যথাসময়ে থানায় এসে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাজ্জাদ। তবে কাজের ফাঁকে মনের কোনে উঁকি দেয় সন্দেহের ধূম্র। কাল রাতের ঘটনাটা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না সাজ্জাদ। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, ‘কি নাম ছিল ওই এলাকার?’
মনে মনে বিরক্ত হয়। কাল ঘুরে আসলাম আর আজই মনে করতে পারছি না। কথায় বলে, পুলিশের যদি কোনো কিছুতে সন্দেহ হয়, তাহলে সমুদ্রের নিচ থেকেও মাটি তুলে আনতে পারে। তবে সাজ্জাদের সন্দেহের তীর এখনো এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কি ছিল, কে ছিল, কেন ঝড়ের মধ্যেই তাকে ওখানে যেতে হলো। এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।
সজিব বুঝতে পারে, সাজ্জাদ কিছু নিয়ে চিন্তিত। তাই নিজেই প্রশ্ন করে,
‘কি হয়েছে তোর?’
সজিবের কথা শুনে চমকে ওঠে। তারপর বলে,
‘না রে, তেমন কিছু না।’
‘তুই বললেই হলো? কিছুতো একটা হয়েছে।’
‘হু। তুই সত্যি বলেছিস। কিছু একটা হয়েছে। তবে কি হয়েছে সেটা এখনো বুঝতে পারছি না।’
‘আমাকে বলবি তো বিষয়টা কি? কোনো প্রেমঘটিত?’
সজিবের কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে সাজ্জাদ। তারপর বলে,
‘তোর মনের মধ্যে সব সময় প্রেম সংক্রান্ত জটিলতা ঘুরপাক খায় কেন বলতো?’
‘আরে আমি সত্যি কথা বললাম, আর তুই এই কথা বলছিস?’
‘কোনটা সত্যি কথা? আমার প্রেমে পড়া? নাকি তোর প্রেমের মধ্যে বিচরণ করা।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, এবার তাহলে সত্যি কথাটা বল। কি হয়েছে? আমি দেখছি সেই সকাল থেকে তোর মন কেমন চিন্তিত। আচ্ছা বাড়ি থেকে কোন খারাপ খবর এসেছে?’
সজিবের মুখ থেকে বাড়ির কথা উঠতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠছে মায়ের কথা। পৃথিবীতে সকল মুশকিলের সহজ সমাধানের নামই হচ্ছে মা।
তখন জেলা স্কুলে হোস্টেলে থেকে পড়ে সাজ্জাদ। ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছে। এক দুপুরে লেপু বলল,
‘সাজ্জাদ চল আমরা পিকনিক করি।’
কিন্তু পিকনিক করতে হলে তো মুরগি লাগবে। সকলেই মনে মনে চিন্তিত। কিভাবে পিকনিক করা যায়? বর্ষা হলে বিলে অনেক হাঁস পাওয়া যেত। এখন তো গ্রীষ্ম কাল এ সময়ে হাঁস, বা পাখি কিছুই পাওয়া সম্ভব না। মুরগি আনতে হলে তো রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ অধিকাংশ বাড়িতেই মুরগি উঠানে খাঁচায় পোষা হয়। বন্ধুরা চুপচাপ ভাবতে থাকে। ঠিক তখন ওরা দেখতে পায়, মাঠের মধ্যে একটা বাচ্চা ছাগল ঘাস খাচ্ছে। এটাকে দেখার সাথে সাথে হাচিপ বলে,
‘সাজ্জাদ আমরা যদি এই ছাগলের বাচ্চাটা জবাই দেই?’
হাচিপের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লেপু বলে,
‘হাচিপ ঠিক কয়েছে। আমরা তো কোনদিন ছাগলের বাচ্চা খাই নাই, তাই?’
