ফারিয়া আফরোজ
বিরাট এক ধনী লোক জনসম্মুখে মস্ত এক থালাভর্তি করে প্রচুর সুখাদ্য সাজিয়ে লোভাতুর ভঙ্গিতে গোগ্রাসে উদরপূর্তির করছে আর সেই দৃশ্য অশ্রুসজল, করুণ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তার চারপাশ ভর্তি করা অসংখ্য দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষ।
জমিদার বাড়ি হোক, রাজপ্রাসাদ হোক কিংবা হোক তা তাজমহলের মতো সমাধিসৌধ। এই ধরনের বিলাসী কোনো স্থাপনা দেখলেই কেন জানিনা এর সৌন্দর্য, পেছনের ইতিহাস, গঠনশৈলী সব কিছু ছাপিয়ে সবার প্রথমে আমার মনের মধ্যে এরকম একটা দৃশ্যই আসন গেড়ে বসে।
বিরাট কোনো এলাকার আশেপাশে কোনো পুরাতন একটা সাধারণ একতলা বাড়ি পর্যন্ত নেই অথচ সেখানেই গড়ে উঠেছে বিরাট এক স্থাপনা এই ব্যাপারটা ভাবতেই কল্পনার চোখে ছবির মতো একে একে ভাসতে থাকে সারা পৃথিবীব্যাপী অনাদিকাল ধরে বয়ে চলা মানুষের চিরকালীন বৈষম্য, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং শোষণের অমানবিক নিষ্ঠুর গল্পগুলো।
মহেড়া জমিদার বাড়িতে প্রথম যেদিন পা রেখেছিলাম সেদিনও আমি এই ভাবনার বাইরে যেতে পারিনি। বেশ কিছুদিন হলো এবার এখানে থাকছি। এত দীর্ঘসময় এখানে অবস্থান করার সুযোগ পাওয়ায় ইচ্ছে হলো এর পেছনের ইতিহাসের দিকে একটু ঘুরে তাকাই।
একশত বছরেরও বেশি সময় (১৮৯০) আগে কলকাতায় এক সাহা পরিবার ডাল আর লবন ব্যবসা করে ব্যাপক লাভবান হয়ে উঠছিলো। এই পরিবারের মধ্যে মূলত দুই ভাই কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা টাঙ্গাইলের মহেড়াতে তাদের বসবাসের জন্য নির্মাণ করেছিলেন স্পেনের করদোভা নগরীর স্থাপত্যের সাথে মিল রেখে এই বিশালাকার স্থাপনা।
বাসস্থান স্থাপনের পর এই ভবনের মালিক দুই ভাই গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষদেরকে উচ্চ সুদে টাকা ধার দিতে লাগলেন। বহু দরিদ্র মানুষ সেই ধার করা অর্থ সুদ সমেত ফেরত দিতে পারলেন না। ফলস্বরূপ তাদের বাড়ি ঘর, জমিজমাসহ নিজেদের সর্বস্ব যখন নিলামে তোলা হলো তখন সে হতভাগাদের জীবনে যাই ঘটুক না কেন কালীচরণ আর আনন্দ তা নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়ে এই পরিবারের অর্থ ফুলে ফেপে বাড়িয়ে তুলেছিলেন বহু গুনে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবে বাংলার জমিদারি তখন একশ্রেণির ব্যবসায়ী, বণিক, টাকাওয়ালা লোকদের হাতে চলে আসতে শুরু করেছে। মহেড়ার ব্যবসায়ী এই সাহা পরিবারের হাতে তখন প্রচুর অর্থ। অর্থের বিনিময়ে তারা ২৪ পরগনার করটিয়া জমিদারের কাছ থেকে জমিদারির একটা অংশ কিনে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিনেও ফেললেন। এতদিন তাদের ছিলো সাহা পদবি যা মূলত ব্যবসায়ী বা বণিক শ্রেণিকে নির্দেশ করত, জমিদার হবার পর সেই সাহা পদবি বদলে পেয়ে গেলেন সম্মানসূচক রায় চৌধুরী পদবি।
কালীচরণ সাহা এবং আনন্দ সাহা, যাদের মাধ্যমে এই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন হয়েছে তারা অত্যাচারী ছিলেন সন্দেহ নেই তবে তাদেরই উত্তরসূরিদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু এবং প্রজা বৎসল। গ্রামবাসীর জন্য রাস্তাঘাট, স্কুল তৈরি করলেন, পানীয় জলের কষ্ট দূর করার জন্যও খনন করলেন বিরাট এক পুকুর। এই রকম জনকল্যাণমুখী কাজের জন্য মহেড়া জমিদারদের মধ্যে যার নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তিনি হলেন রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী এবং গিরেন্দ্রকুমার রায় চৌধুরী।
প্রাচুর্য, আধিপত্য যখন তুঙ্গে দেশে শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানি মিলিটারি গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার তো করলোই এ বাড়িটিও বাদ পড়লো না। বাড়িটির অনেকাংশকে তারা ক্ষতিগ্রস্ত করলো সেই সাথে জমিদার বাড়ির কূলবধূ যোগমায়াসহ গ্রামের আরো কিছু বিশিষ্ট লোককে এ বাড়ির পেছনের মন্দিরের সামনে অত্যন্ত নির্মমতার সাথে গুলি করে মেরে ফেললো তারা।
যে গ্রামবাসীর জন্য এত কিছু করা হলো সেই গ্রামবাসীই কিনা পাকিস্তানি সেনা বাহিনীকে এই নির্মম কাজে সহায়তা করেছিলো এই বিষয়টিতে প্রচ- মানসিক আঘাত পেলেন জমিদাররা।
প্রাণভয়ে হোক কিংবা ক্ষোভে, অভিমানে, দুঃখেই হোক শত বছরের পুরাতন পিতৃপুরুষের আবাসভূমির এই প্রাসাদসম চারটি সুরম্য অট্টালিকা, রানি ভবন, কাচারি ভবন, গোমস্তা ভবনসহ অঢেল সম্পদের এই প্রাচুর্যকে রাতারাতি তারা ছেড়ে চলে গেলেন এবং সে চলে যাওয়া তাদের জন্য নিশ্চয়ই খুব সহজ ছিলো না।
তাদের সেই প্রস্থানের পর খালি পড়ে থাকা বাড়িটিতে আসেন স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার বায়েজিদ সাহেব। এক প্লাটুন মুক্তিবাহিনী নিয়ে এই বাড়িটিকে তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন একটি সফল মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুল মান্নানের পরিকল্পনায় যুদ্ধকালীন ক্ষতিগ্রস্ত এই জমিদার বাড়িটিকে সংস্কার করে পরিণত করা হয়েছে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে। আনন্দ লজকে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই ট্রেনিং সেন্টারের একাডেমিক ভবন হিসেবে।
প্রতাপশালী জমিদারেরা চলে গেলেন তবে এই অদ্ভুত সুন্দর স্থাপনা, পুকুর, বাগান এবং ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য বিলাস উপকরণে রেখে গেলেন তাদের বুকের গহীন থেকে উৎসরিত হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস আর আস্ফ্লান। মিশনের প্রিডিপ্লয়মেন্ট ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে যতদিন আমি পিটিসিতে ছিলাম ততদিনে যতবার আমি এই জমিদার বাড়ির আনাচ কানাচ ঘুরে বেড়িয়েছি প্রতিবারই আমি যেন তাদের সেই হাহাকারের প্রতিধ্বনিটিই শুনতে পেয়েছি।
সত্যিই পৃথিবী বড় আজব জায়গা। এই যে সারা দুনিয়াব্যাপী কত শত প্রাসাদ, প্রাচুর্যে ভরা স্থাপনা, বিলাসী জীবনের চূড়ান্ত সব নিদর্শন এর কোনোটাতেই কোনো সম্রাট, রাজা বা জমিদার স্থায়ী হতে পারেনি। যে যত যত প্রতাপশালী আর শৌর্যশালীই হোক না কেন সবাইকেই একদিন সব কিছু ফেলে এক অনন্ত মহাশূন্যে খুব অনিশ্চিত এক পথে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে। সে অর্থে এই সমগ্র পৃথিবীকেই যদি বলি এক মস্ত ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ তাহলে খুব কি ভুল কিছু বলা হবে?
জীবনের এই নিঠুর সত্যটাকে অনুধাবন করেই বোধকরি হাছন রাজা তার জমিদারিত্বকে ছেড়ে ছুড়ে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন এক আধ্যাত্মিকতার জীবন।
দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী নামক এক প্রতাপশালী জমিদারের এই পুত্রটি এক লাখ একর জমির মালিকানাকে তুচ্ছ করে বসবাস শুরু করেছিলেন এক কুঁড়েঘরে। করুণ সুরে গেয়ে উঠেছিলেন,
লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ি ভালা না আমার।
কি ঘর বানাইমু আমি শূন্য ই মাজারে!
লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ঢাকা
বর্তমানে কংগো মিশনে কর্মরত