ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

ড. আবুল আহসান চৌধুরী

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশের মধ্যে অবরুদ্ধ জীবন কেমন ভয়াল, বিভীষিকাপূর্ণ ছিল, সেই নারকীয় আতঙ্কের ভুবনের কথা বলতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান এক আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন- ‘১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে… গণহত্যা শুরু হলে ঐদিনই ঢাকা ছেড়ে চলে যাই আমাদের গ্রামের বাড়িতে- পাড়াতলীতে। তো ওখানে গিয়ে এপ্রিলের আট-নয় তারিখের দিকে বোধ হয়- এই দুপুরে-একসঙ্গে ঘণ্টা দেড়েকের ব্যবধানে দুটি কবিতা লিখি, একটি হলো- ‘স্বাধীনতা তুমি’ আর একটি হলো ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। তখন ঢাকায় যে বিভীষিকা সেই স্মৃতি নিয়ে। যদিও আর্মি মারছে এটা চোখে পড়েনি, কিন্তু ঐ যে সারা দিন গুলির আওয়াজ শাঁখারিবাজারে, সেটা শুনেছি। তারপর সারা দিন নয়াবাজার পুড়েছে দাউ দাউ করে- আগুন জ্বলেছে, ওটা দেখেছি।… এই যে কী অভিজ্ঞতা এখন ঠিক আমি বলতে পারছি না- তখনকার মানসিক অবস্থা যে কী রকম ছিল!… তারপর মে মাসের শেষের দিকে আমরা চলে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে যখন নামলাম রাস্তাগুলো দেখে আমার মনে হলো যেন এ আমার শহর নয়, এ শহর যেন আমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। খুব বেগানা মনে হলো আমার কাছে- খুব অপরিচিত মনে হলো। আর কেমন যেন একটা আতঙ্ক, সেটা ঠিক বোঝাতে পারব না’ (আবুল আহসান চৌধুরী গৃহীত সাক্ষাৎকার: ‘শামসুর রাহমান স্মারকগ্রন্থ’- শামসুজ্জামান খান ও আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১০)। এই যে মৃত্যুর নিঃশ্বাস শরীরে পড়ার অনুভূতি ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল অবরুদ্ধ সব মানুষেরই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কেউ কেউ বিপন্ন দিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধের কালের এমন একটি দিনপঞ্জি উদ্ধার করা গেছে। ডায়েরিটি একজন মুক্তমনা প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শামসুল হুদার (১৯১০-১৯৮৯), যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অবরুদ্ধ ছিলেন ঢাকায়। ডায়েরিটি পাওয়া গেছে তাঁর পুত্র এনায়েত আকবর (যীশু)-এর সৌজন্যে।

দুই

শামসুল হুদা ছিলেন পেশায় শিক্ষক। দেশভাগের আগ পর্যন্ত কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল ও দেশভাগের পর ঢাকার আরমানিটোলা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৯ সাল থেকে কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন- প্রথমে ঢাকা মুসলিম ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, পরে ঢাকা কলেজ এবং সবশেষে ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। এই টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকেই ১৯৭০-এ অবসর নেন ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে।

শামসুল হুদার জন্ম ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯১০, নোয়াখালীর নওয়াপাড়ায়। বিত্ত ও বিদ্যায় পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। পিতা আমিনুল্লাহ মিয়া ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সমাজসেবী। ব্রিটিশ আমলে তিনি দীর্ঘকাল ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন শামসুল হুদা। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ, পরে বিটি-ও পাস করেছিলেন। তাঁর আর- একটি পরিচয় তিনি ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের পুরোধা, বিশিষ্ট সমাজভাবুক ও মনস্বী লেখক কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)-এর জামাতা। ওদুদের একমাত্র কন্যা জেবুন্নিসার (১৯২৩-১৯৮৮) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ৮ এপ্রিল ১৯৪৯ কলকাতায়। এনায়েত আকবর (যীশু) তাঁদের একমাত্র সন্তান। শামসুল হুদার মৃত্যু হয় ১৫ মার্চ ১৯৮৯, ঢাকার জিগাতলার বাড়িতে। তার প্রায় বছরখানেক আগে (২৮ জানুয়ারি ১৯৮৮) অগ্নিদগ্ধ হয়ে তাঁর স্ত্রী জেবুন্নিসা মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর কবরের পাশেই ঢাকার বনানী গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তিন

শামসুল হুদা লিখতেন, মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন তিনি। যৌবনে ১৯২৬-এ প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’র অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সাহিত্যসমাজের মুখপত্র ‘শিখা’তে তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল- ‘হজরত মুহম্মদের প্রতিভা’ (১৩৩৩) এবং ‘কুসংস্কারের একটা দিক’ (১৩৩৬)। সাহিত্য-সমাজের বিভিন্ন অধিবেশন ও সাহিত্যবাসরে তিনি স্বরচিত কবিতাও পাঠ করেন। এছাড়া অন্যান্য পত্রপত্রিকাতেও তাঁর কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর বেশকিছু লেখা অপ্রকাশিতও রয়ে গেছে। মূলত মুসলিম সাহিত্য-সমাজের লেখকদের কবিতার একটি সংকলনও শামসুল হুদার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কয়েকটি কবিতা’ (১৯৪৬) নামে। শামসুল হুদার দু’একটি লেখার বক্তব্য সেকালের রক্ষণশীল গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ফলে বেশ প্রতিক্রিয়াও হয়। কবিতা যা লিখেছিলেন তা ছিল নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তবে চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনায় প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখেছিলেন। চর্চা অব্যাহত রাখলে কালে তিনি যে বিশিষ্ট মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতেন তা অনায়াসে অনুমান করা যায়। তবে জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত উদার মন ও মতের এই মানুষটির সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি ও প্রগতিশীল মানস যে অক্ষুণœ ছিল তার সাক্ষ্য বহন করে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের  এই ডায়েরিটি।

চার

অধ্যাপক শামসুল হুদা হাবিব ব্যাংক লিমিটেডের ১৯৬৮ সালের পুরনো একটি ডায়েরির পাতায় মুক্তিযুদ্ধের রোজনামচা লেখা শুরু করেন। মাঝে মাঝে কিছু অংশ ইংরেজিতে লিখলেও মূলত বাংলাতেই ডায়েরিটি লিখেছিলেন। ২৪ মার্চ ১৯৭১ থেকে শুরু করে ২৫শে নভেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত এই ডায়েরির বিস্তৃতি। তবে প্রতিদিনই যে তিনি লিখতে পেরেছেন তা নয়, মাঝে মধ্যে বাদও গেছে। প্রায় ক্ষেত্রেই ঘটনার যথাসম্ভব অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন, কখনো বা সংক্ষেপে নোট রেখেছেন। পাক-মিলিটারি ও তার দোসরদের বর্বর-পৈশাচিক কর্মকা-, হত্যা-অগ্নিসংযোগ-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-নির্যাতন, দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়া, সংবাদ-মাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গি- এসব বিবৃত হয়েছে শামসুল হুদার একাত্তরের দিনপঞ্জিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রায় জনশূন্য প্রেতনগরী অবরুদ্ধ ঢাকার জিগাতলায় নিজের বাড়িতে সস্ত্রীক তাঁকে আতঙ্ক ও মৃত্যুভীতির মধ্যে কাল কাটাতে হয়। একমাত্র সন্তান এনায়েত আকবর (যীশু)-কে সম্পৃক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধের কাজে। দীর্ঘ নয় মাস অধ্যাপক হুদার সময় কেটেছে বই পড়ে, রেডিও শুনে, সমমনাদের সঙ্গে কথা বলে, গোপনে মুক্তিযুদ্ধের কাজে সহায়তা করে, আর প্রায় নিয়মিত ডায়েরি লিখে। ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর ঢাকা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসনগরীতে, রক্তে রঞ্জিত ও আগুনে ঝলসে গিয়েছিল রূপসী ঢাকার অনিন্দ্য মুখ। ডায়েরিতে তিনি যা লিখেছিলেন তার উৎস ছিল নিজের অভিজ্ঞতা, সংবাদপত্র ও বিদেশি রেডিওর খবর এবং কখনো বা প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য। শুধু বিবরণ বা তথ্য পরিবেশন নয়, মাঝেমধ্যে নিজের মন্তব্যও যোগ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়েÑ জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণে একদিকে স্বভাবতই তাঁর মনে ছিল ভীতি ও উৎকণ্ঠা, অপরপক্ষে গভীর আশাবাদ ও নারকীয় হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার। বাঙালির এই মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের জয় অনিবার্য, সেই প্রত্যয়ও তাঁর মনে জেগেছিল।

পাঁচ

অধ্যাপক শামসুল হুদা মুক্তিযুদ্ধকালের দিনপঞ্জিতে তাঁর স্মৃতি-শ্রুতি-অভিজ্ঞতার আলোকে সেই ভয়াবহ-নারকীয় সময়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। ধর্মের নামে- গণতন্ত্রের নামে- দেশরক্ষার নামে খানসেনা আর তাদের দোসর-দালালেরা হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের যে কলঙ্কময় ইতিহাস গড়েছিল এই ডায়েরিতে সেই নিষ্ঠুর অপকর্মের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। ডায়েরির লেখক তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ও দূরদৃষ্টি থেকে স্পষ্টই উপলব্ধি করেছিলেন, মানবতা ও ন্যায়বিচারহীন সভ্যতাবিরোধী এই রাষ্ট্র কোনক্রমেই টিকে থাকতে পারে না। সেই কারণে মুক্তি-সংগ্রামের বিজয় সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন। একজন মানবতাপন্থী বিবেকী মানুষের এই অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি, মুক্তিযুদ্ধের এক মূল্যবান তথ্যদলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।

ছয়

ডায়েরি শুরু হয়েছিল ইংরেজিতে। তবে এপ্রিলের গোড়া থেকে বাংলায় লেখেন। এখানে একাত্তরের মার্চ থেকে নভেম্বর- তাঁর আট মাসের ডায়েরি থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ পরিবেশিত হলো-

26th- 27th [March, 1971] [night]

Cross-firing in EPR. Raid of Iqbal Hall, Jagannath Hall, Bastee Elaka & death of G. C. Dev, Moniruzzaman, Jyotirmoy Gushathakurta…

28th [March] 1971

Tanks used in Dacca. I saw with my own eyes. Cross firings at E.P.R.

Shankhari Patti Killing is only compareable to gas-chamber killing of the Jews.

2 April

It is reported from Tangail that Joy Bangla flags are flying in all places except in Dacca.

[২ এপ্রিল]

আজ রাত ৮.৪৫ মিনিটে টেলিভিশনে জিঞ্জিরা সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা সর্বৈব মিথ্যা। দুষ্কৃতকারী অথবা শহরে ফেরা লোকদের প্রতিরোধকারী নয়, জিঞ্জিরায় শরণার্থী হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নিরীহ মানুষের ওপর সকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত মর্টার বর্ষণ করা হয়েছে। সিরাজ (মায়ার পূর্বতন স্বামী) তাঁর মাকে নিয়ে আসতে গিয়ে অন্তত ৭/৮ ক্ষেত্রে অগ্নিকা- দেখে এসেছে। মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের দুষ্কর্ম ঢাকতে চাচ্ছে। যেকোনো রাষ্ট্রই হোক না কেন, তার প্রধান বাহন যখন হয়ে ওঠে মিথ্যা, সে রাষ্ট্র টিকতে পারে না।

৩/৪

In 1968 Pakistan used weapons received from U.S.A. against India. This time weapons received from China have been used against Bangladesh.

৪/৪

আজও ঞবষবঢ়যড়হব নাই [,] রেল নাই [,] স্টিমার জাহাজ নাই [,] অফিস-আদালতে ৭/৮ জন ছাড়া লোক নাই [। ]

আজও রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারটা পর্যন্ত মেশিনগানের শব্দ শোনা গেছে।

৭/৪

পাকিস্তান রেডিয়ো: ডঃ কামাল হোসেন আত্মসমর্পণ করেছেন।

পাবনাতে ব্যাপক হত্যাকা- চলছে। কাল নাকি গোপালপুর চিনির কলের সাড়ে তিনশত শ্রমিক ও কর্মচারীদের গুলি [করে] হত্যা করা হয়েছে [। ]

১৫/৪

কাল রাতে একফোঁটা ঘুমও হয়নি। আজকের দিনটা বড়ো উদ্বেগে কাটছে। আজ পয়লা বৈশাখ। এটা ছিল ছুটির দিন- বাঙালির নববর্ষ। সরকার ‘জরুরি অবস্থা’র (emergencey-i) জন্য ছুটির দিনটা বাতিল করে দিয়েছে। এটা আমার নিজেরও জন্মদিন। ছুটিটা বাতিল হলো বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ পাচ্ছি।…

১৬/৪

ইকবাল হল মেরামত শুরু হয়েছে। জগন্নাথ হলও হয়তো। Mass grave-এর ওপর ঘাস লাগানো হচ্ছে।…

শহীদ মিনারকে মসজিদ-এ পরিণত করার প্রয়াস চলছে।…

২১/৪

আজও মাঝে মাঝে পাকসৈন্য ও রেঞ্জারদের দ্বারা নরহত্যা ও লুণ্ঠনের খবর পাওয়া গেছে।

একজন বললেন (আমার বাড়ির সামনে shed-এর দোকানদার) যে সে স্বচক্ষে দেখে এসেছে, অর্থাৎ তার আত্মীয়া এক ধাত্রীর কাছ থেকে শুনেছে, মিটফোর্ডে সাড়ে তিনশো মেয়ে ধর্ষিত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তন্মধ্যে বারো বছরের মেয়ের ওপর ১৭ জন সৈনিক পরপর অত্যাচার করেছে। সে মরণাপন্ন।…

দুজন Labour M.P. ডগলাসম্যান ও স্টোনহাউস নাকি পূর্ববঙ্গের প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য আসছেন। এরা এসে যদি দেখেন ইকবাল হল সদ্য মেরামত করা হয়েছে, জগন্নাথ হলও। জগন্নাথ হলের মাঠ থেকে মড়ার হাড়গুলো এক এক করে কুড়িয়ে নিয়েছে। শেখ মুজিবরের বাড়ি চুনকাম করা হয়েছে। তাহলে তারা বুঝতে পারবেন তো যে পাপাচার ঢাকার কত চেষ্টা হয়েছে। হাজার হাজার লাশের সন্ধান পাওয়া যাবে না- প্রায় সবই তো নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তবুও পাকসৈন্যের বর্বরতার এমন অনেক নির্দশন এই ঢাকা শহরের বুকের ওপরই পাওয়া যাবে, যা সহজে নিশ্চিহ্ন হবার নয়।… ইকবাল হল রোকেয়া হলে রেজিস্ট্রার ছাত্রদের সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে, বলা হবে ওরা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তা যেন বুঝলাম, ধরে নেব, কিছুসংখ্যক সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু তাহলে বাকি সবাইকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক না কেন। নিতান্ত মোশফেক মরদূদ না হলে কোনো মুসলমান না স্বীকার করবে খুঁজে খুঁজে হিন্দু বস্তি হিন্দু এলাকা ধ্বংস করা হয়েছে। পাঞ্জাবকে যেমন Sikh Free করা হয়েছে, তেমনি হিন্দু free করা হচ্ছে বাংলাদেশকে আর করা হচ্ছে free of intelectuals and students, Foreign reporter দের তাড়িয়ে দিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানকেও ঘুণাক্ষরে জানতে দেওয়া হচ্ছে না, পূর্ববঙ্গে কি চলছে। যশোর সম্বন্ধে শোনা গেল ১০ মাইলের মধ্যে ঘরবাড়ি ও জনমানবকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। সাবাস জঙ্গি বর্বরতা!

২৩/৪

মাইলাইয়ের একটিমাত্র ঘটনায় বিশ্ব-বিবেক পীড়িত হয়েছে, আর আজ পূর্ববঙ্গে শত শত মাইলাই সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও উ থাঁন্ট প্রভৃতিদের মুখে কথা নেই কেন? ধিক্ U.N.O. ধিক্ পশ্চিমী সভ্যতা…।

পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তার নিয়ামত ইয়াহিয়া-টিক্কা, Franco, Hitler, Nadir Shah দের হার মানিয়েছে।

২৪/৪

ঢাকা শহরের ২০ ভাগ লোক শহর ছেড়ে চলে গেছে, কথাটা আকাশবাণী থেকে ভুল প্রচারিত হয়েছে, বস্তুত গেছে শতকরা আশি ভাগ। জন-বিরল ভৌতিক শহর ঢাকা, আজ একমাস পরেও।…

