তানভীর সালেহীন ইমন পিপিএম
মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অকুতোভয় সদস্যদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা ও আত্মত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সর্বজনবিদিত। রাজারবাগের পাশাপাশি কুমিল্লাসহ দেশের অন্য পুলিশ লাইনস্ওে বীরত্বগাথা ইতিহাসের অগ্নিসাক্ষী।
কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দীন আহমদসহ কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্ ও কুমিল্লা জেলার পুলিশ সদস্য হিসেবে অন্যত্র কর্মরত অবস্থায় দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে অনেকেই জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লার ৩৫ জন পুলিশ সদস্যের আত্মাহূতির ইতিহাস সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। অনেক ইতিহাস এখনো অজানাই রয়ে গেছে। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সংগ্রহে সরকারী ও ব্যক্তি উদ্যোগে এখনও অনেক গবেষণা চলমান।
কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দীন আহমদ ১৯৭০ এর নির্বাচনের কয়েক মাস আগে আগস্ট মাসের ১৮ তারিখ কুমিল্লায় যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ছিলো তাঁর দৃপ্ত অবস্থান। অগ্নিগর্ভ ’৭১-এর মার্চে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণায় কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্রে সামনের সড়কে পুলিশ সদস্যরা রাইফেল হাতে বাংলাদেশের সমর্থনে ‘রোড মার্চ’ করে। পাকিস্তানিদের দ্বারা সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে ২৪ মার্চ সশরীরে সারা রাত পুলিশ লাইনস্-এ অবস্থান করে ফোর্সদের উজ্জীবিত করেন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় রোল কলে পুলিশ লাইনেস্ নিজে উপস্থিত হয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন হয়ে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি প্রতিহতের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন। রাতে সার্কিট হাউসে অবস্থান করে জেলা প্রশাসকসহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। গভীর রাতে বাসায় আসেন। পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দীন আহমদ-এর নির্দেশনা পুলিশ সদস্যরা জীবন দিয়ে পালন করেছে। অস্ত্রাগারের চাবি না দিয়ে সারারাত প্রতিরোধ যুদ্ধ চলেছে কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্।ে ক্যাপ্টেন বোখারী ভোর হওয়ার আগেই তাঁকে পুলিশ সুপারের বাসভবন থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। পাকিস্তানিদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ও শর্ত মেনে না নেওয়ায় ৩০ মার্চ তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার হিসেবে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করে।
শহীদ খগেন্দ্রলাল চাকমা ১৯৭১ সালে কুমিল্লার মুরাদনগরে সার্কেল ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাঘাতের উদ্দেশ্য ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কের ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজটি ভেঙে দেয়ার পরিকল্পনায় তিনি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন সংবাদ জানতে পেরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে আটক করে নিয়ে গিয়ে ৫ মে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
শহীদ প্রফুল্ল কুমার দে ১৯৭১ সালে কোর্ট ইন্সপেক্টর হিসেবে কুমিল্লায় কর্মরত ছিলেন। অত্যন্ত সংস্কৃতি অন্তঃপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। ২৫ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্-এ অবস্থান করছিলেন। রাতে হানাদাররা ব্যাপক নির্যাতন করে কোনোমতে ভোরে বাসায় আসতে সক্ষম হলেও ২৬ মার্চ সকাল বেলায় পাকিস্তানি হানাদাররা বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় আর কখনো ফিরে আসেননি। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক তাঁর পরিবারকে এককালীন দুই হাজার টাকা দেয়া হয়।
শহীদ এবিএম আব্দুল হালিম ১৯৭১ সালে কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্-এ রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আর আই) হিসেবে যোগদান করেন। শুরু থেকেই তিনি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ভূমিকা রাখেন। মার্চের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ‘রোড মার্চের’ নেতৃত্ব দেন। ২৫ মার্চ অস্ত্রাগারের চাবি না দিয়ে কৌশলী অবস্থান নেন যেন পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে খুঁজে না পায়। চাবির সন্ধানে তাঁর বাসায় তল্লাশি ও তছনছ করা হয়। পরিবারের সদস্যদের উপর চলে নির্যাতন ও নিপীড়ন। পরিবারের সদস্যদের সম্ভাব্য হত্যার হাত থেকে বাঁচাতে আরআই এবিএম আব্দুল হালিম ২৮ তারিখ নিজেই ধরা দেন হানাদারদের হাতে। ক্যাপ্টেন বোখারী তাঁকে এবং কলেজ পড়–য়া আদরের দুই ছেলে খন্দকার মোস্তফিজুর রহমান (লুলু) ও খন্দকার মুশফিকুর রহমান (বকু) কে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তথ্যসূত্র :
মামুন সিদ্দিকী, ১৯৭১ কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্, ঢাকা, ইফাত প্রেস ২০১৭
লেখক : অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি।