ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

জহিরুল হক শামীম

‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে-রে- আমি আর বাইতে পারলাম না’- অবসন্ন দেহ ও মন নিয়ে যখন কেউ এই দু-লাইন গেয়ে উঠে, তখন স্বভাবতই তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ, আমাদের হাত-পা কেটে গেলে বা ছড়ে  গেলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। কিন্তু আমাদের মনটা যখন বিষণ্ন হয়ে পড়ে; মন মাঝি যখন জীবন তরী বাইতে চায় না; তখন আমরা কার কাছে যাব? কি করবো এ প্রশ্ন ইদানীং বড়ো হয়ে উঠছে। কেননা বাংলাদেশে মানসিক রোগী বাড়ছে। আক্রান্তের মধ্যে তরুণের সংখ্যাই বেশি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উদ্বেগাধিক্যতে ৮ দশমিক ৪, বিষণ্ন তার চূড়ান্ত পর্যায়ে ৪ দশমিক ৬, গুরুতর মানসিক রোগে ১ দশমিক ১ এবং মাদকাসক্তিতে শূন্য দশমিক ৬ ভাগ লোক ভুগছেন। এসব কারণে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ক্রমেই বেড়ে চলেছে রোগীর সংখ্যা। তবে জনবল সংকটে রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মানসিক রোগী বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরাও। হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে শুধু বহির্বিভাগেই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ২৭০ জনের। এ ছাড়া ইনডোরে ভর্তি হয়েছেন ২৪৮ জন; যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। করোনা সংক্রমণে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও থেমে নেই রোগী ভর্তি। করোনা পরিস্থিতি মানুষের মনঃস্বাস্থ্যে ফেলছে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অপর এক পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ১৬ দশমিক ১ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছেন।

এদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্তের হার আরও বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪ ভাগই মানসিক রোগে আক্রান্ত। এছাড়া এ বয়সী শিশুদের ৩ দশমিক ৮ ভাগ মানসিক প্রতিবন্ধী, ২ ভাগ মৃগিরোগে আক্রান্ত এবং শূন্য দশমিক ৮ ভাগ মাদকাসক্ত।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ বুলেটিন, ২০১৮-এর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়সীর মধ্যে ১৬ দশমিক ১ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছেন। আর ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরের ১৮ দশমিক ৪ ভাগই মানসিক রোগে আক্রান্ত। অন্যদিকে ২০০৯ সালে হওয়া সর্বশেষ জাতীয় সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী প্রতি পাঁচজনের মধ্যে অন্তত একজন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।

এপ্রিল, ২০২১-এ ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, করোনা থেকে সেরে ওঠার প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই প্রতি তিনজনে একজনের মধ্যে এমন মানসিক সমস্যা দেখা গেছে, যার চিকিৎসা প্রয়োজন। কোভিডকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর প্রায় ৩৩ শতাংশের মধ্যে অ্যাংজাইটি আর ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষণœতার লক্ষণ পাওয়া গেছে। তবে শুধু করোনার কারণে নয়, দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে এই চিকিৎসক বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার না শিখেই মানুষ তা ব্যবহার শুরু করেছে। তাই নেট এটিকেট বা অনলাইন এটিকেটের সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় নেই। এ ছাড়া মানুষের রুচির বৈকল্য প্রবল হচ্ছে। এগুলোর প্রতিফলন ঘটছে সমাজজীবনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে করে বিষণœতা ও অবসাদে ভোগা এসব রোগীর অনেকে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। জড়িয়ে পড়ছেন মাদক, ধর্ষণ, জঙ্গিবাদসহ নানা অপরাধে। করোনাকালে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে মানসিক রোগী বাড়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে এ কারণগুলো।

দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়লেও। বাড়েনি চিকিৎসা সেবার পরিধি। প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন শূন্য দশমিক ৫০ জন। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এ দেশে মানসিক রোগীর জন্য ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল ছিল। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে দেশে মানসিক রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে ২০০ শয্যার একটি হাসপাতাল। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, আর মানসিক রোগী বেড়েছে জ্যামিতিক হারে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে বর্তমানে প্রতি পাঁচ জনে একজন কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে আক্রান্ত। অথচ রোগীপ্রতি বরাদ্দ মাত্র ৪৪ পয়সা। এক সময় মাদক সেবন মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত হতো না। এখন এটি জটিল মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের বড় আটটি মেডিকেল কলেজে মানসিক রোগ বিভাগে কোনো অধ্যাপকের পদ নেই। বছরে ১২ থেকে ১৫ জন করে মানসিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ তৈরি হলেও তাদের পদায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি শূন্য পদের বিপরীতেও নিয়োগ হচ্ছে না।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য চিকিৎসক আছেন শূন্য দশমিক ৫০ জন। এর মধ্যে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) ২২০ জন। অর্থাৎ প্রতি লাখ মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ১৩ জন। একইভাবে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ৫০ জন- অর্থাৎ প্রতি লাখ মানুষের জন্য শূন্য দশমিক শূন্য তিনজন। সাইকিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কার রয়েছেন মাত্র সাত, অকুপেশনাল থ্যারাপিস্ট মাত্র তিন জন।

উল্লেখ্য, মানসিক চিকিৎসক তৈরিতে প্রথম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ‘ওটিএইচএম’ শীর্ষক এ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে দেশের প্রথম মেন্টাল হেলথবিষয়ক ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ তৈরিতে এমডি ও এমএস কোর্স পরিচালিত হচ্ছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি এক লাখ মানুষে ছয়জন আত্মহত্যা করছেন মানসিক সমস্যার কারণে। মানসিক রোগের কারণে এখন সন্তানের হাতে বাবা-মা আর বাবা-মার হাতে সন্তান খুনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। খুন, ধর্ষণ বাড়ছে। অবসাদে ভোগা এসব রোগী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো অবসাদগ্রস্ত এসব তরুণকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে সহজে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ফেলছে। চিকিৎসকরা বলছেন, কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে তার আচরণে নানা পরিবর্তন আসে। সারাক্ষণ মন খারাপ থাকা, কোনো কাজে উৎসাহ না পাওয়া, খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া, পড়াশোনায় অনাগ্রহ, নিজের যতœ নিতে ইচ্ছা না করা, প্রচুর সাইবার আসক্তির রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তারা মোবাইলে, ল্যাপটপে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, গেম, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। কত বছর বয়সে একটা বাচ্চার হাতে মোবাইল দেওয়া হবে তার কোনো গাইডলাইন নেই। বড়রা হয়তো দেখছেন শিশুটি গেম খেলছে, কিন্তু সে নিজের অজান্তেই এমন একটা আসক্তিতে ঢুকে পড়ছে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সুতরাং বাংলাদেশের জনসম্পদকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে, মানসিক সমস্যার এ বিষয়টিকে কোনোভাবেই হেলা ফেলা করা যাবে না। বরং মানসিক চিকিৎসক ও হাসপাতাল যতোদিন বাড়ানো না যায়, ততোদিন বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে বেড সংখ্যা বাড়ানো এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x