২৬/৪

আজ শুনলাম শেখ সাহেবের ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার স্বীকৃতি আদায়। তাঁর শরীর নাকি ভেঙে পড়েছে। এজন্য সকলের দুঃখের অবধি নেই। এ দুঃখ কেউ বাইরে প্রকাশ করতে পারছে না, কিন্তু অন্তরে কারো স্বস্তি নেই।…

২৭/৪

আজ দুপুরবেলা থেকে কালকের মিরপুরের হত্যাকান্ডের কিছু কিছু খবর পাওয়া গেল। দুপুরে আমার ছেলে তার জনৈক বন্ধু ‘অপু’র কাছ থেকে শুনে এল প্রায় দুশো বাঙালিকে বিহারিরা হত্যা করেছে। নাঙা ছোরা হাতে নিয়ে মোহম্মদপুরের বিহারিরা বেপরোয়া আক্রমণ চালিয়েছে, বলল আজিজুল, আমার জনৈক প্রাক্তন ছাত্র। তাকে চ্যালেঞ্জ করা হলে সে উর্দুতে কথাবার্তা বলে কোনো প্রকারে প্রাণরক্ষা করে। বিহারিরা মিরপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী, মোহম্মদপুর ও কাঁটাসুরে তাদের হত্যাযজ্ঞ চালায়। বিকেলে হক সাহেব বললেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকদের কাছ থেকে জানা গেল, পাঁচশো থেকে হাজার জন বাঙালিকে কাল মিরপুর-কল্যাণপুর এলাকায় হত্যা করা হয়েছে। বাস থেকে নামিয়ে, ঘর থেকে টেনে এনে রাজপথে, এক এক করে গলা কেটে কেটে হত্যা করা হয়েছে। এসব দুষ্কর্ম ঘটেছে মিলিটারিদের চোখের সামনে, তাদের অনুচ্চার অনুমোদনক্রমে।…

কালকে এগারোটার পরে শহরে খুব একটা সন্ত্রাসের ভাব দেখা যায়। রাস্তাঘাট একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে। উক্ত হত্যাকা- চলে পাঁচটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। এরই মধ্যে আস্তে আস্তে সংবাদ ঢাকা শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন অফিস ও ব্যাংকের কর্মচারীরা অফিস ত্যাগ করে চলে যায়। শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার নমুনা এই। পাকিস্তান রেডিও গলা ফাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার কথা প্রচার করে চলেছে। এই প্রচারকার্য কিন্তু স্বাভাবিক নয়।…

২/৫

মীর জাহানীর মা গিয়েছিল তার ছেলের বাড়িতে চার-পাঁচদিন আগে। যাবার পথে সে দেখেছে নদীতে নদীতে অসংখ্য মরা লাশ। পুরুষের লাশগুলো উপুড় হয়ে ভাসছে, মেয়েদের চিত হয়ে। মরে ফুলে ওঠা লাশের ওপর বসে কাক ঠোকরাচ্ছে।…

১২/৫

বাঙালি নিরপরাধ তরুণদের ধরে নিয়ে গিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে গুলি করে নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। রোজ শত শত মরা লাশ ভেসে যেতে দেখা যাচ্ছে সদরঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত।

আমি রোজ আমার ঘরে বসে ৫/৭টি করে ট্রাক যেতে দেখি, চোখবাঁধা তরুণদের বোঝাই করে। এক একটা ট্রাক দেখি আর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কতদিন এ টেনশন সহ্য করতে পারব জানি না।

১৫/৫

আজ বাড়ি ফেরার পথে দেখে এলাম বুলডোজার দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে রোকেয়া হলের শহীদ মিনারগুলো। মানুষের Sentiment-এর ওপরে বুলডোজার।…

১৬/৫

আজকের পত্রিকায় রাজাকার বাহিনী গঠনের কথা বলা হয়েছে। কেন এ বাহিনী, কি উদ্দেশ্যে? নিপীড়নের একটা যন্ত্র হিসেবে নয় তো?

১৯/৫

…যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর যে বাস্তবিকই সে দিনও মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল তা ঠিক। কিন্তু মুক্তিবাহিনী শেষ পর্যন্ত পাক জঙ্গি বিমানের অবিরাম বোমাবর্ষণ আর কামানের গোলার মুখে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। কুষ্টিয়ায় যে যুদ্ধ হয়েছিল, তা নাকি সত্যই একটা বড়ো রকমের যুদ্ধই ছিল। প্রথমে মুক্তিবাহিনী যে মার দিয়েছিল তা নাকি খুবই স্মরণযোগ্য।

পাকবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণেও নাকি পশ্চাদপসরণ ত্বরান্বিত হতো না। ত্বরান্বিত হলো কেবল ইপিআর, আনসার, মোজাহিদ প্রভৃতি যারা কুষ্টিয়া দখলে অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের অভাবে।…

২৬/৫

ড. মোহর আলী আমার একজন পুরাতন ছাত্র। তার সঙ্গে বেলা দুটার দিকে নিউমার্কেটে দেখা হলো। বললাম, তোমাদের বিবৃতি পড়েছি। বললেন, আর বলবেন না স্যার। সই করতে হলো, তাই করেছি। সত্যই কি তাই এতটা নিরুপায় আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা?

৮/৬

…আজকের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরো দু’একটি খবর উল্লেখযোগ্য: যেমন বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বাঙালি কর্মচারীদের ছাঁটাই করা, ক্ষতিপূরণ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডেকে এনে তরুণ বাঙালি ধরে নিয়ে যাওয়া, হাদিসের কোনো কোনো অংশ বাদ দিয়ে ঢাকা বেতার থেকে প্রচার করা প্রভৃতি। এর এক বর্ণও কিন্তু মিথ্যা নয়!

১২/৬

সন্ধ্যার আগে আরো অনেক মজাদার খবর পাওয়া গেল। প্রবীণ বৃদ্ধ অন্ধ নেতা আবুল হাশেম [হাশিম]  সাহেবের কাছে নাকি টিক্কা খান জনৈক ব্রিগেডিয়ারকে পাঠিয়েছেন, একটা বিবৃতি দেবার অনুরোধ জানিয়ে। তিনি রাজনীতি বর্জন করার অজুহাত জানিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ফের এক মেজরকে পাঠানো হলো। তারও ওই একই মহান প্রস্তাব। উত্তরও ফের একই রকম পাওয়া গেল। কিন্তু মেজর সাহেব নাছোড়বান্দা। তিনি হাশেম [হাশিম] সাহেবের ওপর আরো চাপ দিতে থাকলেন। হাশেম [হাশিম] সাহেব এবার দৃঢ়তর মনোভাব দেখাতে বাধ্য হলেন। বললেন, এ ব্যাপারে দুটো পথ খোলা আছে। আপনারা আমাকে যদি আপনাদের একটা তিরিশ পয়সার বুলেটের অযোগ্য মনে করেন, তা হলে আমাকে স্বচ্ছন্দে আপনাদের বন্দীশিবিরে নিয়ে যেতে পারেন। আর তা না হলে আপনার ওই অটোমেটিকটা উঁচিয়ে ধরুন, বান্দা হাজির।

১৩/৬

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, কবি গোলাম মোস্তফার পুত্র মনোয়ার এখন জয় বাংলা রেডিও পরিচালনা করেছেন।

১৬/৬

আবু ছাঈদ [সাঈদ] চৌ. সাহেবের গ্রামের বাড়িতে (বল্লায়) হানা দিতে গিয়েছিল পাঞ্জাবি হানাদাররা। নৌকা করে খাল পার হতে গিয়ে তারা মুক্তিবাহিনীর কবলে পড়ে তারা দু’দু’বার বিষম মার খায়। প্রথমবার মুক্তিবাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে কয়েকজন সৈন্য মারা যায়, কয়েকজন আহত হয়, আর কয়েকজন অক্ষত থেকে যায়। শেষোক্তরা রেডিওতে উদ্ধারের আবেদন জানায়। তখন তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে পাকসৈন্যরা আরো মার খায়। পরে পশ্চাদগমন করে। দু’তিন দিন পূর্বে এ ঘটনাটি ঘটে।

১৯/৬

করাচিতে বাঙালিদের ওপর জুলুম চলছে, খবর পাওয়া গেল। তাদের নাকি করাচি থেকে দূরে কোনো এক concentration camp-এ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃসংবাদ আর কি হতে পারে?…

২০/৬

আজ আবার কয়েকটা চুটকি খবর পাওয়া গেল।

খানসেনাদের অনেকেই ক-অক্ষর গোমাংস। তবু অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! তাদের চেয়ে বুদ্ধিতে, অক্ষরজ্ঞানে মানবতা বোধে শ্রেয়তর বাঙালিরা তাদের হাতে নির্যাতিত আর লাঞ্ছিত!

দু’-একটা গল্প শোনা যাক। ঢাকা শহরে রোজ গাড়ি স্কুটার-রিকশা চেক করেন খানসেনারা আর করাচি পুলিশেরা। পথিকরাও বাদ যায় না। বাসার চাকরেরা যখন রেশন তুলে বাড়ি ফেরে তাদের কাছে Indentity Card তলব করা হয়। দু’একটা চাকর Ration Card কে identit বলে চালিয়ে দেয়। প্রভু সেনা খোশ হয়ে যান- ইয়া বড়া identity card দেখে।

ভাল কথা, identity কথাটা উচ্চারণ করতে হুজুররা অপারগ। বলেন, ডান্ডি কার্ড। ডান্ডি কার্ড কাঁহা? এক ভদ্রলোক অফিসে কেরানির কাজ করেন। তিনি একদিন এসব মহাপ্রভূদের খপ্পরে- ‘ডান্ডি কার্ড কাঁহা?’ তিনি পকেট থেকে কার্ডটা বার করে দেন। প্রশ্ন হলো, ‘এতনা ছোটা ডান্ডি কার্ড কাহে?’ কি জবাব দেবেন এ প্রশ্নের? অথচ ওদের পছন্দসই একটা উত্তর না দিলে নয়। ভদ্রলোক বুদ্ধি খরচ করে বললেন, ‘হম ছোটা নোকরি করতা হ্যায়, ইস লিয়ে হামারা ডান্ডি কার্ড ছোটা হ্যায়।’…

২৬/৬

গেল দু’তিন দিন বড়ো ব্যস্ত ছিলাম। বেশ কয়েক পৃষ্ঠা টাইপ করেছি। খানসেনাদের হত্যাকান্ডের একটা ফিরিস্তি তৈরি করতে হয়েছিল। তৎসঙ্গে লুণ্ঠন নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির অন্তর্নিহিত দর্শনের একটা মোটামুটি পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছি এবং সে লেখাটা জনৈক বিদেশির কাছে হস্তান্তরিত করেছি। সাংঘাতিক একটা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। জানি না, কাজটা সার্থকভাবে করতে পেরেছি কিনা। কিন্তু গতকাল বিবিসি খবরে মোটামুটি আমার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি পাওয়া গিয়েছিল। মনে হচ্ছে আমার প্রচেষ্টা তা হলে ব্যর্থ হয় নি। হয়তো অন্য সূত্রেও যথার্থ খবর তাদের কাছে পৌঁছে থাকবে। আমার বাহাদুরি নেবার কিছু নেই। নিপীড়িত বাংলার মর্মন্তুদ কাহিনী বিশ্বের দরবারে পৌঁছুক এটাই আজ কাম্য। সেসব খবরের উৎস বা সূত্র যা-ই হোক না কেন।

৯/৭

ভেনেজিউলার একটি ক্যাথলিক সংবাদপত্র বলেছে (আ.বা.সংবাদ) যে পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে তাতে স্বয়ং যীশু খ্রিস্টও আঁতকে উঠতেন।…

১৩/৭

…মগবাজারের ওয়্যারলেস স্টেশন আক্রমণ করা হয়। প্রহরারত দুই সেনাকে খতম করে মুক্তিবাহিনীর লোকরা সরে পড়ে।

সম্প্রতি মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতা ঢাকা শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে- বৃদ্ধি পেয়েছে।…

২৬/৭

আজ হঠাৎ আমার ট্রানজিস্টারের চাবিটা ঘোরাতেই পেয়ে গেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। তখন কৌতূহল হলো ওদের সংবাদ শোনার জন্য। খানিক বাদেই খবর শুরু হলো। … সব খবরই শুনলাম, তার মধ্যে দু’তিনটে খবর আজ সারাদিন বারবার আমার মনে পড়ছে। খবর দু’টির মধ্যে একটি এই : পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর Willie Brandt নাকি President Nixon I U. Thant-এর কাছে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে লিখেছেন। তাঁর পত্রের বিষয়বস্তু হলো, বাংলাদেশে একটা আন্ত:রাজনৈতিক সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়।…

১৪/৮

আজ গভর্নর Salute গ্রহণ করেননি। ঢাকার রাজপথে কোনো লোকজন ছিল না। সারা শহরটা ছিল মৃত। গাড়ি-ঘোড়া কিছুই চলেনি, ঢাকা একদম বন্ধ ছিল। কেবল জিন্নাহ্ অ্যাভেন্যু ও আশপাশের অঞ্চলে বহুসংখ্যক সৈন্য ও সামরিক আয়োজন ছিল। তা ছিল যেন আসন্ন যুদ্ধের জন্য সমরসজ্জা।

১৬/৮

শেখ মুজিবরের বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব-ব্যাপি আন্দোলন শুরু করতে চাচ্ছে Socialist International.

১৭/৮

রাজাকাররা কারা? তাদের মাইনে দেওয়া হয় ও কম মূল্যে রেশন দেওয়া হয়। কোথা থেকে দেয়া হয়?…

৩০/৮

গেল রাতে যাত্রাবাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। মুক্তিবাহিনীর লোক ও সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। এমন একটা দিন নেই যেদিন ঢাকা শহরের কোথাও না কোথাও রোজ মুক্তিবাহিনী শত্রুদের দু’দশজনকে খতম না করে ছাড়ছে না। তারা অবস্থা স্বাভাবিক হতে দেবে না।

৪/৯

চার তারিখের আরেকটি খবর (স্বা. বা. রেডিওতে শোনা) বড়ো চমকপ্রদ। অনিরুদ্ধ পাকিস্তানি সাহায্য (মাসিক ৩৫০ টাকা) গ্রহণ করতে

অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। বলেছে, তার পিতা যদি অসুস্থ না হতেন তাহলে তিনি পাক সরকারের সাহায্যকে কঠোরতম ভাষায় সমালোচনা করতেন। অতএব লাখো মানুষের রক্ত-সিক্ত পাকিস্তানি সাহায্য নজরুল-সন্তানরা গ্রহণ করতে পারে না। পিতার যোগ্য পুত্রের মতোই উত্তর দিয়েছে অনিরুদ্ধ।…

১০/৯

আজ রাতে (দিবাগত) শুনলাম, জাহানারা ইমামের বড় ছেলেটিকে ধরে নিয়ে গেছে বা ছেলেটি ধরা পড়েছে। বড় দুঃখের কথা। জাহানারা কি করে সহ্য করছেন?…

একই সময়ে কাপাসিয়া অঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম ঘেরাও করে নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা করা হয়েছে, সমানে লুট, নির্যাতন, নারীধর্ষণ চলেছে। উল্লেখ্য, ও অঞ্চলটায় তাজউদ্দীনের পৈতৃক বাসভূমি, ওর গ্রামের নামটা আমার জানা নেই।

২৭/৯

আ. বাণী. ডক্টর মযহারুল ইসলাম বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করা ভুল হয়েছে।…

কৃষ্ণ মেনন বলেছেন, (মাদ্রাজের কোয়েম্বাটুরে না অপর কোথাও) বাংলাদেশকে আশু

স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এখনই উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে পূর্ব পাকিস্তানকে অস্বীকার করা।

২৫ নভেম্বর

রাত চারটা থেকে আটির ওদিকে অপারেশন শুরু হয়। ভাওয়াল-মনোহরিয়ার খাঁ-রা আমার পরিচিত। মিঃ মান্নান খাঁ সাহেবের বড় ছেলে আমার ছাত্র। ওর ভাই মোহাম্মদ মহীউদ্দীন খান আটি (তায়নগর) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান- আওয়ামী লীগ Supporter. তাদের বাড়িটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সারাটা বাড়ি ভস্মীভূত। প্রাচীনকালের জিনিসপত্র বিনষ্ট করে ফেলে। কলাতিয়া পর্যন্ত প্রায় ২/৩ শত লোককে গুলি করে মারা হয়।

লেখক : প্রফেসর, বাংলা বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x