ড. এম এ সোবহান
পুলিশের সেবাকে তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সর্বত্র বিট পুলিশিং চালু হয়েছে। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি থানাকে ইউনিয়নভিত্তিক, মেট্রোপলিটন বা পৌর এলাকাকে ওয়ার্ডভিত্তিক এক বা একাধিক ইউনিটে ভাগ করা হয়। বিট পুলিশিং ২০১০ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে চালু হয়। এক হিসেবে দেখা গেছে একটি বিটের আন্ডারে গড়ে ৭,০০০-১০,০০০ মানুষ বসবাস করে। সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা একটি বিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
বিট কর্মকর্তা গুরুতর অপরাধের সংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছবেন এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বিট কর্মকর্তা নিজ এলাকার অপরাধীদের তালিকা তৈরি করবেন, ওয়ারেন্ট তামিল করবেন সকল কর্মকর্তা, বাসাবড়ির তথ্য সংগ্রহ করবেন, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি এবং পরিদর্শন করবেন। বিট কর্মকর্তা নিজ এলাকায় চৌকিদার, দফাদার, সরকারি ও বেসরকারি সিকিউরিটির লোকদেরকে প্রশিক্ষণ দিবেন, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন ও যোগাযোগ রাখবেন। বিট কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে বিট এলাকায় গমন করবেন। আগত মানুষদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন, বক্তব্য শুনবেন, তাদের আইনগত পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় পুলিশি সহায়তা দিবেন।
অতি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। অবশ্য অল্প সময়ে পুলিশ সকল ঘটনার মূল আসামিদের আটক করেছে। এগুলো নৈতিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে প্রতীয়মান হয়। একটা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যখন তাদের দায়িত্ব পালন করে না তখন এ সমস্ত সামাজিক সমস্যার উৎপত্তি হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কিছু পদ্ধতি আছে।
প্রথমত ঃ ডিটেকশন বা ঘটনা উদঘাটন। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা ঘটার পর সেটার যথাযথ তদন্ত করে ঘটনাটি উদঘাটন করা। বর্তমানে বিজ্ঞানভিত্তিক বা প্রযুক্তির মাধ্যমে যেমন মোবাইল ট্র্যাকিং, কল লিস্ট, ডি.এন.এ পরীক্ষা, ফুট প্রিন্ট, ফিঙ্গার প্রিন্ট, সুরতহাল রিপোর্ট ও মেডিকেল রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে ঘটনার ডিটেকশন করা হচ্ছে। সঠিক ডিটেকশন হলে অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। যার একটা ব্যাপক প্রভাব পড়ে সমাজে। ফলে অপরাধ কমে যায়।
দ্বিতীয়ত ঃ প্রিভেনশন বা নিবারণ হচ্ছে ঘটনা ঘটতে না দেওয়া। এ সমস্ত পুলিশি পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ঘটনা ঘটার পূর্বেই অপরাধীদেরকে ধরে ফেলা। একটা ঘটনা ঘটলে জান-মালের ক্ষতি হয়। যা কোনো কিছু দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হয় না। নিবিড় পুলিশ টহল, আসামি গ্রেফতার, ইনটিলিজেন্স কালেকশন, কমিউনিটি পুলিশিং ও অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ঘটনার নিবারণ করা যায়।
তৃতীয়ত ঃ প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং। প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং হলো ঘটনার কারণ নির্ণয় করে বা খুঁজে বের করে সে মোতাবেক সমস্যার সমাধান করা। যেমন ঃ জঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করতে রংপুর রেঞ্জে ২০১৬ সালে তৎকালীন ডিআইজি মহোদয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের একত্রে করে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা প্রদর্শন করা এবং ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে বলা যে, কোনো ধর্মই জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। তাছাড়া স্কুল কলেজে জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশ ও বক্তৃতার মাধ্যমেও ছাত্রদেরকে বোঝানো হয়। পরবর্তীতে সারা দেশে একইভাবে প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং শুরু হয়, সে কারণে নতুন রিক্রুট বন্ধ হয়। ফলে জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আসে।
সর্বশেষে আছে কনফিকশন বা শাস্তি। এটি আদালতের বিষয়। পুলিশ আদালতের সাথে সম্পৃক্ত। পুলিশ মামলা তদন্ত করে মামলার সাক্ষী হাজির করে এবং সাক্ষী দিয়ে মামলার শাস্তি বা খালাসে ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে দেশে প্রচলিত বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অপরাধ কমানো যায়। একটা ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে সমাজে তার একটা প্রভাব পড়ে এবং মানুষ এ থেকে শিক্ষা নেয়। অপরাধ কমে যায়।
ফরাসি মনোবিজ্ঞানী লি বোন তার জনতা ব্যবস্থাপনা তত্ত্বে বলেছেন, একদল ব্যক্তি ভালো কাজ করতেও পারে আবার খারাপ কাজও করতে পারে। এটা নির্ভর করে তাদের কিভাবে তৈরি করা হয়, তাদের কিভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং তাদের কিভাবে পরিচালিত করা হয়ে থাকে। আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তর রয়েছে, রয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী; যেমন পরিবার, শিক্ষালয়, সামাজিক সংগঠন, ধর্মীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, উন্নয়ন কর্মী, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক ও অন্যান্য। এ সমস্ত ব্যক্তি ও সংগঠনের সকলকে কাজ করতে হবে। সন্তানের চরিত্র গঠনে পরিবারেরও ভূমিকা অপরিসীম। পরিবার হলো সন্তানের শিক্ষালয়। শিক্ষালয়ের শিক্ষকদেরকে ছাত্র ছাত্রীরা অনুসরণ করে। তাদেরকে ছেলে মেয়েরা আদর্শ ভাবে। শিক্ষকদের শিক্ষালয়ে পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা, ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা ছাত্রদেরকে দিতে পারে।
আমাদের যুব সমাজের একটা বিরাট অংশ নানা রকম হতাশা ও নেশায় আক্রান্ত। অনেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে থাকে শংকিত অনেকে আবার পর্নোগ্রাফি, মাদক, ফেসবুক এবং মোবাইল গেমসে আসক্ত, যা তাদের মূল্যবান সময়, শক্তি ও অর্থ অপচয় হয় এবং চারিত্রিক অধপতনে নিয়ে যায়। বখে যাওয়া ছেলে মেয়েদেরকে কাউন্সিলিং ও মোটিভেশনের মাধ্যমে সুপথে ফেরাতে হবে। যুব সমাজকে বোঝাতে হবে আমরা একটা আত্মমর্যাদাশীল ও বীরের জাতি, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের অহংকার। আমাদের গৌরবময় অতীত রয়েছে। আমরা অমিত সম্ভাবনাময় এক জাতি। আমাদের অনেক অর্জন আছে যেমন কৃষিক্ষেত্রে অধিক শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশ আজ কৃষিজ পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তৈরি পোশাক আজ সারা দেশে সমাদৃত ও দেশের রপ্তানি আয়ের বড় উৎস। এছাড়া শিক্ষাখাত, নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু মৃত্যু কমে যাওয়া, বিদ্যুতায়ন, অবকাঠামো, যোগাযোগ ও ডিজিটালাইজেশনে দেশ প্রভূত উন্নতি করেছে।
যুব সমাজকে আরো বোঝাতে হবে তোমরা অপরাধ করলে বা অপরাধে জড়ালে তোমাদের শাস্তি হবে। তোমরা নিজেরা ও তোমাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অপরপক্ষে যারা পরিশ্রম করে, অধ্যবসায়ের মাধ্যমে লেখাপড়া করে একজন সফল মানুষ হতে পারে। কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শূন্য থেকে আজ দেশের অন্যতম ধনী হয়েছেন মেঘনা গ্রুপের প্রধান জনাব মোস্তফা কামাল। আমাদের সমাজে অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি দরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে এসেছেন।
যুবকদেরকে বোঝাতে হবে তাদেরও মা-বোন আছে, তাদের মা-বোনও তো হামলা, নির্যাতন ও ইভটিজিং এর শিকার হতে পারে। মেয়ে ও নারীদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর একবার বলেছিলেন মেয়েরা অত্যন্ত সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে হবে। এ সংস্কৃতি সমাজে চালু করতে হবে।
রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে শিক্ষামূলক, অপরাধবিরোধী, সমাজসেবামূলক নাটক, সিনেমা, শর্টফিল্ম, বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে নৈতিকতা, মানবিকতা, ভালো ব্যবহার, সৌম্য, ভদ্রতা, সৌজন্যতা, মননশীলতা ও সৃজনশীলতা যোগ করতে হবে।
ডিটেকশন, প্রিভেনশন, প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং ও কনভিকশনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি আরও নিবিড় পুলিশিং চালু করা এবং পুলিশের সেবাকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। করোনাকালীন সময়ে পুলিশ যেমন লাশ দাফন, জনগণকে খাবার পৌঁছে দিয়ে, রোগী ভর্তি করে সেবা দিয়েছে, সেভাবে সমাজ থেকে নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও হত্যাসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ নিবারণ করতে পারে। বিট পুলিশিং এর সদস্যরা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার নিমিত্তে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম, বিভিন্ন মিটিং ও উঠান বৈঠকে উপস্থিত থেকে সমাজের সমস্যা সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং সমস্যার সমাধান করতে পারে। গ্রামে গ্রামে যেয়ে বিট পুলিশ কর্মকর্তারাও যুব সমাজকে বোঝাতে পারে। এছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষদেরকে সংগঠিত করে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে পারে। পুলিশসহ সকলেই যদি তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে তাহলে সমাজ থেকে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, হত্যা, মাদক ও দুর্নীতি দূর করে একটা আদর্শ কল্যাণমুখী সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক : পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, সারদা, রাজশাহী