোনা এবং মূল বার্তা সারাদেশ আপামর জনতার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা ছিলো অতুলনীয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানকারীদলের অধিনায়ক তদানীন্তন ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দীন আহমেদ বীরবিক্রম তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন- “৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের অমোঘ ডাক শুনতে না পাওয়ার বেদনাকে বুকে নিয়ে পূর্বাপর চিন্তার মাথায় লাথি মেরে ৮ মার্চ ঢাকায় পুলিশ কন্ট্রোলরুমে উপস্থিত হলাম। সেখানে ১৭ মার্চ পর্যন্ত অবস্থান করে সারা বাংলায় মুজিবের আঙ্গুলি হেলনে বাঙালির শোণিত শ্রাবণে প্রলয়ংকরী পাকিস্তান বিরোধী অগ্নুৎগার দেখলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে, ঝিনাইদহ ফিরে যাব। জনগণকে সংঘবদ্ধ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি নেব। ১৭ মার্চ ১৯৭১ ঝিনাইদহ ফিরে এলাম। ঝিনাইদহ ফিরে শুরু করলাম আনসার, মুজাহিদ ট্রেনিং এর নামে উৎসাহী যুবকদের ট্রেনিং। একই সাথে অন্যান্য বাঙালি অফিসার ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আপদকালীন অবস্থায় করণীয়, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনাও অব্যাহত ছিল।” ২২-২৩ মার্চ কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার শহীদ মুন্সী কবির উদ্দীন আহমেদের নির্দেশনায় শহীদ আর.আই এ বি এম আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র পুলিশ লাইনস্রে সামনের সড়কে ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ স্লোগানে রাইফেল হাতে “রোডমার্চ” করেন। অস্ত্রধারী বাঙালি পুলিশ সদস্যদের একাত্মতায় জনগণের মধ্যে আস্থা, আত্মবিশ^াস, উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এইভাবেই পুলিশ সদস্যরা বিশেষত চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, পাবনা, যশোর, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশ এবং জনতার মধ্যে গোপন বৈঠক ও সংযোগ স্থাপন করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ গোপন প্রস্তুতি নিতে গিয়ে প্রথমেই প্রতিবন্ধক হিসেবে পুলিশ বাহিনীকে চিহ্নিত করে এবং রাজারবাগ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে তাদের প্রথম টার্গেটের অন্তর্ভুক্ত করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ছিলো ৩৩,৯৯৫ জন। তন্মধ্যে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৪,০০০ এর অধিক পুলিশ সদস্য তাৎক্ষণিক পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে সবুজ শ্যামল কোমল মাতৃকার স্নেহ ধন্য সন্তানের বুক বুলেটে বুলেটে বিদীর্ণ আর ক্ষত-বিক্ষত হয় হায়েনাদের পৈশাচিক বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে। বিভীষিকাময় গণহত্যা আর দমন পীড়নের মাধ্যমে চিরতরে বাঙালির শত বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করতে সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজারবাগে অকুতোভয় পুলিশ সদস্যদের বীরত্বপূর্ণ দুঃসাহসী তেজোদীপ্ত প্রতিরোধ ও প্রত্যয়ে প্রজ¦লিত হয় চেতনার বহ্নি শিখা, একই সাথে সেখান থেকেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা।

(চলবে)

  লেখক : অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x