মোঃ এনায়েত করিম
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৬ মার্চ ১৯৭১ রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্ থেকে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন। সারাদেশের মতো রাজশাহী পুলিশ লাইনসে্ অসীম সাহসী বীর পুলিশ সদস্যগণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মার্চের সেই ডায়েরিতে ফুটে উঠেছে অসীম সাহসীকতার সেইসব জানা-অজানা তথ্য।
১৯৭১। রাজশাহী পুলিশ লাইনস্। মার্চের ডায়েরি
২৫ মার্চঃ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে্ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশের মতো রাজশাহীর পুলিশ জেনে যায়। সতর্কতা হিসেবে রাতে রাজশাহীর পুলিশ সদস্যরা লাইনের চারপাশে সারা রাত বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রেখে পালাক্রমে পাহারা দেন। পাকিস্তানি বাহিনী ওই রাতে রাজশাহী শহরের বেশ কয়েকজনকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের খবর ২৬ মার্চ সকালেই শহরময় ছড়িয়ে পড়ে। শহরবাসীর মধ্যে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হয়। সকাল থেকেই ছাত্র-জনতা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করেন। এ কাজে পুলিশ সদস্যরাও সাদাপোশাকে অংশ নেন।
রাজশাহী পুলিশ লাইনস্রে অবস্থান ছিল শহরের পশ্চিমদিকে এবং কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এর পশ্চিম দিকে লোকালয় থাকলেও উত্তর ও পূর্বদিক ছিল খোলা। আর দক্ষিণে পদ্মা নদী। পুলিশ লাইনসে্ অবাঙালি পুলিশ ছিল অল্পকিছু, অধিকাংশই ছিল বাঙালি। অবাঙালিদের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় অবস্থানে থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পুলিশ লাইনসে্ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল বাঙালিদের হাতে।
অপারেশন সার্চলাইটের ভিত্তি হিসেবে সারাদেশের পুলিশকে নিরস্ত্রিকরণের কথা বলা হয়। ইতোমধ্যে, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পুলিশ লাইনসে্ প্রতিরোধের প্রস্তুতির সংবাদ পৌঁছে যায়। তারা রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মামুন মাহমুদকে পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণের এবং অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের আদেশ দেয়। তিনি অসম্মতি জানান। শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধের প্রস্তুতি।
২৬ মার্চঃ অনুমান সময় সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ লাইনস্রে কাছাকাছি এসে কয়েকটি গুলি ছোড়ে। প্রত্যুত্তরে পুলিশ লাইনস্ থেকেও গুলিছোড়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা উপশহরের সেনানিবাসে ফিরে যায়। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে কয়েকজন নিরীহ লোক প্রাণ হারান। ২৬ মার্চ রাত প্রায় ১২টা ৫ মিনিটে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব দিকের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পুলিশ লাইনস্রে দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা অবস্থান নেয় পদ্মার পাড়ে, লক্ষ্মীপুর মোড়ে, ইপিআর লাইনের পাশে ও রেডিও সেন্টারে। পুলিশ লাইনস্ থেকে সাররাত বিক্ষিপ্তভাবে গুলিবর্ষণ হতে থাকে।
২৭ মার্চঃ আবারও পাকিস্তানিবাহিনীর তৎপরতা বাড়ে। পুলিশ লাইনস্কে ঘিরে তারা রেডিও সেন্টার, গির্জা, বোয়ালিয়া ক্লাব, নদীর ধারসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আধুনিক ও ভারীঅস্ত্র স্থাপন করে। পরিপূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতির পাশাপাশি তারা কূটকৌশলেরও আশ্রয় নেয়। সকাল আনুমানিক ১০টায় পাকিস্তানি বাহিনীর এক কর্মকর্তা মাইকের মাধ্যমে ভাইয়ে ভাইয়ে আত্মঘাতী যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানান। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করতে বলেন। রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপারশাহ আবদুল মজিদ পিএসপি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের মত জানতে চাইলে তাঁরা আলোচনার বিপক্ষে মত দেন। তিনি পুলিশ লাইন ছাড়ার আগে পুলিশ সদস্যদের দেশের জন্য কিছু করার আহ্বান জানান। পাকিস্তানি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি একটি আপসরফায় আসেন। সমঝোতা হয় যে উভয় পক্ষের কেউ কাউকে আক্রমণ করবেনা। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। বেলা আনুমানিক তিনটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে সেনানিবাস থেকে পুলিশ লাইনস্রে উদ্দেশে রওনা হয়। খবরটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ সদস্যরা আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে পুলিশ লাইনস্ ঘিরে অবস্থান নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিতে থাকে।
কোন উপায় না দেখে আবদুল মজিদ নওগাঁর ইপিআর-এর ৭ উইং-এর ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তিনি পুলিশকে সাহায্য করার আহ্বান জানান। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামিম আহসানও পুলিশের ওয়্যারলেসে নওগাঁর ইপিআরকে একই আহ্বান জানান। নওগাঁর সঙ্গে রাজশাহীর যোগাযোগ তখন ভালো ছিল না। প্রায় ৭০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ধরে ইপিআরের পক্ষে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে্ পৌঁছানো কঠিন ছিল। তাই বাহিনী রওনা দিলেও সময়মতো রাজশাহী পৌঁছাতে পারেনি।
পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব দিক থেকে নিয়োজিত আধুনিক ওভারী অস্ত্র থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। হাবিলদার আতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরাও তখন রাইফেলের সাহায্যে জবাব দিতে শুরু করেন। গোলাগুলি চলে সারা রাত। পুলিশ সদস্যরা সুরক্ষিত অবস্থানে থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনস্রে দিকে এগোতে পারে না। রাতের যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তাদের দুটি গাড়িও উল্টে যায় বলে জানা যায়।
২৮ মার্চঃ আনুমানিক ১০টায় পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজর রাজশাহী জেলার এডিসির সাহায্য নিয়ে গোলাগুলি বন্ধ করতে পুলিশ বাহিনীকে মাইকে আহ্বান করেন। দুই পক্ষ থেকে গুলি করা বন্ধ হলে মেজর তাঁর পাঁচ-ছয়জন সঙ্গী নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় পূর্ব দিক থেকে পুলিশ লাইনস্ েযান। ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবেÑ এই আশ্বাস দিয়ে তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে সেনানিবাসের দিকে চলে যান। পুলিশ সদস্যরা মেজরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিরক্ষা সরিয়ে ব্যারাকে ফিরে আসেন। বাংকারে থেকে যান কয়েকজন মাত্র পুলিশ।
বেলা একটায় পুলিশের সদস্যরা খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কেউ কেউ খাচ্ছিলেন। এমন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার ও ভারী মেশিনগান নিয়ে তাঁদের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। বোয়ালিয়া ক্লাবের ছাদ থেকে নিক্ষেপ করা মর্টারের প্রথম শেলটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বর্তমান পুলিশ স্কুলের পশ্চিমে আনুমানিক এক শ-সোয়া শ গজদূরে মোক্তার গোলাম মোস্তফার বাড়িতে আঘাত করে। গোলাম মোস্তফা, তাঁর ছেলে, ভাগনেসহ মোট পাঁচজন শহীদ হন। পরের শেলটি আঘাত করে পুলিশ লাইনের ওয়্যারলেস টাওয়ারে। সেটি ভেঙে পড়ে। কয়েকটি ব্যারাকে আগুন লেগে যায়। পুলিশ সদস্যরা শুরু থেকেই পুলিশ লাইনস্রে উত্তর ও পূর্ব দিককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে পাকিস্তানি বাহিনী সে দিক দিয়ে এগোতে পারেনি। কিন্তু দক্ষিণও দক্ষিণ-পূর্ব দিক, অর্থাৎ নদী ও বোয়ালিয়া ক্লাব এলাকা প্রায় অরক্ষিতই থেকে গিয়েছিল। এটি ছিল মারাত্মক ভুল। দুর্বলতা টের পেয়ে একদল সেনা এ দিক দিয়ে অতর্কিতে পুলিশ লাইনসে্ ঢুকে আক্রমণ চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় পুলিশের সদস্যরা দিগ্বিদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন। যাঁরা বাংকারে ছিলেন, তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ অস্ত্র ও গুলি নিয়ে শুকনা ড্রেনে অবস্থান নেন। নেতৃত্বের অভাবে এবং শত্রুর আকস্মিক আক্রমণে আগের দিনগুলোর মতো তাঁরা আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হলেন না। তীব্র আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে বহু পুলিশ সদস্য অস্ত্র ও গুলিসহ লাইনের পশ্চিমে ভেড়িপাড়ার মধ্য দিয়ে বলুনপুর, কোর্ট ও রায়পাড়ার দিকে চলে যেতে বাধ্যহন। পুলিশ লাইনসে্ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংকারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা পুলিশ সদস্যদের পেছন থেকে আক্রমণ চালায়।
সন্ধ্যা হওয়ার আগেই পুলিশ লাইনসে্ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজশাহীর প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ২৮ মার্চের ভয়াবহ যুদ্ধে শহীদ হন ১৯ জন পুলিশ সদস্য। এর আগে ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ডিআইজি মামুন মাহমুদকে কৌশলে রংপুর ব্রিগেড সদর দপ্তরে ডেকে নিয়ে হত্যা করে।
২৯ মার্চঃ পাকিস্তানি বাহিনী বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দৌলত খানের কাছে ১৮ জন পুলিশ সদস্যের লাশ হস্তান্তর করে। একজনের লাশ পুলিশ লাইনসে্ থেকে যায়। পুলিশ লাইনসে্ মধ্যেই আম ও বাবলা গাছে ঘেরা বাগানের মধ্যে ১৯ জন শহীদ পুলিশকে সমাহিত করা হয়।
৩১ মার্চঃ জেলা প্রশাসকের বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে পুলিশ সুপার আবদুল মজিদকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হত্যা করে।
এভাবেই পতন হয় রাজশাহী পুলিশ লাইনসে্ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। ২৮ মার্চের ভয়াবহ যুদ্ধে শহীদ হন ১৭ জন পুলিশ সদস্যÑ আর্মড এসআই এনায়েত খান, কনস্টেবল অধ্যাপক আবদুল আজিজ, ওসমান খান, আবদুর রহমান, আক্কাস আলী, রইছ উদ্দিন, জয়নাল আবেদীন, আলাউদ্দিন, আলীমুদ্দিন, আবদুল হামিদ, সাদেকুল ইসলাম, মেছের উদ্দিন, আবু ইলিয়াস, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল মালেক, সিরাজুল ইসলাম, আবদুল আজিজ মোল্লা। এই বীর শহীদ পুলিশ সদস্যদের গণকবর দেওয়া হয় পুলিশ লাইনসে্ পূর্বদিকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মোহাম্মদ আলী কামাল জানান,
“রাজশাহীর প্রথম ও একমাত্র সম্মুখ যুদ্ধটি হয়েছিল পুলিশ লাইনসে্ পুলিশ সদস্যরা বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এর পর রাজশাহী শহরে বড় ধরনের আর কোনো যুদ্ধ হয়নি।”
বর্তমান রাজশাহী পুলিশ লাইনস্রে সামনে একটি স্মৃতিফলকে ৫৬ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের নাম খোদাই করা আছে। প্রকৃত গবেষণায় এই শহীদ পুলিশ সদস্যের তালিকা আরো অনেক বেশি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই দুরূহ কাজটির মাধ্যমেই বের হয়ে আসুক রাজশাহী পুলিশ লাইনস্রে আরো অনেক অজানা তথ্য, ফুটে উঠুক জানা-অজানা বীর পুলিশদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর