ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

ইমদাদুল হক মিলন

এখন আবার চা করছো কেন?

বুয়াটি মধ্যবয়সী। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক বছর আগে। ফরিদপুরের ভাঙা এলাকার লোক। একটা ছেলে আছে। ছেলেকে পুরনো ঢাকার নামকরা এতিমখানায় দিয়েছে। ছেলের নাম রাজু। স্বামী পরিত্যক্ত বুয়াটি এখন ছেলের নামেই পরিচিত। রাজুর মা।

রুবার কথা শুনে কিচেনের দরজার দিকে তাকালো রাজুর মা। তার গায়ের রং ঘোরকালো। একটু মোটা ধাচের শরীর। লাল রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরা। মাথার ঘনচুলে তেল দেওয়া। সেই চুল শাড়ির মতোই লাল রঙের একটা ফিতা দিয়ে মাথার পিছন দিকে বেঁধে রেখেছে।

কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে রাজুর মাকে একটু যেন খেয়াল করেই দেখল রুবা। তারপর ওই প্রশ্ন।

চুলায় টগবগ করে ফুটছে পানি। সুন্দর একটা মগ রাখা আছে হাতের কাছে আর লিফটন টিব্যাগের বক্স। ফুটন্ত পানি মগে ঢেলে মাত্র টিব্যাগ দেবে, রুবার কথা শুনে হাত থেমে গেল রাজুর মার। হাসিমুখে বলল, সাহেব চাইছেন।

তাই নাকি?

হ। সেয় না চাইলে আমি অখন চা বানামু ক্যান?

আচ্ছা ঠিক আছে। চা আমি করছি। তুমি গিয়ে ওয়াসিংমেশিন থেকে কাপড়গুলো বের করো।

ইস্তারিও কইরা ফালামু?

করো গিয়ে।

রাজুর মা চলে যাওয়ার পর তার বাকি কাজটা রুবা করলো। তারপর চায়ের মগ নিয়ে বেডরুমে এসে ঢুকল।

বেডরুমের ভেতরই, বাথরুমের সঙ্গে ড্রেসিংরুম। ড্রেসিংরুমের দেয়াল জুড়ে বিশাল মিরর লাগানো। সেই মিররের সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছেন রেজা। তাঁর পরনে গ্রেকালারের প্যান্ট আর টমি হিল ফিগারের সুন্দর সাদাশার্ট। পায়ে চকচকে জুতো। জুতোর রং খয়েরি। আকাশি রঙের যে টাই গলায় বাঁধছেন সেই টাও বেশ দামি ব্রান্ডের। রেজার গা থেকে ভুর ভুর করে আসছিল আজেরোর স্নিগ্ধ গন্ধ।

আয়নার ভেতর দিয়ে স্ত্রীকে চায়ের মগ হাতে পেছনে এসে দাঁড়াতে দেখলেন রেজা। অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে মুখ ফেরালেন। চা চাইলাম আমি, খাচ্ছো দেখি তুমি!

রুবা হাসলো। আমি খাচ্ছি না।

তাহলে?

নিজহাতে তৈরি করে তোমার জন্য এনেছি।

টাই বাঁধা শেষ করে হাসলেন রেজা। বলো কী? তুমি আমার জন্য চা করে এনেছ?

হ্যাঁ।

স্বামীর হাতে চায়ের মগ দিল রুবা। মগ হাতে নিয়ে তীক্ষèচোখে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন রেজা। কারণটা কি বলো তো?

রুবা গম্ভীর হলো। এই এক সমস্যা তোমার। সব কিছুতে সন্দেহ।

না মানে কখনও এভাবে চা নিয়ে আসো না তো…

কখনও আসি না বলো না। কম আসি বলতে পারো।

এজন্যই কারণটা জানতে চাইছি।

কোনও কারণ নেই। বৃদ্ধ স্বামীর একটু সেবা করছি।

রেজা হাসলেন। তাই বলো।

তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি সত্যি বুড়ো হয়ে গেছি।

তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

তোমার সঙ্গে একদমই মানায় না।

হ্যাঁ। কী মনে হয় জানো?

কি?

বাবা আর মেয়ে।

রুবা খিলখিল করে হাসল।

রেজা হাসলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, এটা আমি জানি। জানি বলেই নানা ধরনের সন্দেহ, নানা রকমের ভয় তোমাকে নিয়ে।

ভয়ের কারণ নেই।

কেন?

এই বয়সে তোমাকে ছেড়ে যাবো না। যেতে হলে আগেই যেতাম।

আগে কেন যাবে? তখন তো আর বুড়ো ছিলাম না।

তুমি শুরু থেকেই বুড়ো।

চা শেষ করে মগটা রুবার হাতে ফেরত দিল রেজা। নিজহাতে চা তৈরি করে খাওয়াবার জন্য ধন্যবাদ।

হয়েছে। এখন তাড়াতাড়ি বিদায় হও।

রেজা ভুরু কুঁচকালেন। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছো কেন? মতলব কী? কোথাও যাবে নাকি?

আরে না। কোথায় যাবো?

তাহলে?

কাজ আছে।

কী কাজ?

উহ বাবা! আরে ছেলেদেরকে ফোন করবো।

এবার যেন স্বস্তি পেলেন রেজা। তাই বলো। আচ্ছা চলি। খোদা হাফেজ।

রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন রেজা।

গুলশান এলাকার এই বাড়িটা পুরনো আমলের। দেড় বিঘার ওপর দোতলা বাড়ি। একতলা দোতলা মিলে অনেক রুম। সামনে লন, পিছনে বাগান। সিঁড়িটা বেশ চওড়া, রুমগুলো বড় বড়। আজকাল এরকম বাড়িগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ডেভলাপাররা ফিফটি ফিফটি এরেঞ্জম্যান্টে নিয়ে নিচ্ছে সব বাড়ি। ছতলা বিল্ডিং করে নিজেরা নিচ্ছে অর্ধেক ফ্ল্যাট, জমির মালিককে দিচ্ছে অর্ধেক। সঙ্গে ক্যাশ টাকা, যতদিন বিল্ডিং তৈরি না হচ্ছে ততোদিন থাকার জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দিচ্ছে।

এই বাড়ির পিছনেও ডেভলাপার লেগেছিল। রেজা ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি রাজি। রুবা কিছুতেই রাজি না। তার এরকম খোলামেলা বাড়ি ভালো লাগে। ঘিঞ্জি ফ্ল্যাট বাড়িতে সে থাকতে পারবে না।

রুবার কারণে বাড়িটা ডেভলাপারকে দিতে পারেননি রেজা। এখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কথাটা মনে হলো তাঁর। ওই এরেঞ্জম্যান্টে যেতে পারলে নিজেরা বড় একটা ফ্ল্যাটে থেকে ভাগে পাওয়া বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিলে তিন চারলাখ টাকা মাসে ভাড়াই পাওয়া যেত। রুবার জন্য হলো না।

লনে কালো পাজেরোটা দাঁড়িয়ে আছে। মাসখানেক আগে এই গাড়িটা কেনা হয়েছে। রেজার বন্ধু নান্নু টোকিওতে থাকেন। গাড়ির বিশাল ব্যবসায়ী। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় দুবন্ধুর। কথায় কথায় রেজা বলেছিলেন তাঁর একটা কালো রঙের পাজেরোর খুব শখ।

মাস দুয়েকের মধ্যেই লেটেস্ট মডেলের কালো পাজেরো পাঠিয়ে দিয়েছে নান্নু। ঢাকায় কিনলে ৮০ লাখের মতো পড়তো, নান্নু চার পাঁচলাখ কমে দিয়েছে। অর্থাৎ লাভটা করেনি। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর আবার বিজনেস কিসের?

রেজার ড্রাইভারের নাম মুরাদ। সাহেবকে নেমে আসতে দেখেই গাড়ির দরজা খুলে ধরেছে সে। রেজা এসে গাড়িতে চড়বেন, মুরাদ তাঁকে সালাম দিল। স্লামালেকুম স্যার।

রেজা গম্ভীর গলায় বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম।

গাড়ি গেটের কাছে আসতেই রেজা দেখতে পেলেন গেটের বাইরে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। রেজার গাড়ি দেখে দারোয়ান ব্যস্ত হয়েছে। যুবককে কী কীসব বলে স্যালুট দেওয়ার মতো সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। গেট আগেই খুলেছিল।

রেজা গম্ভীর গলায় বললেন, ড্রাইভার, গাড়ি রাখো।

সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাল মুরাদ। গ্লাস নামিয়ে রেজা বললেন, কী ব্যাপার দারোয়ান? ছেলেটা কে?

দারোয়ান ভয়ার্ত গলায় বলল, আপনের সঙ্গে দেখা করতে আসছে স্যার। আমি বলছি স্যার এখন অফিসে যাবেন। এই সময় তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না।

তারপর?

তারপরও যায় নি স্যার। দাঁড়াইয়া রইছে।

ডাকো।

দারোয়ান ছুটে গিয়ে যুবককে ডাকলো। আসেন। স্যার ডাকছেন।

যুবক বিনীত ভঙ্গিতে রেজার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। স্লামালায়কুম স্যার।

ওয়ালাইকুম সালাম। কী ব্যাপার, বলো?

আমাকে স্যার আমার বাবা আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।

তোমার বাবা কে?

আমার বাবার নাম জাকির হোসেন। আমাদের গ্রাম হচ্ছে স্যার আপনাদের গ্রাম। নূরপুর।

সঙ্গে সঙ্গে কপালে দুতিনটা ভাঁজ পড়ল রেজার। ও আচ্ছা। বুঝেছি। তোমার নাম কী?

আমার নাম স্যার মুনির হোসেন।

তোমার বাব কী জন্য তোমাকে পাঠিয়েছেন?

আপনি স্যার এত বড় বিজনেসম্যান, এত লোকের উপকার করেন। বাবা এজন্যই আমাকে…

মানে চাকরির জন্য পাঠিয়েছেন?

জ্বি স্যার, জ্বি।

লেখাপড়া কত দূর করেছ?

মাস্টার্স করেছি স্যার। পলিটিক্যাল সায়েন্সে।

আমার অফিসে এসো, কথা বলবো।

কবে আসবো স্যার?

দিন দশেক পরে।

জ্বি স্যার, জ্বি।

রেজা গ্লাস তুলে দিলেন। ড্রাইভার, চলো।

তারপর মনে মনে বললেন, জাকির হোসেনের ছেলে! জাকির তার ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়েছে চাকরির জন্য! আচ্ছা!

ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। 

চলবে…

লেখক : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x