দুই বন্ধুর কথায় রাজি হয়ে যায় সাজ্জাদ। তারপর ছাগলের বাচ্চাটাকে ধরে জবাই করে। কিন্তু ছাগলের চামড়া ছাড়িয়ে মাংস বের করা খুব কঠিন কাজ। তাছাড়া তাদের মধ্যে কেউই কোনোদিন এ কাজ করে নাই। একে একে অন্য বন্ধুরা সেখানে উপস্থিত হয়। অবশেষে ৫/৬ বন্ধুরা মিলে কলাপাতা কেটে আনে। এক বন্ধু তাদের বাড়ি থেকে ধারালো দা নিয়ে আসে। তারপর সকলে মিলে মাঠের মধ্যেই ছাগলের চামড়া ছাড়িয়ে মাংস তৈরির আয়োজন করে।
দিন গড়িয়ে রাত হয়েছে বেশ খানিকটা। বাড়ির উঠানে পা রাখতেই দেখে, মা অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। মাকে এতটা উতলা কখনো দেখেনি সাজ্জাদ। তাহলে কি তার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে বলে, অস্থির হয়ে পায়চারি করছে? একটু খেয়াল করে দেখে। তারপর মনে মনে বলে, না তাও না। তাহলে তো তাকে দেখে থেমে যাবার কথা। অন্তত কাছে এসে বলার কথা, কেন দেরি হয়েছে। ক্ষিদে লেগেছে কি না? মনে মনে একটু ভয় পেয়ে যায়। তারপর সাজ্জাদ নিজেই কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
‘মা কি হয়েছে? তুমি এত অস্থির কেন?’
‘আর বলিস না। আমাদের কালু তো বাড়ি আসে নাই।’
সাজ্জাদের মা ছাগলের দুটি বাচ্চাকে কালু আর ধলু নামে ডাকতো। বাড়িতে মোট ৫টি ছাগল। বাচ্চা দুটির বয়স বেশি না। কেবল বড় হয়ে উঠছিল। মাঠে ছাড়া থাকে, কচি ঘাস খায় বলে দেখতে নাদুস-নুদুস হয়েছে।
মায়ের কথা শুনে নিজের মনে খটকা লাগে, তাহলে তারা যেটা জবাই দিয়েছে, সেটা ছিল না তো?
শ্বাস ঘন হয়ে আসে। অন্যায় করেছে বুঝতে পেরে নিজের মধ্যে পাপবোধ জন্মায়। মায়ের এত আদরের ছাগল। না বুঝে খেয়ে ফেলেছে। মনের মধ্যে সান্ত¡না খোঁজে,
‘আমি তো খেতে চাইনি। ওই লেপু যদি পরামর্শ না দিতো, তাহলে কি এমনটা হতো।’
কোন সান্ত¡নাতেই কাজ হচ্ছে না। এবার মায়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে নিজেই পায়চারি করতে থাকে। একটু পর বড় ভাই আসে। তাকে দেখে মা এগিয়ে আসে। কালুর কথা জিজ্ঞেস করতেই সোহেল জানায়, কোথাও কালুকে পাওয়া গেল না। আসে পাশের চাচি, চাচা ছুটে আসে। কেউ কোনো সমাধান দিতে না পেরে একে একে সকলেই স্থান ত্যাগ করে।
বাড়িতে তিনজন মানুষ। কারও মনে শান্তি নেই। মায়ের চোখ ছলছল করতে থাকে। বাচ্চা ছাগলগুলো নিয়ে মাঠে যেতেন তিনি। আবার বিকাল হলে গোয়াল ঘরে রাখতেন। স্বামী মারা যাবার পর সবছোট সন্তান সাজ্জাদকে জেলা স্কুলে ভর্তি করেছে। সন্তানের মায়া ভুলতেই তিনি ছাগলগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মায়ের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছে না সাজ্জাদ।
সব কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে মা আবার সংসারের কাজে মন দেয়। ছেলেদের খেতে দিতে হবে। সাজ্জাদকে খেতে ডাকেন মা। বড় ভাই সোহেল ডাকে কিন্তু সাজ্জাদের পেটে কোনো জায়গা নেই।
কি করে থাকবে? মাংস রেডি করে লেপুর মায়ের কাছে গিয়ে বলেছে,
‘চাচি একটু রান্না করে দিবা?’
বাচ্চা ছেলেরা খেতে চেয়েছে লেপুর মা কি রান্না না করে দিয়ে পারে? রান্না শেষে, বড় এনামেলের গামলা ভর্তি ভাত আর মাংস নিয়ে ওরা আবার মাঠের মধ্যে যায়। অবশ্য লেপুর বাবার জন্য দুই টুকরা মাংস আর দুই টুকরা আলু রেখে গিয়েছিল। তবে ওদের না জানিয়ে এক বাটি মাংস লেপুর মা সরিয়ে রেখেছিল।
পরদিন সকালে লেপুর মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে সাজ্জাদের। ডাকাডাকি শুনে সাজ্জাদের মা কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে বউ? আমার সাজ্জাদকে ডাকছিস কেন?’
