আব্দুর রাজ্জাক
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অনন্য দূরদর্শী রাজনীতিবিদ, যিনি তাঁর রাজনৈতিক চেতনাবোধ ও দার্শনিক চিন্তার সুতীক্ষ্ম গভীরতায় একটি অনগ্রসর জাতিকে মুক্তির আস্বাদ গ্রহণের জন্য রাজনৈতিকভাবে সচেতন করেছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ বাঙালি জাতি প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনের কারণে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে ও ভাবনায় ছিল বাঙালি জাতি, একটি অপশাসনের করালগ্রাস হতে এই জাতিকে তিনি উত্তোরণ করার অভিপ্রায় পোষণ করেছেন অহর্নিশ। একটি পরাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের মনে স্বাধীনভাবে মানচিত্র অঙ্কনে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা ও সাহস যুগিয়েছিলেন যে মানুষটি, তিনি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন শোষণহীন ও বৈষম্যহীন সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের একটি স্বপ্নের সোনার বাঙলা। ‘গরীব হবে এই রাষ্ট্রের ও সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না। এই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ থাকবে না। এই রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র হবে সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। পরাধীনতার নিগড়ে আবদ্ধ একটি জাতিকে তিনি স্বাধীন দেশ গঠনের স্বপ্ন যেমন দেখিয়েছিলেন, তেমনি সেই স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে তারও রূপরেখা তিনি অঙ্কন করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ছিল অসাধারণ এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ছিলেন সর্বদা অবিচল। স্বাধীন বাংলাদেশ পাবার পথ পরিক্রমায় তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন লক্ষ লক্ষ নিবেদিত কর্মী, যাঁরা সোনার বাঙলা গড়ার কারিগর হিসেবে ইতিহাসে প্রদীপের বিভায় সমুজ্জ্বল থাকবেন তাঁদের কর্মে। ‘একজন নেতা তখনই তার অনুসারীদের জন্যে সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেন যখন তিনি ত্রিকালদর্শী হন। অর্থাৎ নেতা অতীত সম্পর্কে অভিজ্ঞ, বর্তমানকে অনুধাবণ করেন; এবং ভবিষ্যত দ্রষ্টা হতে পারেন।’ তাঁর নেতৃত্বের গুণের কারণেই তিনি বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের চিন্তা করতে পেরেছিলেন এবং ষাটের দশকে ভবিষ্যত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতও নির্বাচন করে রেখেছিলেন।
উনিশশো একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হবার পর বিশ্বের বুকে একটি নতুন মানচিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়। যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশ গঠন এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলেছেন নিরন্তর। মানুষের ভাগ্যবদলের নিমিত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্ল্যানিং কমিশন এবং রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আদলে বাংলাদেশও পঞ্চবার্ষিক গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের দোসর এদেশের নিকৃষ্ট কিছু সন্তান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে যেমন কলংঙ্ক লেপে দিয়েছে, তেমনি ক্রমবর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক উন্নয়ন পিছনের দিকে নিয়ে গেছে। এতে ‘আইনের শাসন রুদ্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় অর্থনীতির চাকাও। সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্র জাতির উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে।’ বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য-উন্নয়নের জন্য সমকালীন রাষ্ট্রের পরিস্থিতি বিবেচনায় উন্নয়নের নীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়নের রূপরেখা, শিক্ষাখাতে বৈপ্লাবিক বৈদ্ধিক উৎকর্ষ সাধন, স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং শিল্পে নির্ভরতা তৈরিতে বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন সরকার দিবা-রাত্রি কাজ করে গেছেন। শুধু তাই নয়, একটি আধুনিক, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য জনহিতকর রাষ্ট্র গঠনের জন্য যা যা করা দরকার, তিনি তাই করেছেন। ‘কৃষি, পাট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, খাজনা ও ভূমি-ব্যবস্থা সম্পর্কে বৈপ্লবিক প্রস্তাবে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ এবং পরবর্তী সময় সকল জমির খাজনা মওকুফ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কর্মসূচিতে শ্রমিকদের অধিকার, বেকার সমস্য, শিক্ষা, বাংলাভাষা ও সাহিত্য, মোহাজের সমস্যা এবং বৈদেশিক নীতিও ব্যাখ্যা করা হয়। সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়- এ জাতীয় ঘোষণার ভিতর দিয়ে বৈদেশিক নীতি গৃহীত হয়।’ এ কারণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, গৃহীত নীতি ও ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে ভিত্তি ধরে বর্তমান সরকার তৈরি করেছে রূপকল্প-২০২১, রূপকল্প-২০৪১ এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
আত্মনির্ভশীলতা অর্জন
বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, বাঙালি বীরের জাতি। মাথা নত করতে তারা জানে না। সেই বীরের জাতির কর্ণধার বঙ্গবন্ধু সব সময় চিন্তা করতেন কীভাবে দেশকে আত্মনির্ভশীল করা যায়। প্রচন্ড বন্যা ও খরার কারণে উনিশশত চুয়াত্তর সনে বাংলাদেশে প্রায় ২৭০০০ লোকের প্রাণহাণী ঘটে। এ সময় সৌদি সরকার প্রস্তাব দেয়, যদি বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের পরিচালনা করে তাহলে তারা বন্যার্তদের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিবেন। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবিচল বঙ্গবন্ধু সৌদি সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “আমরা নীতি বিসর্জন দিয়ে টাকা নিতে পারি না। আমরা কোন অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় ৪ নীতির সাথে আপোষ করবো না। বাঙালি জাতি তার সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে। যে জাতি রক্ত দিতে জানে, তার আত্মমর্যাদা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।”
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ার জন্য ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্যাংকের নিকট সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক পাকিস্তান কৃতক পূর্বে গৃহীত ঋণের অর্ধেক ফেরত দিতে বললে বঙ্গবন্ধু কড়া ভাষায় জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথক রাষ্ট্র। সংগ্রাম, যুদ্ধ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলার জনগণ স্বাধীনতা লাভ করেছে। জাতিসংঘের কাছ থেকে সকল সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার। অর্থ প্রাপ্তির প্রশ্নে শর্ত কেন, তাই যদি মানতে হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের যে অর্থ সম্পদ পাকিস্তানে রয়েছে তার হিসাব ও পাওনা আগে মিটিয়ে দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই বর্তমান বাংলাদেশ সাবলীলভাবে হাঁটছে এবং অভ্যন্তরীণ যে কোনো সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত পারঙ্গমতার পরিচয় দিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরেই বৈদেশিক সাহায্যের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গঠন করেছেন।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদশে মাসিক ২০-২৫ লক্ষ টন খাদ্য, ১০ লক্ষ টন সিমেন্ট, ৫০ হাজার ঢেউটিনের প্রয়োজন হতো। সরকারি কোষাগারে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ ছিলো না বলে বঙ্গবন্ধু প্রথম বেতন কমিশন গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, সুষম উন্নয়ন ছাড়া দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই বাস্তবতার নিরীখে যথাযথ পরিকল্পনার জন্য বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যাতে বিদেশি সাহায্যের নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে কমানোর ব্যবস্থা ছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সারা জীবনের নিঃস্বার্থ সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের ধ্বংসস্তুপের উপরই জাতির ভবিষ্যত নিমাণের সূচনা করেছিলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশেই তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশে ফোর লেন রাস্তা তৈরি করতে। কিন্তু ঘাতকের বুলেটের আঘাতে সেই স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হলেও এটি এখন স্বপ্ন নয়, এটি বাস্তবে রূপ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের জন্মের ৪৮ বছরের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করার জন্য হাতে নিয়েছে অনুপম প্রকল্প। দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে হাইটেক পার্ক। বতমানে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক।’
তাই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের নিকট দ্রুততম সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাভের রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আসলে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। আজকে প্রধানমন্ত্রী যা করছেন তা বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বকে অনুসরণ করেই করছেন।
দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সফল পররাষ্ট্রনীতি
১৯৭১ এর সাত মার্চের ভাষণে পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু প্রকারান্তরে বাঙালির বহুপ্রতীক্ষিত স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে গিয়ে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘সেই ভাষণ মূলত ছিলো মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা নির্দেশক। অথচ ভবিষ্যত দ্রষ্টা নেতা প্রচন্ড চাপের মুখেও নতি স্বীকার না করে কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে তাৎক্ষণিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকলেন।’ ইদানীং অনেক অর্বাচীন সমালোচক বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু ঐ দিন রেসকোর্স ময়দানে দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে জনসভার লোকজন মার্চ করে ক্যান্টমেন্ট আক্রমণ করে পাকিস্তানীদের তাড়ানো যেত। কিন্তু তারা এটা বুঝতে অক্ষম যে ঐ দিন ঐ সময় পাক জেনারেলগণ সকল প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষাই করছিলেন যে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে তারা রেসকোর্স ময়দান ধূলায় মিশিয়ে দিবে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের ভাষ্য মতে, যদি সে(বঙ্গবন্ধু) পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আমার হাতে যা আছে আমি তার বিরুদ্ধে সব কিছুই ব্যবহার করব। দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আমি ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সব কিছু ব্যবহার করে ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেব। এদেশ শাসন করার মতো কেউ থাকবে না, শাসিত হবার মতোও কেউ থাকবে না। এতে কেবল সাত আট লাখ মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যুই হতনা, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সম্ভাবনাটুকুও ধূলায় মিশে যেত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এর ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগের পরিহার, প্রত্যেক জাতির অভিপ্রায়কে গুরুত্ব দেয়া এবং সাম্রাজ্যবাদ-বণবৈষম্যবাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ধ্রুবতারাস্বরূপ। তিনি বিশ্বাস করতেন সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। বঙ্গবন্ধু কানাডায় কমনওয়েলথ সম্মেলন, আলজিয়াসে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন এবং পাকিস্তানের লাহোরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থানের কথা সুউচ্চ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু দেশ স্বাধীন করেই ক্ষান্ত হননি, দেশটি কুটনৈতিকভাবে কতখানি অগ্রসর হতে হবে তারও রূপরেখা অঙ্কন করেছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধুর কুটনৈতিক সাফল্যের শুরুটা হয় ভারত-বাংলাদেশের পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৭ই মাচ ঢাকায় এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মূলকথা হলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বহিঃশক্তির কবল থেকে রক্ষা করা।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর হতে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বিশ্বের ১৩৪ দেশের স্বীকৃতি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ এ জাতিসংঘের সদস্যপদ এবং ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবের সাথে পদার্পন করার শক্তি প্রবৃষ্ট করেন, যা বাঙালি জাতির সত্তাকে আপন মহিমায় প্রস্ফুটিত করার সুযোগ করে দেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেন, ‘নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আর লক্ষ্যপূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা এগিয়ে যাবো।’ এইভাবেই বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলার প্রারম্ভিক অভিযাত্রা শুরু করেছিলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতায়। ফলশ্রুতিতে তার পররাষ্ট্রনীতির স্বাতন্ত্র বৈশিষ্টের কারণে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন দেশের কর্ণধার হয়েও বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সমধিক পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন
নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে ছিল না কোন ভৌত অবকাঠামো। তবে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে অর্থাৎ নয়মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার একটি অসাধারণ সংবিধান রচনা করেছিলেন। এ রকম একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে পাকিস্তানের সময় লেগেছিলো নয়বছর। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রায় এককোটি মানুষকে তিনি পুনর্বাসন করেন। জননিরাপত্তার কথা ভেবে এবং দেশে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং অপরাধ প্রতিরোধ ও সনাক্ত করতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী গঠন করেন। তা ছাড়া দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী এবং বিমানবাহিনী।
শিক্ষাখাতে উন্নয়ন
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন প্রকৃত শিক্ষানুরাগী। শিক্ষাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতেন তিনি। তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও পরিশীলিত করতে বঙ্গবন্ধু ড. কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যখন শিশুর মত হাঁটিহাঁটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু ১১,০০০ প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ৪০,০০০ প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ করেন। পূর্বের চেয়ে অধিকতর শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিক স্কুলে বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত নাম মাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা পুনর্গঠন করার কাজ শুরু করেন।
আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ ও বঙ্গবন্ধু
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের পাকিস্তানি জীবনের ১২ বছরই কেটেছে কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায়। দীর্ঘ সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলার কর্ণধার হয়েই তিনি বুঝতে পারেন দেশের উন্নতি ও স্থীতিশীলতার জন্য কেবল অর্থের প্রয়োজনই নয়। অর্থের চেয়ে বড় প্রয়োজন দেশের নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করা। একদিকে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার নামধারী কিছু দুষ্কৃতিকারীর হাতে অবৈধ অস্ত্র এবং অন্যদিকে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন-এ দুয়ে মিলে তিনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা তরিৎ উন্নতির জন্য একটি নতুন শৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলেন যার নাম দেন জাতীয় রক্ষীবাহিনী। নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিশ্রুতিশীল দেশপ্রেমিক যুবকদের নিয়ে গঠন করা এই রক্ষীবাহিনী দেশের ক্রমঅবনতিশলীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির ঘটাতে সাহায্য করে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরূপ প্রচারণায় এ বাহিনী নিয়ে তৈরি হয় নানা ষড়যন্ত্র। জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ডের পর জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এর সাফল্যের কাহিনীগুলো পরিকল্পিতভাবে চেপে রেখে সামান্য কিছু ত্রুটি ও আভিযানিক ভুলকে জাতির সামনে তুলে ধরে এ বাহিনীকে ভিলেন আকারে উপস্থাপন করা হয় দীর্ঘদিন।
