মোঃ সামসুজ্জামান
নদ-নদী ও খাল-বিলের বৈচিত্র্যময়তা, জল-জঙ্গলের সজীবতা আর দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে বাতাসের উত্তাল তরঙ্গ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে সবুজে শ্যামলে রুপময় করে তুলেছে। এখানে ঋতুর পালাবদলে রং বদলায় প্রকৃতির। উত্তরে হিমালয় পর্বত, পূর্বে পাহাড়ের সারি আর দক্ষিণে সুনীল সাগর চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে রেখেছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এই বদ্বীপকে।
তবু সাগর যখন উত্তাল হয়, বাতাসের তীব্রতা লন্ডভন্ড করে দেয় আমাদের সাজানো সৌন্দর্য। সম্প্রতি সুপার সাইক্লোন আম্ফান আমাদের দেশের একটি বড় অংশ লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ভারতের পূর্বাংশে এবং বাংলাদেশে আঘাত হানা এই প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড় এই শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া প্রথম সুপার ঘূর্ণিঝড়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ২০০৭ সালে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর গঙ্গা বদ্বীপে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৯৯ ওড়িশা ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গোপসাগরে এটি প্রথম সুপার ঘূর্ণিঝড়। আম্ফানে ১৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। ২০০৮ সালের ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগরের উত্তরভাগে রেকর্ড করা সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঘূর্ণিঝড়ও আম্ফান। সুপার সাইক্লোন আম্ফানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন মোঃ সামসুজ্জামান, অতি: পুলিশ সুপার, পিবিআই, ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) ঢাকা।
বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনই নয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গত এক দশকে জঙ্গিবাদ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাডিশনাল চরিত্রে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বিভিন্ন কারণে একসময়ে অভিযুক্ত এই বাহিনীর সদস্যরা তাদের পেশাদারিত্ব আর জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে সম্প্রতি গর্বের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। মহামারি করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া, ত্রাণ বিতরণ, মূমূর্ষ রোগিকে হাসপাতালে পৌছানো, করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা জীবন বাজী রেখে আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনগণের জানমাল রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাবের মধ্যেই ভারত মহাসাগরীয় তীরবর্তী ভারত এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, যশোর, কক্সবাজারসহ আরও অনেক জেলার উপর ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ২০ মে ২০২০ সন্ধায় আঘাত হানে এবং উপকূলবর্তী জেলা সমূহ লন্ডভন্ড করে দেয়।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবেলায় আইজিপি মহোদয়ের দিক নির্দেশনাসমূহ
চলমান করোনা সংকটের মধ্যে আরেক দূর্যোগের নাম ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশের অভিভাবক আইজিপি ড. বেনজির আহমেদ বিপিএম (বার) মহোদয়ের প্রেরিত ঘূর্ণিঝড়/জলোচ্ছ্বাসের প্রাক প্রস্তুতি, ঘূর্ণিঝড়/জলোচ্ছ্বাসের সময় করণীয় এবং ঘূর্ণিঝড়/জলোচ্ছ্বাসের পরবর্তী করণীয় সম্বলিত নির্দেশনাসমূহ অনুসরণ পূর্বক ঘূর্ণিঝড় কবলিত জেলাসমূহের পুলিশ সদস্যরা দিনরাত অহর্নিশ পরিশ্রম করেছেন।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ২০ মে ২০২০ খ্রিঃ বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। করোনা সংকটের মতো ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি থেকে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি সুরক্ষা নিশ্চিতে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের কর্ণধার ড. বেনজির আহমেদ বিপিএম (বার) ঘূর্ণিঝড় শুরুর পূর্বেই ঘূর্ণিঝড় কবলিত পুলিশের প্রত্যেকটি ইউনিটকে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
- আম্ফানের মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে জনগণের সহযোগিতার প্রয়োজন বিধায় ঘূর্ণিঝড়ে দেশের সম্মানিত নাগরিকগণকে কিছু বিষয় অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
- আবহাওয়া অফিসের ঘোষণা অনুযায়ী যেসব এলাকায় আম্ফানের আঘাত হানার জোরালো আশংকা রয়েছে, সেইসব এলাকার লোকজনকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হয়।
- আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় সম্ভব হলে শুকনো খাবার ও খাবার পানি, রাতে চলাচল প্রয়োজন হলে ইলেকট্রনিক উপকরণ টর্চ লাইট, ব্যাটারি ইত্যাদি সাথে রাখতে এবং গৃহপালিত পশুপাখি যতটা সম্ভব নিরাপদ ও উঁচুস্থানে রাখতে বলা হয়।
- ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশংকা থাকায় ঘূর্ণিঝড় চলাকালে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করা, ঘরে থাকা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, গ্যাসের চুলা যতটা সম্ভব বন্ধ রাখা, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী অবশ্যই পানি নিরোধী পলিথিন কিংবা শুকনো থাকবে এমন বস্তু দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে সংরক্ষণ করার জন্য বলা হয়।
- আম্ফান ঘূর্ণিঝড় করোনাকালীন সময় হওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সঙ্গে রাখা, যতটা সম্ভব সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থানের জন্য বলা হয়।
- ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময় উদ্ধার অভিযানের রেসকিউ সামগ্রী স্পিডবোট, রেসকিউ বোট, নৌকা, লাইফ জ্যাকেট ইত্যাদি সামগ্রী ভালভাবে সংরক্ষণ করার জন্য বলা হয়।
- ঘূর্ণিঝড় থেকে সুরক্ষিত থাকতে প্রতিটি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য এবং অন্যকে নিয়ে যেতে উদ্ভুদ্ধ করা হয়। এ ব্যাপারে যেকোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবক কিংবা পুলিশের সহায়তা নেওয়া ও পুলিশের স্থানীয় ইউনিটের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
- ঘূর্ণিঝড় কবলিতদের তথ্য কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রয়োজন হতে পারে এমন যেকোন সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে সদা প্রস্তুত থাকার জন্য দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
- ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবেলায় পুলিশের সহায়তা নেওয়ার জন্য, নিজে সুরক্ষিত থাকতে এবং অপরকে সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানানো হয়।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের কার্যক্রম
সাতক্ষীরা বাংলাদেশের উপকূলর্তী জেলা হওয়ায়। বড় বড় ঘুর্ণিঝড় এখানে অতীতে আঘাত হানার ফলে অত্র জেলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সুপার সাইক্লোন “আইলা”র আঘাতে প্রচুর প্রাণহানি হয়েছিল অত্র জেলায়। অতীতের ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় রেখে জেলা পুলিশ আম্ফান ঝড় মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। প্রথমেই জেলার সকল সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে সমন্বয় সভা করা হয় এবং সেখানে জেলা পুলিশের করণীয় ঠিক করা হয়। ঝড়ের আঘাতে শ্যামনগর থানা এলাকার গাবুরা, পদ্মপুকুর এলাকা থেকে অসহায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার জন্য ব্যাপক মাইকিং করে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। প্রত্যেক পাড়া মহল্লার সকল মানুষকে যথাসময়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, অন্যান্য সরকারি দফতরের সাথে সমন্বয় করে অনিরাপদ মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার জন্য পুলিশের টিমভিত্তিক জনবল নিয়োগ করা হয়।
ঘূর্ণিঝড় কবলিত শ্যামনগর এলাকার দুইজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদের কর্মকর্তাকে দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক শ্যামনগরে উপস্থিত থেকে অসহায় মানুষকে খোল পেটুয়া নদী পার করে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসে। মানুষ ও গবাদি পশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যা জেলা পুলিশ সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছে। কারণ কোন সাধারণ মানুষ তাদের ঘর বসত বাড়ি ছেড়ে আসতে চায় না। প্রবল ঝড় বৃষ্টির মাঝেই পুলিশ সদস্যগণ নিজেরা জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে তাদেরকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসে। জেলা পুলিশের প্রতিটি সদস্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে অসহায়, বয়স্ক, পঙ্গু, প্রতিবন্ধি মানুষদের অনেকটা কোলেপিঠে করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। কর্দমাক্ত রাস্তা, ঝুঁকিপূর্ণ খেয়াঘাট, তুমুল ঝড় আর ঝুম বৃষ্টির মধ্যে কাজ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং, যা সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ আম্ফান ঝড়ের সময় সফলভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে। জনগণের নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রতিটি পুলিশ সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। করোনাকাল বিবেচনায় সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হলেও বাস্তব পরিস্থিতির কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পালন করা সম্ভব না হলেও পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক চেষ্টা করেছে সামাজিক এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার জন্য।
ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন সাতক্ষীরা জেলার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিছিন্ন হয়ে পড়ায় মাঝ রাতের পর মোবাইল ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে মোবাইল এবং টেলিফোনে মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা এমনকি কারোর পক্ষে কোথাও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি এবং অন্য কোন দফতর বা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। প্রচন্ড বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ে কোথায় কি ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না। এমন সময় পুলিশের ওয়াকি টকির মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় খোঁজ নিয়ে ঝড়ের গতিবেগ ও তীব্রতা এবং প্রাণহানির খবর নেওয়া হয়। এভাবে ওয়াকি টকির সুবিধা কাজে লাগিয়ে জেলা পুলিশ থানাসমূহের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। ভোর রাতে ০৩ জনের প্রাণহানির খবর পায়। কিন্তু রাস্তার উপরে প্রচুর গাছপালা পড়ে থাকায় সে সব এলাকায় পুলিশের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছিল না।
জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম বার এর সার্বিক দিকনির্দেশনায় এমনি প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রাস্তা পরিষ্কারে জেলায় ফায়ার সার্ভিসের জনবল কম থাকায় পুলিশের ২২ টি টিম গঠন করা হয়। তীব্র ঝড়ে গাছপালা উপড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যাবে এমন আশংকায় ঝড়ের ২ দিন পূর্বেই প্রয়োজনীয় ইলেকট্রিক্যাল করাত, ম্যানুয়াল করাত, কুঠার, রশি, লাঠি ইত্যাদি সকল থানা, ফাঁড়ি, ক্যাম্প এবং পুলিশ লাইনস্-এ সংগ্রহ করে রাখে। সেহেরীর পর থেকে ঝড়ের গতিবেগ কিছুটা কমলে সকল ইউনিটকে ভোর থেকে যত দ্রুত সম্ভব গাছপালা পরিস্কার করে মূল সড়কগুলো সচল করতে জেলা পুলিশের প্রায় প্রতিটি সদস্য কাজ শুরু করে। এমনকি পুলিশ সুপার নিজেও একটি টিম নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। স্থানীয় জনগণ ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে এতোবড় ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় পড়ে থাকা বিশাল বিশাল গাছগুলো বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কেটে পরিষ্কার করতে সমর্থ হয়।
টেলি-কমিউনিকেশন সচল না থাকায় সকাল ১০ টা পর্যন্ত কোন খবর পাওয়া সম্ভব ছিল না প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে। জেলা পুলিশের মূল উদ্দেশ্যে ছিল মূল সড়কগুলির যানবাহন চলাচল উপযোগী করতে পারলে দ্রুত এলাকায় উদ্ধারকারী দল ত্রাণ সামগ্রী, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সেবা দ্রুত চালু করা যাবে। বিকেল ১৫.০০ টা নাগাদ জেলা পুলিশ অক্লান্ত পরিশ্রম করে জেলার মূল সড়কগুলো সচল করতে সক্ষম হয়। যার ফলে সকল সেবা সামগ্রী দ্রুত উপদ্রুত এলাকায় পৌঁছানো সম্ভব হয়। রাস্তাঘাট সচল হওয়ার পর যোগাযোগ ও মানুষের জীবন যাপন স্বাভাবিক হতে দেখা যায়।
আম্ফান পরবর্তী সাতক্ষীরা জেলায় বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উপকূলে বাঁধসমূহ ভেঙ্গে পানিতে তলিয়ে যায়, হাজার হাজার ঘরবাড়ী, মাছের ঘের ইত্যাদি পানির স্রোতে ভেসে যায় বহু জায়গায়। জেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সমন্বয়ে জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্বুদ্ধ করণের মাধ্যমে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধসমূহ মেরামত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে জেলা পুলিশের সদস্যরা। পুলিশ সদস্যরা সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করে আশাশুনির প্রতাপনগর, আনুলিয়া, শ্রীউলা, শ্যামনগর থানা এলাকার গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনি এলাকার বেশ কিছু ভাঙ্গা বাঁধ মেরামত করতে সমর্থ হয়।
আম্ফান পরবর্তী জেলার সকল কল্যাণমূলক কাজের সাথে জেলা পুলিশের নিবিড় সম্পৃক্ততা ছিল। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, বিভিন্ন এনজিও ও সক্ষম ব্যক্তিদের মাধ্যমে অভাবী মানুষদের মানসম্মত খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করার কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা ছিল প্রশংসনীয়। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দশ হাজারের বেশি পরিবারকে খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। জেলা পুলিশের সদস্যরা নিয়ম শৃংখলার প্রকৃত অভাবীর নিকট পৌঁছালে মধ্যবিত্তদের সহায়তা করা, নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতার জন্য সবার মুখে মুখে প্রশংসার কথা শোনা যায়। পুলিশের কাজ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কিন্তু তার বাইরে এ ধরণের কাজ সমাজের সকলস্তরে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করতে দেখা যায়। সুপার সাইক্লোন আম্ফান পরবতী কার্যক্রমে জেলা পুলিশের যথাযথ দায়িত্ব পালনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে সহায়ক হয়েছে।
চমৎকার টিমওয়ার্কের মাধ্যমে রাস্তায় পড়ে থাকা শত শত গাছ পুলিশ সদস্যরা দ্রুত অপসারণ করতে পেরেছে। ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশকে গাছ কাটতে দেখে পাড়া, মহল্লার অনেক মানুষ বিপদের মাঝেও সহাস্যবদনে পুলিশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।
জেলা পুলিশ সদস্যদের আম্ফান মোকাবেলায় মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল মূল চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি মানুষকে Hard Structure এ থাকার জন্য স্যোশাল মিডিয়া পেজ প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি মাইকিং, কমিউনিটি পুলিশিং এর মাধ্যমে তার নিশ্চয়তা বিধান, অঞ্চলভিত্তিক নেতাকর্মীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপন করতে দেখা যায়। তাছাড়া শ্রেণী বিন্যাস করে নিরাপদ সময়ে মহিলা, শিশু, অসুস্থ ও বয়স্কদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়, যা প্রাণহানি কমাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে সেখানে পুলিশ সদস্যদের কর্মতৎপরতা ছিল প্রশংসনীয়।
অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও জেলা পুলিশ এর ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা এবং উদ্ধার তৎপরতায় লজিস্টিক সাপোর্ট খুবই জরুরী যেমন-দূর্গত এলাকায় উন্নত মানের উদ্ধার বোট এবং সেগুলো পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্য দরকার।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পরবর্তী সময়ে জেলার পুলিশ সদস্যরা বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে বারোশত ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় দূর্দশাগ্রস্থ পরিবারের মাঝে ৪৮ টন সরকারি গম বিতরণ করে।
পটুয়াখালী জেলা পুলিশের কার্যক্রম
উপকূলীয় এলাকায় আম্ফান আঘাত হানার পূর্বেই পটুয়াখালী জেলা পুলিশ সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে সুসমন্বয় করতঃ সার্বিক কার্যক্রম গ্রহণ করে। জেলার প্রত্যেকটি থানা এলাকায় পুলিশ সদস্যগণ সতর্কতামূলক বাণী সম্বলিত মাইকিং করাসহ যে সকল জনসাধারণ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ছিল তাদেরকে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, আশ্রয়কেন্দ্রে আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোমলমতি শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের সর্বত্তোমভাবে সহায়তা করা সহ তাদের জলযানে ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রেও বিশেষ সহায়ত প্রদান করতে দেখা যায়।
জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মইনুল হাসান পিপিএম সাইক্লোন শেল্টার সমূহে ঘনঘন পরিদর্শন করে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে জেলার পুলিশ সদস্যদের দিক নির্দেশনা দেয়া হয় বলে জানান। পুলিশ সুপার নিজেও রাত অবধি একাধিক সাইক্লোন শেল্টার পরিদর্শন করে সেখানে আশ্রয় নেয়া জনসাধারণকে সার্বিক বিষয়ে আশ^স্ত করেন। সম্ভাব্য ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে আম্ফান আঘাত হানার পূর্ব রাত ১১.০০ টায় পুলিশ সুপার পটুয়াখালী লঞ্চ টার্মিনাল পরিদর্শন করে সেখানে নোঙ্গর করে থাকা বৃহদাকার লঞ্চসমূহের স্টাফদের ঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্কতামূলক দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
২০.০৫.২০২০ ইং তারিখ বিকাল ০৫.০০ টা থেকে ২১.০৫.২০২০ ইং তারিখ পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় পুলিশী টহল ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা হয়। ফলশ্রুতিতে আইনশৃংখলা জনিত কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
সাইক্লোন পরবর্তীতে উদ্ধারমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সড়কে পড়ে থাকা গাছপালা দ্রুত অপসারণ করে সড়ক যান চলাচলের উপযোগী করতে কাজ করে জেলা পুলিশ। এছাড়া ভেঙ্গে পড়া কাঁচা ঘরবাড়ি অপসারণের কাজ সুচারুরূপে সু-সম্পন্ন করে জেলা পুলিশ সদস্যরা।
খুলনা জেলা পুলিশের কার্যক্রম
জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারনা চালিয়েছেন। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য, সুরক্ষামূলক জিনিসপত্র সাথে নিয়ে যাওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহ ইত্যাদি বিষয়ে জনসাধারণকে মাইকিং এর মাধ্যমে সচেতন করতে দেখা যায়। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবেলায় পুলিশের সহায়তা নেওয়ার জন্য, নিজে সুরক্ষিত থাকতে এবং অপরকে সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানানো হয়। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন কিছু বাধ সরকারী অন্যান্য দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের সহিত পরিদর্শন করেন জেলার পুলিশ সুপার।
পুলিশ সুপার, খুলনা জেলার উপকূলীয় ঝুকিপূর্ণ থানা কয়রা পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় ও দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে থানার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করতে দেখা যায়।
যশোর জেলা পুলিশের কার্যক্রম
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা জেলা পুলিশ সুপার অন্যান্য সদস্যদেরকে নিয়ে প্রস্তুতি সভা করেন এবং ঝুকিপূর্ণ অঞ্চলের মানুষকে সতর্কী করণ কার্যক্রম হিসাবে মাইকিং, কমিউনিটি পুলিশিং সসদ্য এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তীব্রতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করেন। কোন কোন স্থানে পুলিশের নিজস্ব গাড়ী ব্যবহার করে ঝুকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়।
আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত এবং আহত মানুষদেরকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া থেকে শুরু করে গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেগুলো অপসারণ করে দ্রুত মানুষের চলাচল উপযোগী করা, দূর্গতদের ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজ পুলিশ সদস্যরা সহজেই সম্পন্ন করে মানুষের আস্থা অর্জন এবং প্রসংশীত হতে দেখা যায়।
পিরোজপুর জেলা পুলিশের কার্যক্রম
পিরোজপুর জেলা পুলিশ ঘূর্ণিঝড় “আম্ফান” মোকাবেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝঁকিপূর্ণ এলাকার সম্মানিত নাগরিকবৃন্দকে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌছিয়ে দেওয়া, আশ্রয়কেন্দ্র ও ফেলে আসা বাড়ি ঘরে নিরাপত্তা প্রদান, অসহায় মানুষের আর্থিক সহায়তা, খাদ্যসামগ্রী প্রদান সহ রাস্তার উপর ভেঙ্গে পড়া গাছ অপসারণ করে দ্রুত রাস্তা চলাচলের উপযোগী করার কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে বলে জানা যায়।
পিরোজপুর জেলা পুলিশ সাইক্লোনের পূর্বে যেমন তৎপর ছিল, সাইক্লোন চলাকালীন সময়েও তৎপর ছিল এবং সাইক্লোন পরবর্তী সকল কাজ সুচারু রুপে সম্পন্ন করে।
বাগেরহাট জেলা পুলিশের কার্যক্রম
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উপকূলের দিকে ধেঁয়ে আসায় উপকূলীয় এলাকা থেকে নিরাপদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সাইক্লোন শেল্টারে যেতে মানুষকে সহযোগিতা সচেতনতা মূলক মাইকিং করা এবং সাইক্লোন শেল্টারে অবস্থানরত মানুষের সার্বিক খোঁজখবর নিতে দেখা যায় জেলা পুলিশ সুপারের নের্তৃতে অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের সাথে বাগেরহাট জেলা পুলিশ।
সুপার সাইক্লোন আম্ফান এর তান্ডব শেষে বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন স্থানে গাছপালা এবং গাছের ডাল রাস্তার উপর ভেঙ্গে পড়লে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। জেলা পুলিশ বাগেরহাট ও জনসাধারণের সহায়তায় অতি দ্রুত ভেঙ্গে পড়া এসমস্ত গাছ কর্তন পূর্বক অপসারণ করে প্রতিবন্ধকতা দূর করে চলাচলের উপযোগী করে।
পুলিশ সম্পর্কে সর্বসাধারণের যুগ যুগ ধরে চলে আসা নেতিবাচক ধারণা বর্তমানে পুলিশের দক্ষতা, জনসম্পৃক্ততা, কাজের প্রতি স্পৃহা, দেশের প্রতি ভালবাসা, বিভিন্ন কারণে পর্যায়ক্রমে ইতিবাচক ধারণা পরিণত হচ্ছে। বিশেষ করে করোনা মহামারিকালে জনগণের প্রকৃত সেবক হিসেবে পুলিশ নিজেদেরকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে পুলিশের সুশাসন, নেতিবাচক কাজের শাস্তি প্রদান সমাজের যে কোন পর্যায়ের অপরাধকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা, আইনের শাসনের বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, হয়রানি বন্ধসহ ব্যাপক গণমূখি কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে ইতিবাচক পুলিশিং এর ভাবধারা অব্যাহত রাখায় সাধারণ মানুষের কাছাকাছি পৌছে যাচ্ছে পুলিশ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে জনমনে আস্থার জায়গাও তৈরি হচ্ছে।
সর্বশেষ আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণ, খাদ্য সহায়তা পৌছে দেয়া, ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত মানুষের দ্রুত উদ্ধার করা ইত্যাদি কারণে পুলিশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এধরণের জনমূখী কল্যাণকর কাজ পুলিশকে আগামী দিনে সুনামের সহিত পথ চলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
পরিশেষে বলা যায় আজ থেকে ৪০ বৎসর আগে ১৯৭৫ সালে প্রথম পুলিশ সপ্তাহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে মানুষকে ভালবাসতে, সেবা দিতে, সৎ থাকতে এবং পুলিশকে যেন মানুষ ভয় না করে ও ভালবাসে সেভাবে কাজ করে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে বলেছিলেন। আম্ফান ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সেই আলোকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক দিক নির্দেশনায় মানুষের আস্থা অর্জন করতে পুলিশ সদস্যরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং লক্ষ অর্জনে সক্ষম হবে।
লেখক : অতিঃ পুলিশ সুপার,
পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ), ঢাকা।
0 Comments