লেপুর মা বলেন,
‘রাতে লেপুর দাস্ত-বমি হয়েছে। সাজ্জাদের কি অবস্থা?’
লেপুর মায়ের কথা শুনে সাজ্জাদের মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘লেপুর দাস্ত হয়েছে?’
‘হ বুজি। কাল রাতে ওরা কয়টাতে মিলে ছাগলের গোস খাইছে। তারপর থেকে..’
‘ছাগলের গোস! কারা খাইলো?’
‘ক্যান তোমার সাজ্জাদ, আমার লেপু আরো তো ৪/৫ জন পোলাপান ছিল।’
সাজ্জাদ চোখ কচলাতে কচলাতে সেখানে এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখে লেপুর মা আবার বলে,
‘সাজ্জাদ তোরা যে কাল রাইতে ছাগলের গোস আর ভাত খাইতে গামলা নিয়েছিলি। আমার মাঝারি গামলা ফেরত দিস নাই।’
সাজ্জাদ বুঝতে পারে, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। সে একবার লেপুর মায়ের দিকে, একবার নিজের মায়ের দিকে তাকায়।
মা কোনো কথা বলে না। গভীর দৃষ্টিতে সাজ্জাদের দিকে তাকায়। সাজ্জাদ মায়ের দিকে তাকানোর সাহস পায় না। সে না বোঝার ভান করে, লেপুর মাকে নিয়ে যায় গামলা খুঁজে দেবে বলে।
দিন গড়িয়ে যায়। বাড়িতে আসে না সাজ্জাদ। এবার মা ভয় পেয়ে যায়, ছেলে কেন বাড়িতে আসে না। ছেলেকে খুঁজতে যায়। খুঁজে না পেয়ে বাড়িতে আসে সাজ্জাদের মা। বাড়ি ফিরে দেখে সাজ্জাদ একাই হাঁড়ি থেকে ভাত বেড়ে খাচ্ছে।
সাজ্জাদের মা দাওয়ায় বসে আছে। মা-ছেলে কোনো কথা হয় না। খাওয়া শেষ করে সাজ্জাদ বাড়ির পাশে আম গাছের নিচে দাঁড়ায়। মনের ভেতর ক্ষয়ে যেতে থাকে। তারপর গুটি গুটি পায়ে মায়ের পেছনে এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ পেছন থেকে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘মা তোমার কালুরে আমরা খেয়ে ফেলেছি।’
‘তুই এতবড় একটা কাজ করতে পারলি বাজান?’
‘কি করবো ছাগলের মাংস খাইনা কতোদিন হইছে। তয় কালুরে আমরা না জাইনা খাইছি।’
সোহেল হেঁটে আসে মা আর সাজ্জাদের দিকে। সোহেলকে দেখে মা ডুকরে কেঁদে ওঠে। বিলাপ করে বলতে থাকে,
‘ও সোহেল, তোর ভাইরে সামনের মাসের থিকা টাকা বাড়াইয়া দিবি। বাপ মরা ছাওয়াল আমার। ওর মনে হয় কতো কিছু খাইতে ইচ্ছা করে। টাকার অভাবে খাইতে পারে না।’
মায়ের কথা শুনে সোহেল আর সাজ্জাদ অবাক হয়ে যায়। কি বলে? কাছে এসে সোহলে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে মা?
‘তোর বাপ মরা ভাই। ওর ছাগলের গোস খাইতে ইচ্ছা করছিল। বলতেও পারে নাই কারুরে। এই জন্যে কালুরে জবাই কইরা খাইছে।’
মানুষ কতো অদ্ভুত। একদিন যে ছেলের জন্য তটস্থ থাকতো গ্রামের মানুষজন। কখন কার গাছের আম, জাম, ডাব খেয়ে ফেলবে। সেই ছেলে আজ খুন, গুমের রহস্য উন্মোচন করছে।
মোবাইলে ফেসবুক দেখছিল সজিব। কাজের ফাঁকে এখানে ডুব না দিলে যেন পৃথিবীটাই অন্ধকার। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে সজিব বলল,
‘একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে?’
‘কি ঘটেছে?’
‘একটা বয়স্ক মানুষ খুন হয়েছে’
‘হতেই পারে। এতে অদ্ভুত ঘটনার কি হলো?’
‘একটা মেয়ে খুন করেছে।’
এবার সাজ্জাদ একটু রেগে যায় সজিবের ওপর। তারপর বলে,
‘সজিব একটা মানুষ আরেকটা মানুষকেই খুন করে। বাঘে মানুষ মারলে খুন বলে না। এবার তুই থাম। চল ভেতরে চল।’
সজিব একটু মনখারাপ করে সাজ্জাদের সাথে সাথে ভেতরে গিয়ে বসে।
খুন হওয়া, এনকাউন্টারে আসামি নিহত হওয়া অথবা আসামি ধরা পড়া এখন মামুলি বিষয়। পত্রিকার পাতা খুললেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন এগুলো চোখের সামনে চলে আসে। আজকাল সাংবাদিকরাও খুঁজে খুঁজে খারাপ খবরগুলো দিয়ে পত্রিকা ভরে ফেলে। আচ্ছা দেশে কি কোন ভালো খবর নেই?
অনেক ভাবতে ভাবতে সাজ্জাদ গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে। সকালে উঠে পত্রিকা পড়া খুব একটা হয়ে ওঠে না। নিজের থানার খারাপ সংবাদগুলো শুনতে আর সমাধান করতেই দিন চলে যায়। এরপর আর অন্য থানা বা দেশের খবর নেওয়ার যেন সময়ই নেই। তবুও কেন যেন আজ পত্রিকাটা উল্টে দেখতে ইচ্ছে হলো। হতে পারে সজিবের দেওয়া খবরটাই তাকে টানছে। হয়তো সেই খবরটারই সন্ধান করছে সাজ্জাদ।
পত্রিকার পাতায় কোথাও সাজ্জাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তি নেই। দ্রুত পায়ে হেটে এসে সজিব আবার বলে,
‘এই তাড়াতাড়ি চল’
‘কোথায়?’
‘আমি তোকে বলতে ভুলে গেছি, এসপি স্যার ডেকেছেন’
‘আমাকে না তোকে?’
‘আমাকে আর তোকে না, সকলকে।’
‘কেন ডেকেছে, কিছু জানিস?’
‘জানি না, যেতে বলেছে চল যাই।’
সজিবের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে সাজ্জাদ। তারপর মনে মনে চিন্তা করে গত মাসে প্রমোশনের পরীক্ষা দিয়েছিল। সে ব্যাপারে কোনো আপডেট আছে কি না। প্রমোশনটা হয়ে গেলে ভালো হয়। সে তখন ইন্সপেক্টর হয়ে যাবে। মায়ের খুব ইচ্ছা সে একদিন বড় অফিসার হবে। প্রমোশন হলে নতুন কোথাও পোস্টিং হবে। ধীরে ধীরে সে মায়ের স্বপ্নপূরণের পথে পা বাড়াবে। এসব সাত-পাঁচ বিষয়ে ভাবতে ভাবতে সজিবের সাথে এগিয়ে যায়।
বড় মিটিং রুমে গিয়ে বসে আছে সাজ্জাদ। আশেপাশে আরো অনেকেই আছেন। এসপি স্যার এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। সকলেই ওঠে সেলুট দিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। এসপি স্যার সকলকে বসতে বলে, নিজেও চেয়ারে বসেন। তারপর বেশ গম্ভীর গলায় বলেন,
‘থানায় একটা অভিযোগ এসেছে। কথাটা সবাই জেনেছেন?’
প্রশ্ন করে সকলের দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থাকে এসপি স্যার। কিন্তু সামনে বসে থাকা কারো মুখ থেকে টু শব্দটিও আসে না।
এসপি স্যার ভীষণ রাশভারি মানুষ। মুখে কখনোই হাসি থাকে না। সাড়ে সাত ফুট লম্বা মানুষটিকে দেখলেই সকলে ভয় পেয়ে যায়। তিনি যখন কঠিন কোনো কথা বলেন, তখন চেহারা আরও কঠিন হয়ে যায়।
সামনে বসে থাকা কারো কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আবারও তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন,
‘এক সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তি খুন হয়েছেন। ভিকটিমের পরিবার সাসপেক্ট করছেন একটি মেয়েকে। মেয়েটির নামে খুনের মামলা করা হয়েছে। আশা করি সঠিক তদন্ত হবে। এবং প্রকৃত খুনিকে অ্যারেস্ট করা হবে। বাংলাদেশ পুলিশ সব সময় সত্য উদঘাটন করতে প্রস্তুত ’
‘জী স্যার’ সকলেই একসঙ্গে উচ্চারণ করে।
এর পর আরও কিছু কথা বলেন তারপর এসপি স্যার চলে যান।
তখনো সকলে বসে আছে। সাজ্জাদ বুঝতে পারে এ কেসে তাকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সজিবের কথা আর এসপি স্যারের কথা শোনার পর সাজ্জাদের মনে মনে আগ্রহ বেড়ে গেল। সে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়, কেসটি সে তদন্ত করতে চায়। এর জন্য কি তাকে স্পেশাল পারমিশন নিতে হবে? মনে মনে হাসে সাজ্জাদ। বোকার মতো কি সব ভাবছে সে। তাকে কেন পারমিশান নিতে হবে। আর তারই বা কিসের এত আগ্রহ? এরকম খুনের মামলা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই থানায় আসে। কই আগেতো কখনো তার মধ্যে এত আগ্রহ জন্মেনি! তাহলে?
সাজ্জাদ এখন আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি সিরিয়াস কাজের বিষয়ে। এ কথা সাজ্জাদের নয়, সজিব থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টর স্যার, এএসপি স্যার সকলেই বলেছে।
সাজ্জাদ তো কিছুতেই পুলিশে চাকরি করবে না। মায়ের আদেশ পালন করতে সে পুলিশে পরীক্ষা দিয়েছিল। তারপর চাকরিটা হয়ে গেল। তবে যেদিন সে প্রথম ট্রেনিংয়ে যায়। মা তাকে বলেছিল,
‘আমার যেই ছেলের অন্যায়ের জন্য গ্রামবাসি, প্রতিবেশি সারাক্ষণ নালিশ করেছে। আমার সেই ছেলে একদিন অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে।’
সেদিন থেকে সাজ্জাদ যেন একদম পাল্টে গেল। নিজে তো অন্যায় করেই না। বরং সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।
‘সাজ্জাদ তুই কি বসে থাকবি? সবাই চলে গেল।’
সজিবের কথায় হুঁশ ফিরে পায় সাজ্জাদ। চট করে উঠে ডিউটিতে চলে যায়।
সত্তরোর্ধ্ব মৃত ব্যক্তি জনাব আনোয়ার খান। তিনি বিশিষ্ট শিল্পপতি। যৌবন কালে টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে আনন্দময় দিনগুলো মিস করেছেন। কম বয়সে বিয়ে, সন্তান। তারপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া ছিলেন। এখন উপয্ক্তু সন্তান সকল প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়েছে। তিনি অনেকটা রিল্যাক্স।
মিডিয়ার সাথে আনোয়ার খানের তেমন কোনো পরিচয় ছিল না। মাঝে মাঝে ওয়েস্টিন বা সোনারগাঁ পার্টিতে গেলে দেখা হয়ে যেত অনেকের সঙ্গে। তবে ওই দেখা এবং কুশল বিনিময় পর্যন্ত।
একদিন সোনারগাঁ হোটেলের এক সন্ধ্যায়। সুইমিং করছেন আনোয়ার খান। পাশেই কয়েকজন ছেলে-মেয়ে স্ন্যাকস খাচ্ছিল। তাদের মধ্যে কেউ একজন বার বার আনোয়ার খানকে লক্ষ্য করছিল।
রাত নামতেই চারিদিকে আলোকবাতি জ¦লে উঠেছে। সদ্য জল থেকে সুইমিং স্যুট পরা আনোয়ার খানের দিকে তাকিয়ে এক পঁচিশোর্ধ্ব যুবক ডাক দেয়,
‘ভাইয়া, কেমন আছেন?’
আনোয়ার খান মনে করার চেষ্টা করছেন, কোথায় দেখেছেন তাকে। তাছাড়া এভাবে তাকে সচরাচর কেউ ভাইয়া বলে ডাকে না। প্রায় সকলেই স্যার বলেই ডাকে। তাই একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। হয়তো মনে করার চেষ্টা করেন, আগের পরিচিত কেউ কি না। হতে পারে রিলেটিভ কেউ।
সকল জল্পনার জট খুলতেই কাছে এসে দাঁড়ায় যুবক। এক হাতে জুসের গ্লাস, অন্য হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘আমি অভি। চিনতে পেরেছেন?’
