ই-পেপার

মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের উজ্জ্বল ও স্মরণীয় ভূমিকা সম্বন্ধে কিছু চুম্বক কথা বর্তমান প্রজন্মের পুলিশের জানা অবশ্য কর্তব্য। অল্প কথায় অতি জরুরি ঘটনাগুলো বলার চেষ্টা করেছি এই রচনায়। যুদ্ধ শুরুর সূচনা লগ্ন থেকে দীর্ঘ নয় মাস পুলিশ বাহিনীর আত্মত্যাগের ইতিহাসের প্রসঙ্গ অনুসন্ধিৎসু মনের মণিকোঠায় অবশ্যই ধরা দেবে। সেই সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ এবং বিস্তীর্ণ ক্যানভাস এই ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তবে আমার এই লেখা যদি নতুন প্রজন্মের অনুসন্ধিৎসু মনে পুলিশ বাহিনীর এই বিশাল ও দীর্ঘ ঐতিহ্য সম্বন্ধে গভীরতর গবেষণার উদ্যোগ সৃষ্টি করে, তাহলে আমার এই সংক্ষিপ্ত লেখাটি সার্থক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকার প্রসঙ্গ এলে দুটো বিষয় স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসে। প্রথমত: পাকিস্তান বাহিনীর সহিংস আক্রমণ পুলিশ বাহিনীকে দাবায় রাখতে পারেনি। বরং পুলিশ পাকিস্তানি কামান, বন্দুক, ট্যাংকের বিরুদ্ধে লড়াই করে ওদের অগ্রযাত্রাকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের দম্ভোক্তি ‘বাংলাদেশকে পোড়ামাটির দেশে পরিণত করতে হবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল পুলিশের বুলেটের আঘাতে। সামান্য থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলির শক্তি ও তেজ স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র ট্যাংকের গুলির চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী- একতাবদ্ধ মানুষের শক্তি পরাক্রমশালী স্বৈরাচারের শক্তির চেয়ে বহুগুণ শক্তি ধারণ করে, এই কথাটাও সেদিন রাজারবাগের পবিত্র অঙ্গনে উৎসারিত বাঙালি পুলিশের রক্তের স্রোত প্রমাণ করে দিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত : পাকিস্তান বাহিনীর পৈশাচিক আক্রমণ, পুলিশের প্রতি তাদের ঘৃণা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ রূপে যখন রাজারবাগের সবুজ প্রান্তর পুলিশের বুকের রক্তে রঞ্জিত করেছিল তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্-এ অবস্থিত ওয়্যারলেস গর্জে উঠেছিল। ওয়্যারলেস সেটের ওই গর্জন মুহূর্তের মধ্যে ইথার তরঙ্গে ভেসে- সারা বাংলাদেশের মানুষকে জানিয়ে দিয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্ আক্রান্ত, প্রকারান্তরে বাঙালি জনগোষ্ঠী আক্রান্ত সুতরাং সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। ওয়্যারলেস-এর মাধ্যমে পাঠানো এ আহ্বান সারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সাধারণ ও অরাজনৈতিক জনমানুষকে মুহূর্তের মধ্যে একতাবদ্ধ করে পুলিশের সব হাতিয়ার জনগণের মধ্যে বিতরণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। পুলিশ ও জনগণের মধ্যে মানসিক সাযুজ্য সৃষ্টি হলো। পুলিশ-জনতা একত্র হয়ে সশস্ত্র বাহিনীর রূপ ধারণ করে থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো মৃত্যুকে উপেক্ষা করে। এই দুটো কারণে পুলিশের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে অসীম তাৎপর্য বহন করে। মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে অসম সাহসী পুলিশ ভাইদের আত্মত্যাগ -রক্তদান তথা জীবন উৎসর্গকরণ এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, থাকবে।

আরো একটি কারণে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা তাৎপর্য বহন করে। পাকিস্তান আমলে বেসামরিক অথবা আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে পুলিশের সদস্য সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। এবং এই সদস্যদের সিংহভাগই ছিল বাঙালি। হাতেগোনা কয়েকজন অবাঙালি হাবিলদার সুবেদার থাকলেও তাদের সাধারণ সদস্যদের প্রতি মমত্ববোধ ছিল না। তারা নিজেদের সব সময় উঁচু মর্যাদাবান মনে করে বাঙালিদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত। পক্ষান্তরে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাঙালি জনসাধারণ এবং পুলিশের মধ্যে একটা অলিখিত বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে সাধারণ পুলিশ এবং সাধারণ জনগণ পর¯পরের প্রতি সহনশীল বন্ধুত্বপূর্ণ ও নির্ভরশীল ছিলেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্-এ হাতেগোনা অবাঙালিদের সঙ্গে বাঙালি কনস্টেবলদের খোঁটাখুঁটি লেগেই

থাকত। এই কারণে ’৭০-এর নির্বাচনের পর বাঙালিরা যখন ধীরে ধীরে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠিত হচ্ছিল তখন পুলিশ এ স্রোতের বাইরে ছিল না। মানসিক ও প্রাসঙ্গিকভাবে তারা বঙ্গবন্ধুর হুকুম-আহকাম মেনে চলছিল। বিশেষভাবে বাঙালিদের উপর নির্যাতনের জন্য অথবা নেতাদের আটকের জন্য বাঙালি পুলিশকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭০-এর নির্বাচন থেকে শুরু করে অগ্নিঝরা মার্চের ভয়াবহ আন্দোলনের মধ্যে বাঙালি পুলিশকে দিয়ে পাকিস্তানিরা কখনোই আন্দোলনরত মিছিল কিংবা সভার উপরে গুলি বর্ষণ করাতে পারেনি। তখন বাঙালিরা গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রয়োজনে অবাঙালিদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত।

পাকিস্তানি প্রশাসনের কাছে পুলিশের এরকম ব্যবহার কোনোক্রমে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ক্রমাগত পুলিশের, সরকারি মনোভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কারণে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের প্রতি তাদের আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশের কারণে, স্বৈরাচারী সরকারের সামরিক ও ঊর্ধ্বতন আমলারা বাঙালি পুলিশের উপর ক্রমান্বয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে পাকিস্তানি জেনারেল ও গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আকবরের সঙ্গে তৎকালীন পুলিশের আইজিপি তসলিম আহমদের বিতণ্ডার মাধ্যমে। ৭ই মার্চের পর একদিন জেনারেল আকবর সেনাবাহিনীর কন্ট্রোলরুম থেকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আগমন করেন। উপস্থিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। ওই সময়ে ওই বিতণ্ডার ধরন এরূপ ছিল, ‘বর্তমানে পুলিশ বিভাগ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না।’ উত্তরে পুলিশের আইজি  বলেন, ‘আপনারা নিজেরাই সব উল্টাপাল্টা কাজ করছেন আর দোষ দিচ্ছেন আমাদের। আপনাদের উচিত রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করা।’ আইজিপি সাহেবের এই উত্তর পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ফলে কিছুদিন পরে তসলিম আহমদকে তাঁর অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমনিভাবে ফেব্রুয়ারির শেষে রাওয়ালপিন্ডিতে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে কনফারেন্সে পূর্ব পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি জনাব মেজবাহউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের এই সভায় একসময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও যুক্ত হন। এই কনফারেন্সে পূর্ব পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণসহ উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘শক্তি প্রয়োগ করে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে আর নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয়ভাবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সম্মতি থাকতে হবে।’ মেজবাহ উদ্দিন সাহেবের এই উক্তিটিও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মনপূত হয়নি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, তৎকালীন আইজিপি জনাব তসলিম আহমদ অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই পুলিশ বাহিনীর অস্ত্র আইনগতভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর অধীন পুলিশ সুপারদের ইঙ্গিত দেন। সারাদেশে আনসারদের মধ্যে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র হস্তান্তর করার জন্য অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত আনসার সদস্যদের কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য পুলিশের রাইফেল বণ্টন করা হয়। এ হাজার হাজার হাতিয়ার পুলিশের অস্ত্রাগারে ফেরত পাঠানোর আগেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ফলে এসব অস্ত্র জনগণের হাতে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের বাঙালি নীতিনির্ধারকরা ভবিষ্যতে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভেবে এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলেন। এ সময় পুলিশের অস্ত্রাগারে মজুদকৃত অস্ত্র বাঙালির হাতে বৈধভাবে তুলে দিতে অধিক সংখ্যক আনসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক গোপন পরিকল্পনার আওতায় ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি জেলায় এসপিদের কাছে সিগন্যাল-এর মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অধিকসংখ্যক আনসার নিয়োগ-এর সুযোগে তাদের মধ্যে অস্ত্র বণ্টন করা হয়। জেনারেল রাও ফরমান আলী তার বইতে লিখেছেন, ‘প্রশাসনের ওপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ থাকায় পুলিশের তত্ত্বাবধানে রক্ষিত রাইফেল আনসার মুজাহিদদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিরোধ যুদ্ধে এই অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রপ্রাপ্তির প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত।’ পরবর্তীকালে পাকসেনাদের কাছে এই অস্ত্র হস্তান্তরের জন্য পুলিশ অফিসারদের জবাবদিহি করতে হয়েছিল। সেদিন যদি পুলিশ বাহিনী এ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হতো, তাহলে পাকিস্তান সামরিক জান্তা পুলিশের অস্ত্রগুলো তাদের করায়ত্তে নিয়ে আমাদের অস্ত্র সংগ্রহের ভিত্তি ও শক্তি খর্ব করে ফেলতো। এ প্রসঙ্গে তসলিম সাহেবের কার্যকলাপ ও ইশারা-ইঙ্গিত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে এমন প্রতিটি জন্মায় যে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের পক্ষে বাঙালি পুলিশের অনুগত থাকা সমীচীন হবে না, বরং বাংলার স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা-ই সময়ের দাবি। এই কথার সত্যতা মেলে পাকিস্তানের জেনারেল রাও ফরমান আলীর লেখা বইয়ে। রাও ফরমান আলী লিখেছেন, ‘পুলিশ প্রধান সবার আগে তার বাহিনীসহ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ কমান্ডের হাতে ক্রীড়ণকে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিলেন।’ সেই সময় ও পরিবেশে আইজিপি সাহেবের জন্য এটা ছিলো পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চরম বিরোধিতা। এবং এটা পরিষ্কারভাবেই পাকিস্তানি জেনারেলদের চোখে ধরা পড়েছিল। ফলে তিনি ২৬শে মার্চ চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন।

পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি পুলিশের মনোভাব যে বিমাতাসুলভ ছিল তার আরো প্রমাণ আছে। পাকিস্তানিরা জানতো যে বাঙালির সঙ্গে তাদের যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে সমাধানযোগ্য নয়। তারা ধারণা করেছিল বাঙালিদের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী সংঘাতের পথে রক্তপাত হতে পারে। সে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য তারা কূটচালের মাধ্যমে যে কোনোভাবেই আওয়ামী

নেতৃত্বকে বন্দি করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা কয়েকটা টিমে ভাগ করে সম্ভাব্য গ্রেপ্তারের তালিকাও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সামরিক বাহিনী কোনো অবস্থাতেই পুলিশের সাহায্য ছাড়া বাঙালি নেতাদের আটক করতে সমর্থ হচ্ছিলেন না। পুলিশের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য যখনই এই তালিকা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় তখনই সব নেতা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-ই তাদের হাতে গ্রেফতার হন। কেন তিনি গ্রেফতার বরণ করেন সে ইতিহাস সবার জানা। এ প্রসঙ্গে রাও ফরমান আলীর কথা প্রণিধানযোগ্য। ‘পুলিশ বিভাগের সকল স্তরের বাঙালি সদস্যদের পরিকল্পিত প্রশাসনিক অসহযোগ সেইসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীল নকশাকে ব্যর্থ করে দেয়। পুলিশের সহযোগিতা ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির পক্ষে তাদের (বাঙালি নেতাদের) চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একমাত্র শেখ মুজিব ছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্য কোনো নেতাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।’

