আবিদা সুলতানা
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সবচাইতে আলোচিত বিষয় ‘পদ্মা সেতু’। এ সেতু আমাদের জাতীয় অহংকার ও সক্ষমতার প্রতীক। আবেগ আর সাহসের আরেক নাম‘পদ্মা সেতু’। এটি যেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মাইলফলক।
ঢাকার পাশর্বর্তী জেলায় জন্ম ও বেড়ে উঠায় পড়াশুনার জন্য কিংবা চাকুরিকালীন সময়েও কেন জানিনা কখনও পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়ার সুযোগ হয়নি। পুলিশের চাকরির প্রায় আঠারো বছর পার হলে ২০১৯ এ প্রথমবারের মত দাপ্তরিক কাজে গোপালগঞ্জ যাওয়ার সুযোগ হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ পুলিশের প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণ কাজে। যাবার আগে মনে মনে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলাম যে, এই সুযোগে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার সুযোগ হলো। সরকারি গাড়ি যোগে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহকর্মী সহকারি পুলিশ সুপার নজরুলসহ আমার তিন বছর বয়সী পুত্র শান আর বড় আপাকে নিয়ে ঢাকা থেকে কাক ডাকা ভোরে রওনা হলাম। ভোর বলেই হয়তো ঢাকার রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। গুলিস্তান ফ্লাইওভার চোখের পলকে পার হয়ে বুড়িগঙ্গাও পার হয়ে গেলাম অতি দ্রুতই। এরপর ভ্রমণের বাকি অংশ যা আমার জন্য পুরোটাই বিষ্ময়!
এত চমৎকার হাইওয়ে বাংলাদেশে থাকতে পারে, এটা সত্যিই আমার জানা ছিলনা। মন্ত্রমুগ্ধের মত উপভোগ করতে থাকলাম স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সংযোগ মহাসড়কের অপরুপ দৃশ্য। সম্পূর্ণ পিচ ঢালা পথে আমাদের বহনকারী গাড়ি কত গতিতে চলছিল, তা এতটুকু মাথায় ছিল না। প্রতিনিয়ত ড্রাইভারকে গতিনিয়ন্ত্রণ করতে বলা আমি পদ্মাসেতুর সংযোগ সড়কের অপরূপ রূপে বাকরুদ্ধ। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ তখন পুরোপুরি বিষ্মৃত!
রাস্তার দুপাশের অপরুপ দৃশ্য! কাশফুলে ছেয়ে আছে মাঠঘাট, উপরে মেঘে ঢাকা আকাশ। আর জমিনে যেন সেই মেঘের দল নেমে এসে সবুজের মাঝে লুটোপুটি খাচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুলের পাপড়ি বাতাসে তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে। রাস্তার মাঝ বরাবর রোড ডিভাইডারে বাহারি গাছের সারি। কোথাও কোথাও চমৎকার ফুলের বাহার। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ-ঘাট আর ফসলি জমি আর কাশবন দেখতে দেখতে কখন যে মাওয়া ঘাটে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর কাছে চলে এসেছি, বুঝতেই পারিনি। আপাও আমার মতই পথের সৌন্দর্য্যে অপরিসীম ভাল লাগায় যেন ডুবে ছিলেন পুরো সময়। ঘাটের কাছ এসে বার বার আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাকে সেই ভ্রমণের সঙ্গি করেছি বলে।
সৌন্দর্য্যে মাখামাখি হয়ে আমাদের গাড়ি মাওয়া ফেরীঘাট পৌঁছালে আগে থেকে মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার ব্যাচমেট জায়েদ উল আলমের নির্দেশনা প্রাপ্ত একজন পুলিশ অফিসারের তৎপরতায় অতিদ্রুতই আমাদের গাড়িটি সুন্দর ছোট একটা ফেরিতে জায়গা পেয়ে গেল। ফেরীটিতে স্থান পাওয়া বেশির ভাগ গাড়িই ব্যক্তিগত গাড়ি। ফলে বাস ট্রাকের ভীড় নেই। গাড়ি থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে ফেরীর দোতলায় উঠে গেলাম। একটা বেড, সোফা, টেবিল আর চেয়ার সমেত মোটামুটি বেশ ছিমছাম একটা কক্ষ। আপ্যায়ণের জন্য ফেরীর লোকজনও এসে হাজির হলেন। মাওয়া ঘাটে এসে ইলিশ মাছ খাব না তা কি হয়? কত গল্প শুনেছি ছাত্রজীবনে বন্ধুদের মুখে। তাই ভাত আর ইলিশ মাছের অর্ডার দিয়ে ফেরির বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। অসাধারণ পদ্মা সেতুর নিমার্ণ দৃশ্য দেখে আবেগে যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম! সেতুর কাজ চলছে পুরো দমে। বেশ কিছু পিলার স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দন্ডায়মান, কিছুর কাজ চলছে। সেতু নির্মাণের কত সরঞ্জাম! কত শত জনের কর্মতৎপরতা! কর্ম চাঞ্চল্যে মুখরিত পুরো এলাকা।
এ যেন বাল্মীকি রচিত প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণে সমুদ্রের বুকে পাথরে গড়া সেই আদম সেতুর মত প্রমত্তা পদ্মার বুক চিড়ে একটা একটা পিলারের সুতোই গাঁথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ছোয়াঁ মালা বাঙালির ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’!
আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবছি বাংলাদেশ নামক ছোট্ট ব-দ্বীপ রাষ্ট্রের দূরদর্শী এক রাষ্ট্রনায়কের অসীম সাহসিকতা ও পর্বতসম আত্মবিশ্বাসের অবিশ্বাস্য এক রূপকথা- খরস্রোতা পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন এই বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু বাস্তবায়নের কথা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজা, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের ভেদ করে নিজস্ব অর্থায়নে দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসব্রিজ যার ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একক রেলপথ নির্মাণ করে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছেন। এ সেতু মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ টি জেলা সরাসরি সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত করেছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্পান এবং দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১ মিটার পরিকল্পনায় নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় সেতু স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’।
২০০৬ সালে পদ্মা সেতু তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর কিছুদিন পরই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পদ্মা সেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের সেতু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষের আবেগ। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য স্পৃহা এবং আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। ২০১২ সালে বিশ^ব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আর্ন্তজাতিক আরও তিনটি সংস্থা-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
এতে পদ্মার আকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। পরের ইতিহাস সবার জানা। সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। কেটে যায় কালো মেঘ, দিগন্ত আলোকিত করে হেসে উঠে সূর্য। সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে শুরু হয় স্বপ্নের বীজ বোনা। আর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এ সেতুর মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবে। ইতিমধ্যে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠছে। সেগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সবমিলিয়ে এটি বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। নতুন করে গড়ে উঠবে ভারি শিল্প কারখানা। আর এরই অপেক্ষায় যেন বাংলাদেশ।
পদ্মা সেতু নিতান্তই একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু নয়। বিশ্বের সেরা প্রকৌশলবিদ্যা আর প্রযুক্তিতে নির্মিত দ্বিস্তরের এ দৃষ্টিনন্দন সেতুটি একটি দেশের জনগণের হৃদয়মথিত আবেগের নাম। স্বপ্ন পূরণে একটি বিশ্বাস ও আস্থার সার্থক রূপায়নের নাম।
ভাবতে ভাবতে আর পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল সেই কর্মযজ্ঞ দেখতে দেখতে ওপারে অথাৎ জাজিরা পৌঁছে গেলাম। পাড় হতে এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগল। মনে মনে ভাবছি আহা! আমি কি সৌভাগ্যবান! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন সময়ে নানান গোলযোগের কারণে যখন হল ছাড়ার নিদের্শ আসত তখন পদ্মার ওপারের বন্ধুদের সেই উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার প্রকৃত কারণ আজ এতদিন পর যেন অনুভব করলাম। তখন এভাবে কখনো অনুভব করিনি। এই ফেরি পারাপারের কারণে পদ্মার ওপারের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মন চাইলেও সময় ধরে হয়ত কোন দিনও বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কত গুরুতর অসুস্থ রোগীকে ঘাটে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে ফেরির জন্য। কিংবা কত যাত্রীবাহী বাস, মালবাহি ট্রাককে দিনের পর দিন পারাপারের সিরিয়ালের ভোগান্তি সয়ে যেতে হয়েছে। হয়তো কত পচনশীল পণ্য পথেই নষ্ট হয়েছে।
তবে পদ্মা পারাপারের সেই দৃশ্য, সেই ভোগান্তি আজ শুধুই দুঃখের ইতিহাস। কারণ আজ পদ্মার বুক চিরে দু’পারের তথা বাংলাদেশের দুটি অংশকে যুক্ত করে দিয়েছে ঐতিহাসিক এক স্বপ্নের সেতু, পদ্মা সেতু। সততা, দেশপ্রেম, দৃঢ় মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার সাক্ষী হয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে যুগ থেকে যুগান্তরে দাঁড়িয়ে আজকের ‘পদ্মা সেতু’। বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদার প্রতীক ‘পদ্মা সেতু‘ ২৫ জুন ২০২২ খ্রি. তারিখে শুভ উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তলাবিহীন ঝুড়ি, বন্যা জলোচ্ছাস্ আর প্রাকৃতিক দূর্যোগের দেশ হিসেবে যারা তাচ্ছিল্য করেছে এদেশেকে। যারা ভেবে ছিল বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া কখনও সম্ভব নয় প্রমত্তা পদ্মার বুকে এমন সেতু নির্মাণ তারা আজ দেখে যাক। রামের মন্ত্রপরা পাথরে গড়া সেতু নয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা আর কঠোর নেতৃত্বে অর্জিত বাংলাদেশের নিজস্ব অথায়নে গড়া স্বপ্নের সেতু, পদ্মা সেতু-পদ্মায় বুক চিরে মাথা উঁচু করে আত্মমর্যাদার প্রতীকরূপে দন্ডায়মান। যা ঘোষণা করে বাঙালি বীরের জাতি। যে জাতি হারতে শিখেনি। যে জাতির মুক্তির দিক্ষা দিয়ে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর আজ তার কন্যার হাত ধরে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
লেখক : পুলিশ সুপার, লালমনিরহাট।
(অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদন্নোতিপ্রাপ্ত)