আয়েশা সিদ্দিকা, মোঃ রফিকুল আলম, মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
সার-সংক্ষেপ (Abstract)
এই গবেষণায় মিথ্যা মামলার প্রকৃতি, বিস্তৃতি, মিথ্যা মামলা রুজুর কারণ ও এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থাবলির কার্যকরিতা নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে। দৈব চয়নের মাধ্যমে স্তরিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশের আটটি বিভাগ/রেঞ্জ থেকে আটটি থানা এবং উদ্দেশ্যমূলক স্যাম্পলিং-এর মাধ্যমে সাতটি মহানগরী এলাকা থেকে সাতটি করে মোট ১৫টি থানা নির্বাচন করে উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এই গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল যেমন : বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ব্যবহার, কেআইআই এবং এফজিডি ব্যবহার করা হয়েছে। উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ২০১০-২০১৮ সাল পর্যন্ত এই নয় বছরে থানায় রুজুকৃত মামলার মধ্যে পল্লী অঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে মিথ্যা মামলা রুজুর হার বেশি। অথচ সাধারণ অনুমান এর বিপরীত। মিথ্যা মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, গবেষণাধীন এলাকার মধ্যে চট্রগ্রাম মহানগরী পুলিশের কোতোয়ালি থানায় মিথ্যা মামলা রুজুর হার বার্ষিক শতকরা সর্বোচ্চ (১ দশমিক ২৫%) এবং লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী ধানায় সবনিম্ন (০ দশমিক ২%)। মিথ্যা মামলার উৎস অপরাধ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, সিঁধেল চুরি, মারামারি-দাঙ্গা, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ, প্রতিপক্ষকে হয়রানি, পাল্টা মামলা থেকে পরিত্রাণ লাভ এবং প্রতিপক্ষকে আর্থিক ও সামাজিক হেয় প্রতিপন্ন করা অন্যতম। তা ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে মিথ্যা মামলা রুজু প্রতিরোধ ও শাস্তির জন্য আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়া হলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে শাস্তির হার খুবই কম (২%)।
প্রধান প্রধান শব্দগুলো : মিথ্যা মামলা, অভিযোগপত্র, চূড়ান্ত প্রতিবেদন, প্রসিকিউশন, আদালত ও সাজা
ভূমিকা : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে সমানভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দিয়েছে। এ অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে থানা বা আদালতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে। আদালত ও থানা পুলিশ ভুক্তভোগী বা বাদীর অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার কার্যক্রম গ্রহণ করে। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, অনেক সময় স্বার্থান্বেষী মানুষ আইনকেই হয়রানি ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য স্বার্থান্বেষী মানুষ নির্দোষ নাগরিকগদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে। আদালতে অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে শপথ বাক্য পাঠ করতে হলেও থানায় মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করার ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর উপর নিয়ন্ত্রণ সীমিত। দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ অনুযায়ী থানার অফিসার ইনচার্জ ধর্তব্য অপরাধের সংবাদ পেলে কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়াই মামলা বা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য। থানার অফিসার ইনচার্জ রুজুকৃত মামলার তদন্ত অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু মামলা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন না। তাই এক শ্রেণির মানুষ থানায় গিয়ে অবলীলায় মিথ্যা বা অর্ধসত্য বিবরণ দিয়ে মামলা রুজু করান। সঠিক তদন্তে চূড়ান্তভাবে এসব অভিযোগের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হলেও ভুক্তভোগীর আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক যে ক্ষতি হয়, তা আর পূরণ করা সম্ভব হয় না।
সমস্যার বিবরণ ও সমস্যা নির্বাচনের যৌক্তিকতা : মিথ্যা মামলার বিষয়টি বহুল আলোচিত বিষয়। মিথ্যা মামলার কারণে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হয়। আদালতের সময় এবং অভিযুক্তের অর্থ ব্যয় হয়। সর্বোপরি, সার্বিক বিচারিক কার্যক্রম নানাবিধভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। মিথ্যা মামলার মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করাও একটি আইনগত অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এ অপরাধটি অধর্তব্য হওয়ায় তার প্রক্রিয়া শুরুর এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে আদালতের। তদন্তকারী কর্মকর্তা এক্ষেত্রে তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন-মিথ্যা দাখিল করে আদালতে বাদীর (পরবর্তীতে অভিযুক্ত) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিবেদন করতে পারে মাত্র। সম্প্রতি কিছু বিশেষ আইনে মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের জন্য বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান উল্লেখ থাকলেও তার প্রক্রিয়ায় নানাবিধ দুর্বলতা বিদ্যমান। এমতাবস্থায়, মিথ্যা মামলার ভুক্তভোগীদের জন্য আইনের আশ্রয় নেয়ার ব্যবস্থাগুলোর কার্যকর সুফল জনগণ পাচ্ছেনা। মিথ্যা মামলার ভিক্টিমসহ এ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকে এর থেকে পরিত্রাণ আশা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সমাজের আইনের প্রতি বিশ্বাসী জনগণ এ বিষয়ে সোচ্চার হলেও আইনের পদ্ধতিগত দুর্বলতার জন্য থানা পুলিশ বা আদালত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সক্রিয় হতে পারছে না। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, আইনের শাসনের প্রতি মানুষ বীত-শ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে, আপরাধ বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। এ ছাড়াও, মিথ্যা মামলায় মানুষকে ফাঁসানো একটি সংঘবদ্ধ অপরাধে রূপ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এক শ্রেণির মানুষ মিথ্যা মামলার ভাড়াটিয়া বাদী হিসেবেও কাজ করছে। এমনকি কোনো কোনো ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতন, মানব-পাচার, অ্যাসিড নিক্ষেপ, প্রতারণা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার কল্পিত অপরাধে জড়িত থাকার জন্য ৬০টি পর্যন্ত মামলা হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি, ২০২০ এমন মিথ্যা মামলার শিকার ২০টি পরিবারের ১৩৩ জন সদস্য ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে। ইতোপূর্বে এ সংক্রান্ত কোনো গবেষণা/সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে বলে সাধারণভাবে তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া যায়নি। সঙ্গত কারণে দেশে মিথ্যা মামলার প্রকৃতি, বিস্তার এবং এর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের আইনের আশ্রয় লাভের বর্তমান ব্যবস্থার কার্যকারিতার মূল্যায়ন করা এবং এ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কিংবা নতুন ব্যবস্থার সুপারিশ করার জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা বাঞ্ছনীয়।
গবেষণা পদ্ধতি : এটি একটি উৎঘাটনমূলক গবেষণা। গবেষণার উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে পরিমাণগত ও গুণগত উভয় পদ্ধতি মিশ্রভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
নমুনায়ন প্রক্রিয়া : দৈব চয়নের মাধ্যমে স্তরিত পদ্ধতিতে প্রথমে বাংলাদেশের আটটি বিভাগ/রেঞ্জ থেকে আটটি জেলা ও জেলাগুলো থেকে আটটি থানা যথা, গাজীপুরের শ্রীপুর, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ, লালমনিরহাটের আদিতমারী, বগুড়ার শাহজাহানপুর, সিলেটের বিশ্বনাথ, শেরপুরের র্ঝিনাইগাতী, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও খুলনার ফুলতলা থানা নির্বাচন করা হয়। দৈব চয়নের মাধ্যমে নির্বাচিত থানাগুলো প্রায় সবগুলোই গ্রামাঞ্চলে পড়ে। এমতাবস্থায়, শহরাঞ্চলের অবস্থা জানার জন্য মহানগরী পুলিশের সাতটি থানাকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে, মহানগরী পুলিশের থানাগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্বাচন করা হয়। তথ্য সংগ্রহের এক পর্যায়ে দেখা গেল গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গি থানা দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। তাই টঙ্গি-পূর্ব ও টঙ্গি-পশ্চিম দুই থানা থেকেই তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু টঙ্গি পশ্চিম থানা টঙ্গি পুরাতন থানার উত্তরাধিকার হলেও সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। থানার ভাষ্য মতে ২০১৭ সালের আগের খতিয়ান বইয়ে মামলার তথ্যগুলো সঠিকভাবে সন্নিবেশিত হয়নি। তাই গবেষণার ত্রুটি কমানোর জন্য শেষ পর্যন্ত গাজিপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের বাইরে রাখা হয়। মেট্রোপলিটন পুলিশের থানাগুলো হলো, রংপুর মেট্রোপলিটন থেকে পুরাতন কোতয়ালী, ডিএমপির রমনা, কেএমপির খুলনা থানা, বিএমপির কোতয়ালী থানা, আরএমপির শাহ মখদুম থানা, এসএমপির কোতয়ালী থানা ও সিএমপির পাঁচলাইশ থানার তথ্যাদি গ্রহণ করা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণ ও গবেষণার ফলাফল :

উপরিউক্ত ছক প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ২০১০- ২০১৮ সাল পর্যন্ত পেনাল কোড, ১৮৬০ এ রুজুকৃত (৪১ হাজার ৮৪টি) মামালার মোট ৪০৮৭৩ টি’র তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে, যার মধ্যে মোট ৩১৬৩৫ টি মামলায় অভিযোগপত্র (৮১.৬%) এবং মোট ৯২৩৮টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন (১৮ দশমিক ৪%) দাখিল করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে মিথ্যা শ্রেণির চূড়ান্ত প্রতিবেদন মাত্র ৬২২টি, যা তদন্তকৃত মোট মামলার মাত্র ১.৫২%। অর্থাৎ মিথ্যা মামলার বিস্তৃতি পরিসংখ্যানগতভাবে খুবই নগণ্য। বার্ষিক গড় মিথ্যা মামলার সংখ্যা ৬৯ (প্রায়)টি এবং গড়ে প্রতিটি থানায় বার্ষিক পাঁচ (প্রায়)টি মিথ্যা মামলা রেকর্ড হয় ।
তদন্ত সম্পন্ন মোট মামলার সংখ্যা টি নিচে বার ডায়াগ্রামের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো,
চিত্র ৪.১: তদন্ত সম্পন্ন মোট মামলা

চূড়ান্ত প্রতিবেদন
সারণি ৪.২ এ তদন্ত সম্পন্ন মোট চূড়ান্ত প্রতিবেদন সংখ্যা তুলে ধরা হলো,

উপরিউক্ত সারণিতে দেখা যাচ্ছে, চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিথ্যর সংখ্যা খুবই নগণ্য। পরিসংখ্যান থেকে আরও স্পষ্ট হওয়া যায় যে, চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদানকৃত মামলাগুলোর প্রায় অর্ধেকই চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য শ্রেণিতে হয়ে থাকে। এর অর্থ হলো পুলিশ কোন মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে না এমন ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের সংখ্যা বেশি। বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। কারণ চূড়ান্ত প্রতিবেদন তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশের অদক্ষতা নির্দেশ করে। যদিও কোনো দেশের পুলিশই সংঘটিত অপরাধের শতভাগ উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হয় না তবুও চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য এর এ উচ্চহার উদ্বেগজনক। তবে বিষয়টি গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্যের বাহিরে বলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা হয় নি।


উপরিউক্ত সারণি অনুসারে, গত ৯ (নয় ) বছরে গবেষণা এলাকার ১৫ টি থানায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিথ্যা প্রদানকৃত ৬২২টি প্রতিবেদনের বিপরীতে ৩৬৩(৫৮ দশমিক ৩৬%) টি মামলা দ-বিধির ২১১ ধারায় কার্যক্রমের আবেদন করা হয় যার মধ্যে ৫০(১৩ দশমিক ৭৭%) টি মামলায় আদালত কর্তৃক কার্যক্রম গৃহীত হয় এবং আদালত কর্তৃক কার্যক্রম গ্রহণকৃত মামলাগুলোর মধ্যে এক (২%) টি মামলায় শাস্তি হয়েছিল। অন্যদিকে তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ ৪১ দশমিক ৬৪% মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন-মিথ্যা দাখিলের পরেও পেনাল কোডের ২১১ ধারার প্রসিকিউশনের জন্য আদালতে আবেদনই করেন না।

গবেষণা এলাকায় মিথ্যা মামলার বিস্তৃতি (৯ বছরের হিসাব)
সারণির মাধ্যমে থানাভিত্তিক মিথ্যা মামলার সংখ্যা প্রকাশ করা হলো,

0 Comments