আল আসাদ মো: মাহফুজুল ইসলাম
১. বিভ্রান্তির বেড়াজাল
মানুষ নিয়ে সমাজ নাকি সমাজ নিয়ে মানুষ- এই প্রশ্নটি করেছিলাম আমার বন্ধুকে। প্রত্যুৎপন্নমতি বন্ধুর সহসা উত্তর দুটোই একে অপরের পরিপূরক ও সম্পূরক। আসলে কি তাই? যেখানে মানুষ নেই, সেখানে কি সমাজ আছে? এন্টার্কটিকা কি আদৌ কোনো সমাজ? আমার মনে হয়, না। কারণ সেখানে কোনো মানুষ বাস করেনা। তাহলে মানুষই সমাজের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ। মানুষের জন্যই, মানুষকে নিয়েই সমাজ। কিন্তু দিনে দিনে সমাজ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, মানুষের চেয়েও অধিকতর। সমাজ কি বলবে- এই চিন্তায় মধ্যবিত্ত আজ পারিতোষিক মানুষে পরিণত হয়েছে। এর কারণ কতিপয় বিভ্রান্তিবোধ এই কথিত সমাজ মধ্যবিত্ত মানুষকে শেখায়, যা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বিভ্রান্তি এক : অর্থই অনর্থের মূল- আমাদের ছোটবেলার ভাবসম্প্রসারণের এক অনবদ্য বিষয়- যা আদতেই সঠিক নয়। Rich Dad, Poor Dad বইটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, এই একবিংশ শতাব্দীতে আপনাকে অবশ্যই অর্থ উপার্জন করা জানতে হবে। স্রষ্টা প্রদত্ত অনুসঙ্গ ছাড়া, আসলে আর কোনোকিছুই ফ্রি নয়। আপনাকে সুন্দর সাবলীল জীবনের জন্য অবশ্যই অর্থ উপার্জন করা শিখতে হবে। ধর্মীয় প্রেক্ষাপটেও যদি দেখি, তবে দেখবো, অনেক নবী-রাসুলও আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়েছেন। দেশীয় প্রেক্ষাপটে, এই যে আমাদের এত পঠনপাঠন, দিনশেষে, অর্থ উপার্জন করে সুন্দর জীবন কাটানোই লক্ষ্য। তবে, আয়ব্যয়ের সঠিক প্রথা-পদ্ধতি জানাটা জরুরি।
বিভ্রান্তি দুই : পরিশ্রমই সফলতার চাবিকাঠি- কথাটি উদ্ভাবন ও উন্নয়নের এই যুগে একটি উনসত্য। বাপ-চাচাদের অনেকেই দেখেছি কঠোর পরিশ্রম করতে, কিন্তু প্রত্যাশিত ভাগ্যন্নয়ন হয়নি। আবার অনেকেই কম পরিশ্রম করে সঠিকভাবেই ভাগ্য সুপ্রসন্ন করেছেন। আক্ষরিক অর্থে কে বেশি পরিশ্রমী : রিকশাচালক না উদ্যোক্তা? শুধু পরিশ্রম নয়, দরকার পরিকল্পনা, পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা, দূরদৃষ্টি, কৌশল, স্বাপ্নিক ও আভিযানিক অভিপ্রায়। জীবনকে সফলতার মাপকাঠিতে পর্যবেক্ষণ করাও যথার্থ নয়, ব্যর্থতাই জীবন। মানতে হবে James Altucher এর কথা “Life is a series of failures punctuated by brief successes.”
বিভ্রান্তি তিন : জ্ঞানই শক্তি- একটি প্রচলিত ফ্যালাসি। শুধু জ্ঞান দিয়ে কিছুই হবে না, যতক্ষণ না এর কার্যকারিতা বাস্তব জীবনে প্রায়োগিক হয়। জ্ঞান অর্জন যাপিত জীবনকে যখন আলোকময় করে, তখনই এটি সত্যিকার রূপ পায়। কোন নবী-ঋষীরা জ্ঞান অর্জন করে বসে থাকেন নি, প্রয়োগ করেই মাত্র ক্ষান্ত হয়েছেন। জ্ঞানই শক্তি নয়, এর যথাযথ প্রয়োগই শক্তি। Michael Phelps বিশ্বের সবসময়ের সেরা সুইমার `How to Swim’ নামক কোন Essay পড়ে শিখেন নি। `How to Swim’ Essay পড়ে অর্জিত জ্ঞান Unactioned Information, not Power. সে কারণেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অর্জিত জ্ঞান অনেক থাকলেও প্রায়োগিক দিক না থাকায় আমরা পিছিয়ে পঢ়ছি।
দীর্ঘদিনের গতানুগতিক প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়, সমাজের দোহাই দিয়ে তা হয়নি। সমাজ নয়, মানুষই হোক সমাজের নিয়ন্তা।
২. প্রেম-সংসার-পরকীয়া-বিচ্ছেদ-বহুবিবাহ-হত্যা-মামলা