তখনও আনোয়ার খানের চোখে ঘোর অমানিশার মতো অন্ধকার। তিনি অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, কে এই অভি। কবে তার সাথে পরিচয় হয়েছিল।
এবারও অভি নিজেই জট খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে,
‘ভাইয়া আমি অভি। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। আপনার সাথে আমার ওয়েস্টিনে দেখা হয়েছিল’
এবার আনোয়ার খান বুঝতে পারেন এমন অনেক মানুষের সাথেই তো দেখা হয়। কতোজনকে মনে রাখা সম্ভব। যারা প্রথম পরিচয় হয়, তারা হয়তো মনে রাখে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। হয়তো কোনো উপকার পাবে, এই আশায় নিজে থেকে ভিজিটিং কার্ড বা কন্টাক নাম্বার চেয়ে নেয়। অনেকে আবার পরবর্তীতে অফিসে গিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে। এর অবশ্য একটা কারণ আছে। আনোয়ার খান যে কোম্পানির চেয়ারম্যান। সেখান থেকে প্রতি বছর প্রচুর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়।
অভির কথা শুনে আনোয়ার খান ¤্রয়িমাণ হয়ে শুধু অস্ফুট শব্দে বলেন,
‘মে বি’
আর কোনো কথা না বলে তিনি চলে যাবার জন্য পা বাড়ান। এমন সময় পেছন থেকে অভি আবার ডেকে বলে,
‘ভাইয়া একটু দাঁড়ান।’
হাতের টাওয়াল দিয়ে মাথার ভেজা চুল মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে যায় আনোয়ার খান।
‘ভাইয়া আমি কি আপনার সাথে রুমে যেতে পারি?’
‘কেন বলেন তো?’
আনোয়ার খানের কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে আবার উত্তর দেয় অভি,
‘না মানে, আপনার সাথে একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম?’
‘যা বলার এখানেই বলেন। দেখছেন না আমার মাথা ভেজা। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।’
‘তাহলে চলেন রুমে যাই। আপনার সঙ্গে এক কাপ কফি খাই।’
আনোয়ার খান অভির কথা শুনে ঘাবড়ে যায়। কিরে বাবা, চেনা নেই জানা নেই হুট করে আমার সাথে রুমে যেতে চায়, কফি খাবে। এখানকার সিকিউরিটির সাহায্য চাইবেন ভেবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন। আবার কি মনে করে ভাবেন দেখি না কি বলতে চায়। তবে রুমে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
‘আচ্ছা আপনি এখানে বসেন। আমি রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
আনোয়ার খান চলে যায়।
অভি ফিরে এসে আবার সঙ্গীদের ভিড়ে মিলিয়ে যায়। সকলে প্রশ্ন করে,
‘অভি ভাই, তুমি ওই লোকটাকে চেনো? আগে তো বলোনি।’
মনে মনে অভি বলে, ‘আমি ও কি আগে চিনতাম। এমনিই ডাক দিলাম। তবে আগে না চিললেও এখন চেনা হয়ে যাবে।’
বন্ধুদের কাছে অভির কদর বেড়ে যায় মুহূর্তেই। এরপর যখন জানতে পারে, একটু পর অভির সাথে কফি খেতে আসবেন আনোয়ার খান। তখন তো কোন কথাই নেই।
অভিদের আড্ডায় দুটি মেয়ে আর দুটি ছেলে ছিল। তাদের কাছে মুহূর্তে অভি হিরো হয়ে যায়।
লিমা তো বলেই ফেলে,
‘অভি ভাই আমাকে কিন্তু ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন’
‘কোনো বিষয়ই না।’
অভির এমন নির্ভরযোগ্য কথা শুনে লিমার চোখে বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন জমতে শুরু করে। সাথে থাকা ছেলে দুইজনও অভির কাছে আবদার করে, তাদেরও যেন একটু পরিচয় করিয়ে দেয়।
সময় গড়িয়ে যায়। অভির অপেক্ষার পালা শেষ হয় না। ভেতর থেকে আনোয়ার খান আর আসে না। রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে। সিকিউরিটি তার ডিউটি করছে। সাথে থাকা বন্ধুরা এরই মধ্যে টিটকিরি শুরু করেছে অভির সাথে।
একজন সিকিউরিটি কাছে আসতেই অভি তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ মিস্টার আনোয়ার খানের রুম নাম্বার কতো, জানেন?’
‘আপনি কার কথা বলছেন? বিজনেস ম্যান?’ সিকিউরিটির প্রশ্ন শুনে অভি বলে,
‘হ্যাঁ আমি ওনার কথাই বলছি’
‘তিনি তো কখন চলে গেছেন।’
(চলবে)
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক,
নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক