আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন
মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর ইতিহাসে জানা-অজানা কত বীর শহিদের আত্মত্যাগের কথা সোনার অক্ষরে অক্ষয় হয়ে আছে। তথাপিও এ দেশের সাহসী সন্তানদের বীরত্বের কাহিনী আর আত্মত্যাগের অনেক ঘটনা এখনো অনেকেরই অজানা রয়েছে। আর তাঁদেরই একজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র তৎকালীন ছাত্র নেতা শহিদ আবুল কালাম (বাবলু)।
শহিদ আবুল কালাম (বাবলু) ১৯৪৬ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার নিজ গালুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শহিদ আবু বকর মিয়া, মাতা মরহুম রিজিয়া বেগম। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুব সাহসী ও ডানপিটে। তিনি ছিলেন একজন মনে প্রাণে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে একজন খাঁটি বাঙালির চেতনায় তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
তিনি ১৯৬২ সালের রাজাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ঝালকাঠি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৬৮ সালে বরিশালের চাখার ফজলুল হক সরকারি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ২৩১ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র। ওই হলের একজন সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। রাইফেল শ্যুটিং, সাইকেল রেসে তিনি ছিলেন অত্যস্ত সুদক্ষ। তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ’৬৯-এর ছাত্র আন্দোলন ও গণ অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ হয়ে উঠে তাঁর চিন্তা-চেতনা এবং মুক্তির একমাত্র বহিঃপ্রকাশ। ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে আবুল কালাম (বাবলু) কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ছেড়ে মালিবাগে এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মাচের্র স্বাধীনতার ঘোষণায়, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে’ উজ্জীবিত হয়ে চলে আসেন বরিশালের ঝালকাঠি মহাকুমা শহরে। সেখানে তিনি মুক্তি বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। কয়েকজন উৎসাহী তরুণের সহযোগিতায় ঝালকাঠিতে শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত ঝালকাঠি শত্রুমুক্ত ছিল। এই মুক্তি বাহিনী পরবর্তীতে আটঘর-কুড়িয়ানা অঞ্চলের পেয়ারা বাগানের যুদ্ধে পাক দস্যুদের কয়েকজনকে হত্যা করেছিলেন। পেয়ারা বাগানে পাক হানাদারদের আক্রমণ জোরালো হলে জুন মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আবুল কালাম (বাবলু) চলে আসেন তাঁর নিজ এলাকা রাজাপুরে। সেখানে তিনি গ্রামের ছাত্র-কৃষক বন্ধুদের নিয়ে নতুনভাবে সশস্ত্র মুক্তি বাহিনী গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান। এই বাহিনীর ক্যাম্প ছিল বড়ইয়া ইউনিয়নের ভাতকাঠি গ্রামে। এই ক্যাম্পে বসেই ১লা আগস্ট আবুল কালাম (বাবলু) তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠিদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লেখেন, যা পরবর্তীতে প্রথমা প্রকাশন হতে সালাহউদ্দীন আহমদ, আমিন আহম্মেদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ সম্পাদনা পরিষদ সম্পাদিত ‘একাত্তরের চিঠি’ বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।
আবুল কালাম (বাবলু) তাঁর বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলা মুক্তি বাহিনীকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা অক্টোবর অস্ত্র নিয়ে তিনি ক্যাম্পে ফিরছিলেন। পথে আঙ্গারিয়া নামক স্থানে পাক সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তিনি অস্ত্রসহ ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাঁকে রাজাপুর থানায় আট দিন বন্দি করে রাখে এবং তাঁর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। অতঃপর ১১ই অক্টোবর রাতে তাঁকে থানার সামনে জাঙ্গালিয়া খালের ঘাটে নিয়ে ফাঁস দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং তাঁর মৃতদেহ খালের পাড়ে গর্ত করে মাটির নিচে পুঁতে রাখে।
উল্লেখ্য, শহিদ আবুল কালাম (বাবলু)-এর অন্য দুই ভাইও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাই মুক্তিযোদ্ধার পিতা হওয়ার অপরাধে ১৭ই নভেম্বর রাতে নরপশুরা আবুল কালামের বাবা শহিদ আবু বকর মিয়াকে তাঁদের বাড়িতে এসে গুলি করে হত্যা করে এবং তাঁদের বাড়িঘর লুটপাট করে, অগ্নিসংযোগ ঘটায়। স্বদেশের মুক্তি, সহযোদ্ধাদের রক্তের প্রতিশোধ এবং নির্মম গণহত্যার প্রতিবাদে ২২শে নভেম্বর রাতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংঘবদ্ধ হয়ে পাকহানাদার বাহিনীর ঘাঁটি রাজাপুর থানা আক্রমণ করেন। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ; যা পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে। এ যুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক এবং হোচেন আলী নামের দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং আহত হন কমপক্ষে ২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২৩শে নভেম্বর পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে রাজাপুর থানা শত্রুমুক্ত হয়।
২৫শে নভেম্বর শহিদ আবুল কালাম (বাবলু)-এর লাশ তুলে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর পিতার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। বরিশাল বিভাগের ৯নং সেক্টরের মধ্যে ঝালকাঠির রাজাপুর থানা সর্বপ্রথম পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয় এবং এখানেই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ আবুল কালাম (বাবলু) এর আত্মত্যাগের স্বীকৃতির ছবি ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রবেশ মুখে মূল সড়কের ডানে এবং বামে স্মৃতিফলকে, হলের নিচ তলায় অতিথি কক্ষের দেয়ালে টাঙানো ছবিতে এবং দোতলায় সিঁড়ি ধরে হেঁটে উঠতে স্মৃতিফলকেও সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ আছে। তাছাড়া, পাকহানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পরে ১৯৭১ সালের ১১ই অক্টোবর রাতে তাঁকে রাজাপুর থানার সামনে জাঙ্গালিয়া খালের ঘাটে যেখানে নিয়ে নৃশংস নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে মৃতদেহ খালের পাড়ে গর্ত করে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়, সেখানেই পাকহানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন-পরবর্তী হত্যার শিকার নাম জানা ও অজানা বীর শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর উদাত্ত আহ্বানে ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকাখচিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। শহিদ আবুল কালাম (বাবলু) তাঁদেরই একজন।
লেখক : ২৫ তম বিসিএস (পুলিশ)
বর্তমানে উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক)
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