ই-পেপার

মোঃ মনিরুজ্জামান বিপিএম (বার) পিপিএম (বার)

১৯৯৯ সালের ২৫ জানুয়ারি মাসে ১৮তম বিসিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এবং বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য হিসাবে নাম লেখাই জনপ্রশাসনের খেরোখাতায়। দীর্ঘ ৭ মাস পরে ঐতিহাসিক পুলিশ একাডেমি সারদায় যাই এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য। এরপর পীরগঞ্জ থানা, রংপুর বি সার্কেল, রংপুর কোর্ট, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের প্রবেশনার হিসাবে বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি ৬ মাসের জন্য। সব কিছু শেষ করে পুলিশ অফিসার হিসাবে সত্যিকারের কর্ম জীবন শুরু করি ২০০১ সালের শুরুতে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাব, বিশ্ব শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের আকাশী নীল জার্সির সাথে পতপত করে ওড়ানো আমার দেশের লাল সবুজ পতাকা। নিয়মানুযায়ী চাকরি ৫ বছর না হলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য বিশেষ করে civillian police officer বা CIVPOL হিসাবে এপ্লাইও করা যায় না। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি। এরই মধ্যে কেএমপি থেকে পোস্টিং হয় ডিএমপিতে। যে শহরে ছাত্রাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙ্গীন দিনগুলো কেটেছে সেই স্মৃতি বিস্মৃতির নগরীতে আবারো আসি পুলিশ অফিসার হয়ে। পোস্টিং হয় গোয়েন্দা বিভাগে। প্রতি বছরই দেখি সিনিয়র জুনিয়র সহকর্মীরা মিশনে যাচ্ছে আসছে। মিশন ফেরত স্যারদের কাছ থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম ব্লু ব্যারেটের দিনলিপি।

আমার সরকারি বাসাও ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে রাজারবাগকে ঘিরেই বাংলাদেশ পুলিশের বিপুল কর্মযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য নির্বাচনী পরীক্ষা এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় প্রতিবছরই জাতিসংঘের টিমের সদস্য হিসাবে দেশে আসতেন বিভিন্ন দেশের পুলিশ অফিসাররা। উদ্দেশ্য চলমান শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য পুলিশ অফিসার নির্বাচন করা। বলে রাখা দরকার জাতিসংঘ বাহিনীতে কাজ করার জন্য অর্থ্যাৎ CIVPOL হিসাবে কাজ করার জন্য সাব ইন্সপেক্টর ও তদুর্ধ্ব অফিসাররা তাদের আবেদনের ভিত্তিতে United Nations Selection Assistance Team (UNSAAT) নিকট উপস্থাপিত হয়, ফাইনাল Selection এর জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি হলে স্থানীয় অথরিটি অর্থাৎ বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক Pre-SAAT এর মাধ্যমে UN SAAT Test-এ কারা চূড়ান্তভাবে বসতে পারবেন তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। ২০০৫ সালে আমরা UN SAAT Test এ বসার উপর্যুক্ততা অর্জন করি সার্ভিস রেগুলেশনস্ বিবেচনায়। নিতান্ত সাধারণ একটি পরিবারে আমার জন্ম। স্কুল শিক্ষক বাবা আর গৃহিণী মায়ের আট ভাই বোনের সংসারে আমাদের সেই অর্থে খুব টানাটানি না থাকলেও প্রাচুর্য ছিল না তেমন একটা। ১৯৯০ সালে আমার বড় ভাই জাপান প্রবাসী হয়ে ডিজিটাল একটি প্রেসে কাজ করতেন। ভাই এর পাঠানো চিঠি পড়ে, ছবি দেখে জগৎ দেখার শখ হয় সেই কৈশোর কালেই। আমার জন্ম যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায়। বেনাপোল সীমান্ত হতে আমার বাড়ি মাত্র ৮/১০ কিলোমিটার। ছোট বেলা থেকেই আমি দেখছি পাড়া প্রতিবেশীরা সমানে ইন্ডিয়া যাচ্ছে আসছে। পাসপোর্ট ভিসার কথা খুব একটা শুনিনি। কালোবাজারিরা তো বটেই সাধারণ মানুষও সমানে এপার ওপার করতে, খুবই সহজে এবং সাধারণ ছিল সেই যাওয়া আসা। প্রতিবছর শীতকালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আলো ঝলমল নাট্যমঞ্চে যাত্রাপালা হত। আয়োজকদের মূল টার্গেট ছিল বাংলাদেশি দর্শক। যেতে আসতে খুব একটা বাধা নিষেধ ছিল এমন শুনিনি। আমরা যখন হাইস্কুলে সিক্স সেভেনের ছাত্র তখন আমাদের বড় ভাইদের কেউ কেউ বিকেলে খেলার মাঠে এসে গর্বভরে বলতো তাদের গত রাতের ভারতে গিয়ে যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা। নিচের ক্লাসের বলে আমাদেরকে তারা ডাকতো ঝালের চারা বলে। ঝালের চারাদের কাছে তারা স্বগর্বে বলতো তাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথা। ক্লাশ নাইনে যখন পড়ি তখন একবার আমাদের কয়েক বন্ধু মিলে বাংলাদেশ সীমান্তের শিকারপুর বর্ডারের অপোজিটে আম ডোব না কি একটা বাজারে যাত্রা দেখতে গেল। বহু পীড়াপীড়ির পরও আব্বার অনুমতি না পাওয়ায় আমার যাওয়া হয়নি বন্ধুদের সে অ্যাডভেঞ্চারে। ইন্ডিয়া ফেরত বন্ধুদের কাছ থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনেছি সে বিশ^জয়ের গল্প। প্রথমে সীমান্তবর্তী এক গ্রামের এক বন্ধুর বাড়িতে তারা মিলিত হত, সন্ধ্যা নাগাদ নাক মুখ দিয়ে দুমুঠো খেয়ে তারা রওনা হয় সীমান্তের ওপারে। তখন সব জায়গায় কাঁটা তারের বেড়া ছিল না। বিডিআর বিএসএফ জানতো যে এপারের লোকজন যাবে, তারা দেখেও না দেখার ভান করতো। নিন্দুকেরা বলতো যে, আয়োজকদের সাথে মামাদেরও বিশেষ অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে। যাহোক যা বলছিলাম তারা সহি সালামতে যাত্রা পালা দেখে, ভাড়ের চা আর গুড়ের জিলাপি খেয়ে যাত্রা পালার ডানা কাটা পরীদের দেখে বীর বেশে দেশে ফিরল। পরদিন স্কুলে আমরা যারা যেতে পারিনি তাদের দিকে নিতান্ত তাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে তাকানো শুরু করল। তাদের দৃষ্টিতে আমরা নিতান্তই ‘আবাল’। বন্ধুদের সে যাত্রায় সাথী হতে না পারার দুঃখ অবশ্য আমার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৯ সালে আমার এসএসসি পরীক্ষার পর বড় দুলাভাই এর সাথে পূজা দেখতে ইন্ডিয়া গিয়ে ৫/৭ দিন থেকে আসলাম দুলাভাই এর আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে। তখনো মনে হয়নি বিদেশে গেছি, একই রকম ঘাস, ধান ক্ষেত, হাট বাজার, মানুষের পোশাক আশাক, ভাষা। তো সে কাহিনি আর লম্বা না করি। সেটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর।

মিশনের কথায় ফিরে আসি। প্রসঙ্গও বলে রাখা দরকার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনকে পুলিশি ভাষায় সংক্ষেপে মিশন বলে। পুলিশের শান্তিরক্ষা মিশন মূলত দুই রকম। প্রথমটা হল FPU বা Formed police unit এরা মূলত ব্যাটালিয়ন আকারে মিশনে যায় এবং দায়িত্ব পালন করে। এখানে পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা FPU কমান্ডার হিসাবে থাকেন এবং তার অধীনে ব্যাটালিয়ান ফর্মেশনে কনস্টেবল হতে অ্যাডিশনাল এসপি পর্যন্ত বিভিন্ন পদমর্যাদার নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মকর্তা থাকেন। FPU তে গাড়ি-ঘোড়া থেকে শুরু করে অস্ত্র, সরঞ্জাম এমনকি থালা বাসন সবই বাংলাদেশ সরকারের। এবং সরকারের এজন্য নির্দিষ্ট হারে পুলিশ সদস্য এমনকি যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম সব কিছুর জন্যই টাকা পায়। তারা মিশন এরিয়াতে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য পুলিশি কাজে নিয়োজিত থাকেন। এরা সাধারণত এক বছরের জন্য মনোনীত হয়। এদের Selection সহ যাবতীয় প্রক্রিয়া জাতিসংঘের নির্দিষ্ট গাইড লাইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ পুলিশই করে থাকে।

দ্বিতীয় আরেক ধরনের মিশন হল CIVPOL হিসাবে। জাতিসংঘ কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে স্থানীয় পুলিশের এই মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় কোনো হাত থাকে না, তারা শুধু Facilitator হিসেবে কাজ করে। এখানে মূলত ৪ ধরনের টেস্ট হয়। ইংরেজি, অস্ত্র চালনা, গাড়ি চালনা, ও মৌখিক সাক্ষাৎকার। ইংরেজি টেস্টে মূলত তার কমিউনিকেশন স্কিল অর্থাৎ বিশে^র বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের একসেন্ট বোঝার, তাদেরকে বোঝানোর ক্যাপাসিটি পরীক্ষা করা হয় এবং কোনো একটি বিষয়ে রিপোর্ট আকারে উপস্থাপনের পারদর্শিতা পরীক্ষা করা হয়। তিনটি পর্বে এ পরীক্ষা হয়। Reading, Listening, Report writing প্রথমটা খুব সহজ। written Script দিয়ে তা থেকে কয়েকটি question এর লিখিত উত্তর দিতে হয়, অনেকটা ইংরেজি পেসেজ এর মতো। Listening & Report writing এর ক্ষেত্রে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ভিন্ন কিন্তু একসেন্টে রেকর্ডকৃত সিডি মাত্র একবারই শুনানো হয়। তা শুনে, বুঝে তাৎক্ষণিক নোট নিতে হয়। Listening এর ক্ষেত্রে একটি Law and order related ঘটনার সিডি শুনে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রশ্নগুলো মূলত কোনো ব্যক্তির দল, সংগঠন স্থানের নাম, সময়, তারিখ, বিভিন্ন বিবরণ, সংখ্যা সময়, সংগঠিত অপরাধের ধরন, গৃহীত পুলিশি ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কিত হয়। Report writing & Listening অনুরূপ অনেকটাই। পার্থক্য হল Listening এ শুধু বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তার Report writing-এ সিডির কাহিনি শুনে ১৫ মিনিটের মধ্যে সকল তথ্য উপাত্ত নাম বিভাগ, গৃহীত ব্যবস্থা বিবরণ এবং আনুষঙ্গিক তথ্যাদির বিবরণ দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে তা উপস্থাপন করতে হয়।

এখানে Selection প্রক্রিয়াটি নক আউট সিস্টেম হয়। প্রথমে সফল পরীক্ষার্থীকে একটি বড় হলে ঢুকানো হয়। পরীক্ষার্থী মূলত এসআই বা সার্জেন্ট হতে ডিআইজি পর্যন্ত। প্রথমেই হল রিডিং টেস্ট। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ফলাফল দিয়ে দেওয়া হয়। যারা পাশ করে শুধু তারাই পরবর্তী টেস্টের ডাক পায়। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয়। হল ভর্তি সিনিয়র জুনিয়র কলিগদের মধ্যে থেকে বাদ পড়লে মিশনে যেতে না পারার দুঃখের চেয়ে কলিগদের কাছে ইজ্জত বা সাওয়ালই বড় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বিষয়টি হল এমন যে, খুব অল্প সময়ের পরীক্ষা, ঠিকমতো শুনতে না পারলে, কনসেলট্রেট করতে না পারলে যেকোনো ব্যক্তিই হিটে আউট হতে পারেন। এমনো দেখেছি যে, দুর্দান্ত ইংরেজি জানা, বলা সিনিয়র অফিসার এমনকি একাধিক মিশন করে আসা অভিজ্ঞ কর্মকর্তারাও বাদ পড়েন। এভাবে একে একে Listening & Report writing-এ যারা কৃতকার্য হয় তারা এর জন্য ডাক পান। পরবর্তীতে এ পর্বে উত্তীর্ণরা Shooting practice এর জন্য মনোনীত হন এবং উত্তীর্ন হলে UN Team এর সাথে চূড়ান্ত ঠরাধ দেবার সুযোগ পান। সকল বিষয়ের উত্তীর্ণরা মেডিকেল টেস্টে উতরে গেলে এবং তাদের সার্ভিস রেকর্ড সন্তোষজনক হলে চূড়ান্তভাবে মিশনের জন্য মনোনীত হন।

যা বলছিলাম সেখানে আবার ফিরি। আমার বাসা রাজারবাগে। বিশেষ করে ছুটির দিনে দেখতাম মিশনে যেতে ইচ্ছুকদের দৌড়ঝাঁপ। কেউ ড্রাইভিং প্র্যাকটিস করছে, কেউবা পার্কিং, কেউ কেউ আবার গ্যালারিতে কয়েকজন মিলে বসে ঝালিয়ে নিচ্ছে নিজেদের ইংরেজি।

২০০৫ সালের মার্চ/এপ্রিলেই হবে যতদূর মনে পড়ে। আমাদের চাকরি তখন ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, আমরা মিশনে পরীক্ষা দেবার উপর্যুক্ততা অর্জন করেছি, আমার সাথে ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসের মাধ্যমে যারা জয়েন করেছি তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে। এপ্লাই করলাম ভাই বেরাদারদের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করলাম। সমস্যা হল যাদেরকে সিরিয়াস বলে জানতাম তাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তাদের অনেকেই এমন একটা ভাব করতো যে, সে মিশনের জন্য এপ্লাই করেছে কিনা তাও তার মনে নেই। যারা একটু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং ছিল এমন যে, কাজ করতে করতে জান শেষ, মিশন নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আছে। প-িত শ্রেণির বন্ধুদের বক্তব্য ছিল এমন যে, মিশনের আবার প্রস্তুতি কি? স্টেজেই মেরে দিল। বুঝলাম কমপিটিশন একমাত্র স্থান একটা সহযোগিতা বা পরামর্শ পাওয়া যাবে না। যা করার নিজেকেই করতে হবে।

আগেই বলেছি আমি পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে, বাসে ঝুলে স্কুল কলেজ করা পাবলিক। বাবার প্রকট না হলেও বাহুল্য ছিল না সেই অর্থে। পড়াশুনার প্রয়োজনে হোস্টেলে মেসে থাকতে হয়েছে সেই কিশোর কাল থেকেই। যখনি কোনো বিপদ আসে বা কোনো লক্ষ সামনে আসে আমি কখনোই ভেঙে পড়ি না বা নিরাশ হতাম না আল্লাহর রহমতে। বড় আবারো একটা নতুন লড়াই এর জন্য চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ভিতর থেকেই। দুতিন মাস সময় আছে হাতে। আমি সবসময়ই বাস্তববাদি, নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতাম, স্কুল কলেজে ইংরেজিতে ভালো নম্বর পেয়েছি, Applied physics এর মতো কঠিন সাবজেক্ট অনার্স মাস্টার্স করেছি কৃতিত্বের সাথেই। যেখানে একটা অক্ষরও বাংলায় পড়ার বা শেখার সুযোগ ছিল না। অসুবিধা হয়নি তাতে, তেমন কোন জটিলতা ছাড়াই উতরে গেছি। কিন্তু এটুকু বুঝতাম বিভিন্ন একসেন্টের ইংরেজি শুনতে, বুঝতে সীমাবদ্ধতা আছে, জড়তা আাছে ইংরেজি বলাতেও। ক্লাস সেভেনের বিজ্ঞান বইতে পড়েছি বৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যা চিহ্নিতকরণ, এরপর সমস্যা এনালাইসিস, সমাধানের সমস্যা পথ নির্ধারণ এবং Trial error পদ্ধতিতে সমাধানের পথ নির্ধারণ করা। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে বৈজ্ঞানিক পড়াকেই বেছে নিলাম। প্রথমেই Listenning এ মনোযোগ দিলাম। হিসাব করে দেখলাম হাতে তখনো প্রায় দুই মাস সময় আছে। আমি তখন ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করি। তখন ৩৬, মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে প্রায় প্রতিদিনই রাত বারোটায় মিটিং হত। আমার সকালে দশটা সাড়ে দশটায় অফিসে আসতে হত। মাঝে মাঝেই রাতের বেলা উদ্ভাষ বা গ্রেফতারের অভিযান কিংবা নাইট রাউন্ড থাকতো। নাইট রাউন্ড মানে সহকারী পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা একটি ডিভিশনে থানা, ফাঁড়ি, পেট্রোল বা মোবাইল পার্টি, থানা হাজত, সেন্ট্রি, অস্ত্রগার বিভিন্ন পুলিশ পোস্টে সরেজমিনে গিয়ে দেখবে সব ঠিক ঠাক আছে কিনা, কোথাও কোনো গাফিলতি, অবহেলা বা অনিয়ম হচ্ছে কিনা। পর দিন কমিশনার মহোদয়কে কয়েক পাতার নাইট রাউন্ড রিপোর্ট জমা দিতে হত। উল্টা পাল্টা কিছু হলে কমিশনার মহোদয় বা তার পক্ষ থেকে অন্য কোনো কর্মকর্তা ডেকে পাঠাতেন। নবীন কর্মকর্তা হিসাবে আমরা বরাবরই তেমন কোনো ডাক না পাওয়ার চেষ্টা করতাম। নাইট রাউন্ড হলে লাভ ছিল এই যে, পরদিন সকালে আর অফিসে যাওয়া লাগবে না কিন্তু লাঞ্চের পর ঠিকই কাজে যেতে হত। যাহোক যা বলছিলাম, তাতেই ফিরে আসি। ঠিক করলাম বিভিন্ন একসেন্ট শুনতে এবং ফ্রিকুয়েন্টলি স্পিকিং ক্যাপাবিলিটি বাড়াতে হবে। যা ভাবা তাই কাজ। অফিস, বাসায় বসে বিবিসি, সিএনএন শুনা শুরু করলাম। বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো। নিয়মিত ইংরেজি পেপার পড়া শুরু করলাম। ১৫/২০ দিনের মধ্যেই ফলাফল পেতে শুরু করলাম। নিজেই বুঝতে পারলাম যে, আমার কান এখন অন্য যেকোনো সময়ের থেকে পরিষ্কার। মফস্বলের স্কুলে কলেজে পড়ার কারণে আমাদের ভোকাবুলারি যাই থাক pronunciation এ মারাত্মক সমস্যা ছিল, ইংরেজিতে কথা বলতে গেলেই অভ্যাসের কারণে শব্দের আগেই গ্রামার মাথায় ভিড় করতো, কাজেই সঠিক সময়ে সঠিক শব্দটি মুখ দিয়ে বের হতনা বা হলেও Tense, Counjunction বা গ্রামারের অন্য কোনো অংশের খপ্পরে পড়ে তার গতি শ্লথ হয়ে যেত। ফলশ্রুতিতে যাকে আমরা বলি fluency তা আর থাকতো না। Observer, daily Star BBC, CNN শুনে মোটামুটি একটা পর্যায়ে আসলেও ঝঢ়বধশরহম এর দুর্বলতা রয়ে গেল চর্চার কারণে। পথ বের করলাম, পার্টনার হিসাবে বেছে নিলাম নিজেকে এবং বউকে। নিজেকে এভাবে যে নিজেই নিজের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতাম, চা খেতে ইচ্ছে হলে ইংরেজিতেই ভাবতাম ও want have some tea ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার বউ বরাবরই লাজুক কিন্তু সারা জীবনের প্রত্যয়ী। আমার বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়েও সে আমাকে সহায়তা করেছে দারুণভাবে। কিছু করতে পারুক বা না পারুক পাশে থেকেছে। আমি যখন পাবলিক লাইব্রেরি বা সায়েন্স লাইব্রেরির ভিতরে বসে বই ঘাটাই সে তখন পত্রিকা নাড়াচড়া করে কাটিয়ে দিতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমার স্ত্রী আমার সব কিছুরই পার্টনার। তাকে বললাম ইংরেজি বলতে পারিনা কি করবো বলো তো? সে হেসে বলল ইংরেজি জানা একটা মেম দেখে প্রেম করো, বললাম সে না হয় করলাম, কিন্তু আগেতো মেমেদের দেশে যেতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন তিনি নতুন মাস্টারনি হয়েছেন, ২২তম বিসিএস দিয়ে করটিয়া কলেজে যাওয়া আসা করেন। নতুন ছাত্র পেয়ে খুশিই হলেন। শুরু হল আমাদের দ্বৈত ইংরেজি চর্চা, ভাগ্যিস তখন আমার মেয়েটা ছোট্ট, হাসতে শিখলেও হাসাহাসি করতে শেখেনি। তার বেগুন দিয়ে দুর্দান্ত ইলিশ রান্নার তারিফ করতে গিয়ে যখল বলতাম Your Brinjal stitsa combination was অসাম, সেও ভুল ধরিয়ে দিত অসাম নয় অছম………..।

ইংরেজি বলা কতটা শিখতে পেরেছিলাম জানিনা তবে নিজেরাই হাসাহাসি করতাম নিজেদের ইংরেজি বিদ্যায় জাহির নিয়ে। আমাদের কা- কারখানা দেখে আমাদের বছর দুয়েক বয়সি মেয়ে হেসে গড়াগড়ি দিত না বুঝেই। ওকে বলতাম হাসছিস? জানিস মিশনে একবার গেলে তোর বাপ মারা মাসে যা বেতন পায় তার চেয়ে বেশি বেতন পাবে একদিনে। ও আরো হাসত, বোধ করি বাবা মিশনে গিয়ে কাড়াকাড়ি ডলার কামাবে এই খুশিতেই।

এভাবেই নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করলাম। গাড়ি চালাতে আমি জানতাম আগে থেকেই। প্র্যাকটিস বাড়িয়ে দিলাম। ডিবিতে চাকরি করি বলে আমরা দুজন করে ড্রাইভার পেতাম। কারণ ডিবির গাড়ি রাত দিন চলতো। দেখা গেল ওরা দুজনাই বাবু হয়ে বসে আছে সেকেন্ড সিটে গাড়ি চালাচ্ছি আমি একাই। আমার দিব্যি মনে আছে একটা ১৮/১৯ বছরের বাচ্চা অপহরণের ঘটনার রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব পেয়ে ঢাকা থেকে নওগাঁ যাই, দুপুর নাগাদ রওনা হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ নওগাঁ পৌঁছাই। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার আগেই আবার খবর পাই যে অপহরণকারীরা বাচ্চাটিকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছে কাঠালের ট্রাকে করে। উত্তর বঙ্গের রাস্তা তখন এখনকার চেয়ে অনেক খারাপ। ঝাঁকুনিতে সবার কোমর ভাঙার কায়দা হয়েছে। টিমমেটরা বললেন স্যার এখন রওনা করা ঠিক হবে না, কুয়াশা ইত্যাদি। ড্রাইভারও বেঁকে বসল। বাচ্চার বাবা আমাদের সাথেই ছিলেন। তিনি অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী। তার একমাত্র ছেলে অপহরণ হয়েছে। তার সে অসহায় দৃষ্টি সহ্য করা সম্ভবপর ছিল না। টিমমেটদেরকে বললাম তোমরা গাড়িতে ঘুমাও, আমি গাড়ি চালাবো। বাচ্চার বাবা সেকেন্ড সিটে বসিয়ে আমি নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলাম জার্নি ফ্রম নওগাঁ টু নারায়ণগঞ্জ। নিরাপদেই ভোর ভোরে পৌঁছলাম নারায়ণগঞ্জ কোনো বিপত্তি ছাড়াই। সেদিনই নিজের ড্রাইভিং এর উপর কনফিডেন্স আসল। শীতের রাতের কুয়াশা, হাজার হাজার ট্রাক, নাইট কোচের সারি পেরিয়ে যখন এই শ্লান্ত-ক্লান্ত শরীর নিয়ে নওগাঁ থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছেছি তখন ড্রাইভিং এ পাশ করবো এ বিশ^াস ছিল। শুটিং এর প্র্যাকটিসের তেমন সুযোগ নেই। তবে মিশনের পরীক্ষার আগে রাস্তা ঘাটে খেলনা রাইফেল নিয়ে বেলুন ফুটানো ওয়ালাকে দেখলেই গাড়ি থামিয়ে প্র্যাকটিস সেরে নিতাম, কাজেই মোটামুটি কনফিডেন্স নিয়েই পরীক্ষা দিব এমন অবস্থা তৈরি হয়ে গেল।

অবশেষে এল সেই দিন। সম্ভবত ২০০৫ এর জুলাই/আগষ্ট হবে। সব মনে নেই। এটুকু মনে আছে যে, পরীক্ষার দিন বৃষ্টি ছিল, এমনকি শুটিং ও বৃষ্টির কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

পরীক্ষার হলে ঢুকলাম। প্রথমেই রিডিং Comprehension। সময় আধাঘণ্টা, দুপাতার একটা রিপোর্ট পড়ে ১০টি প্রশ্নের উত্তর দিলাম। সময় থাকতেই পরীক্ষা শেষ করলাম তৃপ্তি নিয়ে, একেবারে ছক্কা। হাসিমুখে রাজারবাগ টেলিকম অডিটোরিয়ামের পরীক্ষা হল থেকে বের হলাম, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই রেজাল্ট দিবে। ব্যাচমেটরা অনেকেই এসেছে পরীক্ষা দিতে। দলবেঁধে পাশের ক্যান্টিনে ঢুকে গুড়িগুড়ি সিঙ্গাড়া চা সিগারেট খেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম রেজাল্টের জন্য। আমি জানতাম যে আমি শতভাগ নাম্বার পাবো। আমার বউ তখন ট্রেনিং এ। ঐ দিন ওরা শিক্ষা সফরে সিলেট বা কোথা থেকে যেন আসছিল। তার উত্তেজনাও টান টান। কারণ সে ছিল আমার মিশন প্রস্তুতির সত্যিকারের পার্টনার। রেজাল্ট পেলাম যথারীতি পাশ। তাকে এবং মাকে জানালাম। মা তো এত কিছু বোঝে না খালি জানে মিশন মানেই যুদ্ধ, গোলাগুলি। মার এক কথা ভালতো চাকরি করছিস, বউও চাকরি করছে, কেবল একটা বাচ্চা আল্লায় দিছে, কি দরকার গোলাগুলির মধ্যে যাবার। বউ কিন্তু খুব খুশি। আমার জয় মানে তারও বিজয়। সেও আমার সহযোদ্ধা। এভাবে একে একে Listening test দিলাম, পাশ করলাম, তীব্র উত্তেজনা নিয়ে উনাকে জানালাম, তিনি তখনো পথে, তখন উল্লাসের সাথে যুক্ত হয়েছেন তার ব্যাচমেট কয়েকজন বন্ধু। সন্ধ্যার পর পরই Report writing পরীক্ষা হল। সকালে হল ছিল ভরা, পরীক্ষার্থী পাঁচ শতাধিক। Report writing এর আগেই ঘরে গেছে অর্ধেকের বেশি। Report writing এর রেজাল্ট শেষে দেখা গেল ইংরেজির ৩টি টেস্টেই কৃতকার্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সত্তর বা তার কাছাকাছি। বাসায় আসলাম, যথারীতি গাড়ি চালিয়েই ড্রাইভিং টেস্ট হবে। পার্কিং টেস্ট, ব্যাক গিয়ারে নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি চালানো এবং ব্যাক গিয়ারে এসে প্যারালাল পার্কিং। নির্ধারিত সময় ৩ মিনিট। যথেষ্ট কনফিডেন্ট ছিলাম। তারপরও সেদিন মধ্যরাত্রিতে বউকে পাশে বসিয়ে আরো একবার প্রাকটিস করলাম। ৩ মিনিটের টেস্ট ২ মিনিটের মধ্যে সফলভাবে সমাপ্ত করলাম। বউ বলল তুমি না পারলে কে পারবে? খালি তড়িঘড়ি করো না। ৩ মিনিটের টেস্ট দু মিনিটে করার কি দরকার? তার পরামর্শ কাজে লেগেছিল। ধীরে সুস্থ্যে ড্রাইভিং সব নিয়মনীতি মেনে সিট বেল্ট বেঁধে, মিরর ঠিক করে, গিয়ার, সিটের পজিশন সব দেখে শুনে ধীরে সুস্থে ড্রাইভিং পরীক্ষা দিলাম। গাড়িতেই পরীক্ষকদের একজন বসা থাকেন তিনি ছিলেন তার্কির একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার। পরবর্তীতে তার সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয় কারণ পরবর্তীতে আমিও UN SAAT এর একজন সদস্য এমনকি দলনেতা হয়ে দুটি দেশের জন্য মনোনীত হই। সে গল্প বাকি থাক। তার্কিস কলিগ আমার ড্রাইভিং দেখে মুগ্ধ হন, বলেন অসাম, আমি হেসে উঠি, মনে পড়ে যায় স্পিকিং প্র্যাকটিসের কথা। শেষ হয় ড্রাইভিং পর্ব। ড্রাইভিং এ পাশ মানেই মিশনের জন্য মোটামুটি মনোনীত। এরপর খালি বাকি থাকে শুটিং। ওতে পাশ করলে এক্সিকিউটিভ মিশন আর না করলেও নন এক্সিকিউটিভ মিশন। অর্থ্যাৎ পাশ না করলেও মিশনে যাবার চান্স থেকেই যায় এবং ভালো মতই থেকে যায়। কাজেই মোটামুটি নিশ্চিন্ত হই মিশনের জন্য মনোনীত হওয়ার। টিম লিডার যেহেতু ড্রাইভিং এ আমার সরাসরি পরীক্ষক ছিলেন এবং আমি ইংরেজি ৩টি টেস্টেই প্রায় শতভাগ মার্কস পেয়ে পাশ করেছিলাম কাজেই সাক্ষাৎকার পরীক্ষায় আমার কৃতকার্য না হওয়াটা মোটামুটি অসম্ভব। এমনিতেও সাক্ষাৎকারে খুব একটা কেউ ফেল করেনা। মোটামুটি মিশনের জন্য মনোনীত হওয়ার অনুভূতি নিয়েই দ্বিতীয় দিন শেষ করলাম। এবার শেষ দিন শ্যুটিং পরীক্ষা। বিভিন্ন দূরত্ব থেকে পিস্তলের ফায়ারিং দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া হয়। ১০ রাউন্ডের মধ্যে অন্তত ৮ রাউন্ড বোর অর্থাৎ টার্গেটের হার্টে না লাগাতে পারলে ফেল। তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দরের এসএস লকেরে শুটিং রেঞ্জে শুটিং পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত। ঐ বারে মিশন পরীক্ষা পাশের হার খুব কম কিন্তু জাতিসংঘ থেকে একাধিক মিশনের জন্য বাংলাদেশ থেকে পিস কিপির প্রেরণের অনুরোধ আছে। এক্সিকিউটিভ এবং নন এক্সিকিউটিভ উভয় টাইপের মিশনের জন্যই রিকুইজিশন আছে। এক্সিকিউটিভ মিশন হচ্ছে যে সকল মিশনে CIVPOL রা সরাসরি পুলিশিং অর্থাৎ পেট্রোল, এরেস্ট, তদন্ত, সিকিউরিটি সবই করেন। আর নন এক্সিকিউটিভ মিশন অনেকটা এডভাইজরি টাইপের লোকাল পুলিশ সবই করে। ইউএন পুলিশ তাদেরকে গাইড বা সুপারভাইজ করে। যে সময়ের কথা বলছি সেসময়ে কসোভো এবং সম্ভবত পূর্ব তিমুরে ছিল এক্সিকিউটিভ মিশন এবং সুদান, আইভরি কোস্টে ছিল নন এক্সিকিউটিভ মিশন।

বলে রাখার দরকার আমাদের মতো দেশের পুলিশ অফিসারদের জন্য মিশনের অন্যতম আকর্ষণ হল এম.এস.এ বা মিশন সাবমিসটেন্স এলাউন্স। জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিরা মিশনের নিরাপত্তা, জীবন যাপনের ব্যাপক সই আনুমানিক সকল বিষয় বিবেচনা করে প্রতিটি মিশনের জন্য আলাদা আলাদা এম এস এ বা সম্মানি নির্ধারণ করেন।

আমরা যখন পরীক্ষা দেই তখনকার হিসাবে এক্সিকিউটিভ মিশনের দেশগুলোতে এম এস এ তুলনামূলকভাবে নন এক্সিকিউটিভ মিশনগুলোর তুলনায় কম। কাজেই আমাদের মধ্যে বুদ্ধিমানরা ঠিক করল তারা ঠিক কাজটি করবে, বুদ্ধিমান হবে অন্যান্য শুটিং এ ফেল করবে। কারণ এক্সিকিউটিভ মিশনের দেশে যেতে হলে শুটিং পাশ করতেই হবে আর নন এক্সিকিউটিভ দেশে শুটিং পাশ করা আবশ্যক নয়। কাজেই ৭০ জনের মধ্যে ৩০/৩৫ জনকে কসোভো যেতে হবে এক্সিকিউটিভ মিশনে। কসোভো মিশনে যাওয়ার দিন মাস দুয়েকের মধ্যেই। অসম্ভব এখন শুটিং পাশ করা মানেই কসোভো মিশন নিশ্চিত। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলাম ভালোমত শ্যুটিং করে কসোভো মিশনে যাব নাকি ইচ্ছে করে ফেল করে বেশি টাকার নন এক্সিকিউটিভ মিশনের জন্য ওয়েট করবো। ঠিক বা ভুল যাই হোক সিদ্ধান্ত নিতে আমার বরাবরই সময় লাগে না। সিদ্ধান্ত নিলাম ভন্ডামি করবো না, ঠিক মতো পরীক্ষা দিব, যা আছে কপালে। বউকে জিজ্ঞস করলাম সেও আমার সাথে একমত পোষণ করল। ঠান্ডা মাথায় ধীরে সুস্থে ফায়ার করলাম।

ফলাফল দশে দশ। মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হলাম কসোভো মিশনে যাচ্ছি। তৎকালীন জাতিসংঘ মিশন নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এআইজি ইউএন ডেস্ক গ্রাউন্ডে উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদেরকে Congratulate করলেন কসোভো মিশনের জন্য। পরের দুয়েক দিনের মধ্যেই medical test এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সমাপ্ত হল। আমরা এসপি হতে এসআই পদমর্যাদার ৩২ জন কর্মকর্তা কসোভো মিশনের জন্য মনোনীত হলাম। টিম লিডার ছিলেন ১৫ তম বিসিএসের মোস্তফা কামাল বাপ্পী স্যার। আমার ব্যাচের ৪ জন কর্মকর্তা মাসুদ করিম ভাই, ইমাম ভাই, আমি এবং সালমা প্রথম বারের মতো জাতিসংঘ মিশনের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হলাম। 

আমাদের নাম প্রস্তাব UN HQ এ পাঠানো হল। আমাদেরকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট করতে বলা হল। ভিসা, টিকেটসহ অন্যান্য সব কিছু জাতিসংঘের দায়িত্ব। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভিসা টিকেট সব পেলাম। যাত্রা নির্ধারিত হল ১০ অক্টোবর ২০০৫।

চূড়ান্ত মনোনয়ন, ভিসা, টিকেট হাতে পেলাম। পুলিশ হেডকোয়াটার্স অ্যাডিশনাল আইজি স্যার আমাদেরকে ব্রিফ করলেন। মাগরিবের একটু আগে ব্রিফিং শেষ হল। ব্রিফিং শেষে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হল। ইউনিফর্ম শীতের কাপড় কত কিছু। সব শেষ করে আমার সাদা Noah  মাইক্রোতে উঠলাম বাসার উদ্দেশ্যে গাড়িতে এসি ছিল না, একটা ফ্যান লাগানো ছিল। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহেও ভ্যাপসা গরম। জানালা খুলে দিলাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাতের প্রথম প্রহর। নগরীর সারি সারি অট্টলিকার ওপর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি শরতের মেঘের পাশে হাসছে একফালি চাঁদ। হঠাৎ আব্বার কথা মনে পড়ল। আহারে, আজ যদি আব্বা বেঁচে থাকতেন কতই না খুশি হতেন। আব্বা মাঝে মাঝেই মাকে বলতেন আমার এ ছেলে একদিন বিশ^ জয় করবে। মানুষের জীবনের কত ইচ্ছাই না অপূর্ণ থেকে যায়! আহারে জীবন এত ছোট ক্যানো?

  লেখক : অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন)

  অ্যান্টিটেরোরিজম ইউনিট, ঢাকা

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x