তানভীর সালেহীন ইমন পিপিএম
মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন পুলিশ লাইন্সে প্রতিরোধ যুদ্ধ সূচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা জেলা পুলিশের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ সেনানিবাস ছিলো কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস। ভৌগোলিক অবস্থান থেকে কুমিল্লার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ছিলো কুমিল্লা। পার্বত্য জেলাগুলো, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেট যেতে হতো কুমিল্লা হয়ে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সারাদেশের পুলিশ সদস্যদের মতো কুমিল্লার পুলিশ সদস্যরাও স্বাধীনতা ও মুক্তির অদম্য
স্পৃহায় উজ্জীবিত হন। তৎকালীন পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দীন আহমদ পুলিশ অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কর্মবিরতি ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ২২-২৩ মার্চ মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে কুমিল্লার পুলিশ সদস্যরা পুলিশ লাইন্সে সামনের রাস্তায় রাইফেল কাঁধে ‘রোড মার্চ’ করেন। স্লোগান দেন ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’।
২৪ মার্চ ময়নামতি সেনানিবাস থেকে পুলিশ লাইন্সে সম্ভাব্য আক্রমণের সংবাদ আসতে থাকলেও পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দীন আহমদ সশরীরে পুলিশ লাইন্সে অবস্থান নেন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষণের কথা বলেন যে ‘যা আছে তা নিয়েই আমরা প্রস্তুত থাকবো ও শত্রুর মোকাবেলা করবো। ২৫ মার্চ থমথমে পরিস্থিতিতে সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার রোলকলে পুলিশ লাইন্সে উপস্থিত হন এবং সবার মনোবল অটুট রাখতে তেজোদীপ্ত ভাষণে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ পুলিশ সদস্যদের দিয়ে দিতে বলেন সম্ভাব্য প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে।
অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনায় পাকিস্তানীরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, রংপুর সৈয়দপুরসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বিশেষত সেনানিবাসের শহরগুলো আক্রমণের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ময়নামতি সেনানিবাস থেকে কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্ আক্রমণ করে।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এক সাক্ষাৎকারে জানান “২৫ মার্চ একটি হেলিকপ্টারে করে খাদিম হোসেন রাজাসহ কয়েকজন পাকিস্তানী জেনারেল ময়নামতি সেনানিবাসে আসেন। তারা একটি সিল করা প্যাকেট জিওসিকে হস্তান্তর করে দ্রুত চলে যান। ময়নামতি সেনানিবাসে প্রাথমিক কাজগুলো তারা দ্রুত সেরে ফেলেন। বিনা প্রতিরোধে পাকিস্তানী ইউনিটগুলো বাঙালি সেনা ও তাদের পরিবার পরিজনকে বন্দি করে ফেলে। অপারেশন সার্চ লাইটের কুমিল্লা পরিকল্পনা নিয়ে আসা প্রসঙ্গে খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন ‘একটি জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ মিশন কাঁধে নিয়ে আমি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম’।
২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে পাকিস্তানী পদাতিক বাহিনী কুমিল্লা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আনুমানিক ১.০০ টার দিকে তাদের সাঁজোয়া বহর আলো নিভিয়ে পুলিশ লাইন্সে কাছাকাছি চলে আসে। প্রথমেই তারা পুলিশ লাইন্সে মূল ফটক খুলতে বললে প্রহরারত পুলিশ সদস্যরা আরআই ও ফোর্স সুবেদারকে জানাতে গেলে কালবিলম্ব না করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও মর্টারের গুলির শব্দে বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। প্রায় দুই ঘন্টা চলে প্রতিরোধ যুদ্ধ। পুলিশ লাইন্সে আলো না থাকায় এক পর্যায়ে ট্রেসার বুলেট ছুড়ে পুলিশ সদস্যদের খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। ভোরের দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পুলিশ লাইন্সে ভেতরে প্রবেশ করে। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় পুলিশ সদস্যদের তখন আর প্রতিরোধের সক্ষমতা ছিলোনা। নির্বিচারে তখন তাদের যাকে যেখানে পাওয়া গেছে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। অনেক পুলিশ সদস্য উত্তর পাশের ধান ক্ষেত দিয়ে পুলিশ লাইনস্-এ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে পারলেও যারা আটকা পড়েছিলেন তাদের গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী।
শহীদ পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগই ছিলো রিক্রুট সদস্য। পুলিশ হাসপাতালে গিয়েও হত্যাকান্ড চালায় নরঘাতক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। শহীদ পুলিশ সদস্যদের লাশ বস্তাবন্দি করে নেয়া হয় সদর হাসপাতালে আর জীবিতদের বন্দি করে নেয়া হয় কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে। অস্ত্রাগারের চাবির জন্যে আরআই এবিএম আব্দুল হালিমের বাসা তছনছ করা হয়। আরআইসহ তার কলেজ পড়ুয়া দুই সন্তানকে পরবর্তীতে হত্যা করে পাকিস্তানী সৈন্যরা। পরের দিন সকালে পাকিস্তানী বাহিনী পুলিশ সদস্যদের খোঁজে পুলিশ লাইন্সে আশপাশে বিভিন্ন ঘর বাড়ি তল্লাশি করে। সেখানে বিভিন্ন বসত ভিটা তছনছ করে অনেক সাধারণ মানুষকেও মারধর করে।
২৫ মার্চ রাতেই কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দীন আহমেদকে এবং জেলা প্রশাসক একেএম শামসুল হক খানকে আটক করে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরবর্তীতে পাশবিক নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
লেখক : অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি ।
0 Comments