৪ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ওই দিন সারা দেশে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এইদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্-এর সব বাঙালি সদস্য জয় বাংলা স্লোগান- এর মধ্য দিয়ে রাজপথে মিছিলের সঙ্গে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করে। পুলিশ আরও একটা কাজ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তারা ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর নীরবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে এবং সব বাঙালি পুলিশ সদস্যদের দাবির মুখে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্রে অস্ত্রাগারের সামনে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। এমনকি প্রেসিডেন্টের ডিউটিতে নিয়োজিত ট্রাক ও জিপে কালো পতাকা উড়িয়ে ডিউটি করে। পূর্ব পাকিস্তানের শেষ সময় কর্তব্যরত বেসামরিক কিংবা অন্য কোনো অসামরিক অথবা আধা সামরিক বাহিনী এরূপ প্রকাশ্য বিদ্রোহ প্রদর্শন করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি পুলিশ বাহিনীর সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মানসিক ও আত্মিক সংযোগ ছিল জনসাধারণের সঙ্গে, জনসাধারণের আন্দোলনের সঙ্গে। এ কারণেই দীর্ঘ অসহযোগ আন্দোলনের পূর্ণ সময় ধরে পুলিশ বাহিনী নীরবে কিংবা সরবে প্রয়োজন মাফিক দেশে চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। আর এ কাজটি সম্পূর্ণ গোপনে কিংবা নীরবে করা সম্ভব হয়নি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ পর্বে সাধারণ পুলিশসহ সিনিয়র কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অধিকসংখ্যক প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। রাজশাহীর ডিআইজি মামুন মাহমুদ, চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হক, রাজশাহীর এসপি শাহ আব্দুল মজিদ, খুলনার সুবেদার জয়নাল আবেদীন, পিরোজপুর-এর এস.ডি.পি.ও ফয়জুর রহমান, নোয়াখালীর এসপি সস্ত্রীক পুলিশ সুপার আব্দুল হাকিম এদের মধ্যে অন্যতম।

এসব বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদান নিয়ে বর্তমান বিশাল পুলিশ বাহিনীর গর্ব করার অনেক কিছু আছে। এছাড়া বর্তমান পুলিশ বাহিনী বাংলাদেশকে সুরক্ষায় চরমপন্থী জঙ্গিবাদ, অগ্নি সন্ত্রাস, জামায়াতে ইসলামের রাজনৈতিক সন্ত্রাস, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দেশব্যাপী জনমনে শান্তি বিঘ্নকারি নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করে দেশের উন্নয়নের গতিধারাকে সমুন্নত রেখেছে। বিগত দুই বছরের কোভিড-১৯ প্রাণঘাতী মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম সারির সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে কাজগুলো ডাক্তার ও নার্স সঠিকভাবে করতে ব্যর্থ হয়েছে, সে কাজগুলো তারা নির্দ্বিধায় করেছে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে। এজন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ১০৭ পুলিশ সদস্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তিন হাজারের অধিক পুলিশ সদস্য কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। সেবার মাধ্যমে জনগণের প্রাণ বাঁচাতে এবং মহামারির ফলে মৃতদেহ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে সৎকারের পদক্ষেপ নিতে তাদের এ মূল্য দিতে হয়েছে। এই কঠিন যুদ্ধে অবারিত সেবাদান পুলিশকে জনগণের কাছে নিয়ে গেছে। আর সত্যিকার অর্থে পুলিশ বাহিনী জনগণের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা বিনির্মাণে পুলিশের অংশীদারিত্ব- বাংলার মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার মতোই উজ্জ্বল হয়ে- ধ্রুবতারার মতো চিরকাল জ্বলবে।

মাভৈঃ। জয় বাংলা।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক এস.পি, ঢাকা জেলা।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)