জাতির পিতার তিরোধানের পর ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সামরিক সরকার পৃথক আইনের মাধ্যমে আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন তৈরি করে, যা মূলত রক্ষিবাহিনীর নতুন রূপ। পরবর্তী সরকারগুলো পুনরায় রক্ষিবাহিনী গঠন করে যায় নি। সে জন্য বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে রক্ষিবাহিনীর মতোই আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠন করে সন্ত্রাসী তৎপরতা ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টা করেছে ।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক পুলিশ কাঠামোতে প্রথম প্যারাডাইম শিফট শুরু হয় ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অনেকে মনে করেন ও পরবর্তী সরকার দাবী করে যে বাংলাদেশ পুলিশের মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থা চালুর কৃতিত্ব জেনারেল জিয়ার। কিন্তু মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়াটির প্রতি একটু দৃষ্টি দিলেই এ দাবীর অসারতা প্রমাণিত হবে।
জাতির পিতার হত্যকা- সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৬ সালের ২০ জানুয়ারি।
জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে তার নেতৃত্বের সরকারকে উৎখাত করে বিশ্বাসঘাতক মোস্তাকের নেতৃত্বে একটি পোষা সরকার গঠন করে ফারুক রসিদ গং। কিন্তু উচ্চাকাঙ্খী সামরিক বেসামরিক টানাপোড়েনেও তারও দ্রুত পতন ঘটে। ৭ই নভেম্বরের অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে জেনারেল জিয়া। ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের পুরো সময়টিই ছিল কু, পাল্টা কু ও ক্ষমতা নিয়ে ষড়যন্ত্রের উপাখ্যান। নভেম্বরে ক্ষমতা গ্রহণ করে ডিসেম্বরেই জেনারেল জিয়া শত বছরের পুলিশ বাহিনীতে এত বড় একটি পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হবেন এমন গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সরকার তার পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনের যে বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা ছিল তারই ধারাবাহিকতা। বস্তুত উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মাত্র তেত্রিশ হাজার জনবল মাত্র এক বছরের মাথায় নব্বই হাজারে উত্তীর্ণ করার পাশাপাশি এই বাহিনীর কাঠামোতে পরিবর্তন আনয়নের জন্য তার নিজস্ব পরিকল্পনা অবশ্যই ছিল।
খনিজ সম্পদ উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা
দেশকে জ্বালানী খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রবল আকুতি ছিল বঙ্গবন্ধুর। তার প্রথম মন্ত্রীসভার মফিজ উদ্দীন আহমদের মাধ্যমে তিনি সারা দেশে জ্বালানী তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে তিনি দেশি-বিদেশি সহায়তারও সন্ধান করেন। ঐ সময় বঙ্গপোসাগরের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল বিশিষ্ট এলাকাকে ৭টি ব্লকে বিভক্ত করে সেগুলোর মধ্যে ৬টি ব্লককে আন্তর্জাতিক কোম্পানীগুলোর মধ্যে খোলা টেন্ডারে শেয়ারিং এর মাধ্যমে তেল-গ্যাস উত্তোলেনর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৭ নম্বর ব্লকটি ছিল সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাপূর্ণ। তাই এ ব্লকটি কোন দেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট রাখা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি, কানাডা, জাপান ও ইউগোস্লাভিয়ার একটি করে মোট ৬টি কোম্পানিকে ৭৬:২৪ অনুপাতে অংশীদারিত্বের এ চুক্তির ফলে সেই সময় বাংলাদেশ সরকার ত্রিশ মিলিয়ন দস্তখতী অর্থ লাভ করে যা ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে ছিল খুবই প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশ ভূখন্ডে পরবর্তীতে পর্যাপ্ত গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়েকটি কুপে তেলের সন্ধানও পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো উৎপাদন শেয়ারিং এ দেশের স্বার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারেনি। এমনকি অনেক দেশ আমাদের নেতানেতৃদের কাছে খনিজ সম্পদ বিক্রয় করে দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল এবং কেউ কেউ তা গ্রহণও করেছিল। দেশের সম্পদ রক্ষা ও তা দেশীয় কোম্পানির মাধ্যমেই দেশের কাজে লাগনোর যে নীতি তা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার কালেও অব্যাহত রয়েছে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যত দ্রষ্টা। তিনি তাঁর যুগের সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক, অথনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং কুটনৈতিক বিষয়াবলি উপলদ্ধি যেমন করেছিলেন, তেমনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমনতর হবার দরকার তার রূপরেখা তৈরি করে গেছেন তার প্রত্যেকটি কর্মে। দেশের স্বাধীনতার জন্য, এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি নিজের জীবনকে বাজি রেখেছেন। তিনি জানতেন, বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্র জন্ম নিবেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভ করতে যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দূরদর্শীতায় আমরা অল্পসময়ের মুক্তিযুদ্ধের পরিক্রমায় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের উপস্থিতির অভিজ্ঞতা লাভ করি। ‘বলা যায়, ভিয়েতনাম সতের বছর সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণ মাত্র নয়টি মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।’ প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।
লেখক : অতিরিক্তি ডিআইজি।