আমেরিকান কবি Muriel Rukezser মনের কথা বলেছেন `The Universe is made of stories, not of atoms.’ তেমনই প্রতিজন মানুষের জীবন শত সহস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পে ভরা, একেকটি গল্প একেক রকম, এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে সহস্রাধিক সময়ে কার গল্পের সঙ্গেই কার গল্পের, কোনো গল্পের সাথে কোনো গল্পের মিল নেই। তেমনি একটি গল্প ‘খুকু-মুনির-রীমা’ একসময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। সেই সময়ে গণমানুষের দাবি ছিল মুনিরের যেন ফাঁসি হয়, যাতে এই দেশে এরকম ঘটনা আর না ঘটে। মুনিরের ফাঁসি হয়েছে, খুকু হারিয়ে গেছে, রীমা তো হত্যাই হলো। তিনটি জীবন গেল। প্রত্যাশা অনুযায়ী বিচার হলো।
কিন্তু এরকম ঘটনা কি কমেছে? সুষ্ঠু বিচার করলেই কি সেই অপরাধ কমে? গুগলে সার্চ করলেই দেখবেন, 5X বা তারও চেয়ে বেশি গুণ প্রেম পরকীয়া হত্যা বেড়েছে। মিডিয়া ফোকাস কমেছে কিন্তু এরকম অপরাধ/ঘটনা রেড়েছে।
নিঃসন্দেহে হত্যা একটি অমানবিক, অধর্মীয়, জঘন্য অপরাধ, বে-আইনি কাজ। হাভার্ড Professor Michael Sandal এই সময়ের সবচেয়ে নামকরা দার্শনিক ও আইনের শিক্ষক। তার কোর্স Justice যেটি MOOC Platform edx এ সকলের জন্য উন্মুক্ত। ক্রিয়েটিভ থিংকিং এর অতুলনীয় এই কোর্স সমাজ-সময়-আইনের আলোকে Jeremz Bentham, John Stuart Mill, Immanuel Kant, Professor John Rawls এর পাঠের প্রেক্ষাপটে ‘What is right thing to do’ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। সেই ধারণা থেকেই আমার নিউরনে খুকু-মুনির-রীমার এই ত্রয়ী ঘটনায় বিকল্পগুলো কী কী হতে পারতো এই প্রশ্নের উদ্রেক হয় :
এক. মুনির ও রীমা উভয়েই একে অপরের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারত, যেখানে স্বামি-স্ত্রী একে অপরের পরিচ্ছদ ও চক্ষুশীতলকারী হতো (Clothes and comfort of ezes of one another)।
দুই : উভয়েই ডিভোর্সে যেতে পারতেন, যা আইনি, নৈতিক ও ধর্মীয়।
তিন : মুনির খুকুকে বিয়ে করতে পারতো, রীমাও মেনে নিতে পারত।
মুনির এই বিকল্পগুলোর কোনোটিই হাতে না নিয়ে কেন হত্যার পথটি বেছে নিল? মুনিরের বিচারিক ফাঁসির পরেও কেন এখনো অধিকসংখ্যক মানুষ এই জীবনবিধ্বংসী পথটি বেছে নিচ্ছে? কেন বৈধ বিকল্পগুলো আমরা বেছে নিচ্ছি না? কেন আইনসম্মত, সুবিবেচিত জীবনবিজয়ী পথগুলো বেছে নিচ্ছি না?
১. পরিবার যদি পরিপূর্ণ হয়, তবে হয়ত মানুষ পরকীয়ায় জড়াতোনা। সুখী দাম্পত্য কোনো কবিরাজি বিষয় নয়, প্রতিক্ষণে অনুক্ষণে নিবিড় পরিচর্চার অনুভূতি। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই সবকিছুই টেকেন ফর গ্রান্টেড নয়। এসবের অভাব হলেই প্রশ্ন আসে অন্যটির।
২. যদি এমনটি না হয়, তবে মামলা হামলা, খুন-খারাপি, আইন-আদালতের চেয়ে ডিভোর্স উত্তম নয় কি? ব্যক্তিগত সুখ-শান্তির জন্যই সংসার, সমাজের জন্য নয়। সমাজের জন্য কোনো রকম সংসার টিকিয়ে রাখা সংসার সবার জন্য, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য, হতে পারে পীড়াদায়ক, প্যারাদায়ক।
৩. বিবাহবহির্ভূত প্রেম কিংবা পরকীয়া ত্রিমাত্রিক এই সংকটেও কি কার মৃত্যু কাম্য হতে পারে? একান্তই নয়। সম্ভাব্য সমাধান কি দুই বিয়ে বা ডিভোর্স হতে পারে?
আমার এক বন্ধুর পরামর্শে It’s Complicated মুভিটা দেখলাম। নিঃসন্দেহ এইসব বিষয় অনেক জটিল, প্রেমের কারণে হত্যা, পরকীয়ার কারণে বলি- এটা মুভিতেও নেই, উন্নত বিশ্বে অনেক কম। এই উপমহাদেশে এইসব প্রেম-পরকীয়া-বিয়ে-হত্যা-খুনজনিত অধিকসংখ্যক মামলার পরিসংখ্যানই বলে দেয়, কেউ সুখে নেই, সবই সুখেরই অভিনয়। হ্যাপিনেস ম্যাটারস, হিপোক্রেসি ডাসনট।
প্রেম-পরকীয়া-বিয়ে সংক্রান্তে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু/হত্যাগুলো থেকে বেরিয়ে বৈধ, আইনি, ধর্মীয় পথগুলো উন্মুক্ত হোক।
লেখক : পুলিশ সুপার, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে কর্মরত।