ই-পেপার

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক

সংঘটিত অপরাধের তদন্ত ও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা কোন দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মপদ্ধতি। অপরাধ ছাড়া যেমন কোনো সমাজ হয় না, তেমনি পুলিশ ও আদালতের সর্বোচ্চ সদিচ্ছা সত্ত্বেও অপরাধের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া সব সময় ত্রুটিহীন নির্ভুল হয় না। তাই অনেক সময় সম্পূর্ণ নির্দোষ ব্যক্তি ও পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হয়, কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয় এবং চূড়ান্ত বিচারে নির্দোষ ব্যক্তিরাও সাজা পায়। সাজা হয়তো জরিমানা কিংবা কারাবাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে তার প্রতিকার অনেক সময় পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিচারের রায় যদি হয় মৃত্যুদ- এবং সে রায় যদি কার্যকরও হয়, তবে ভাগ্যাহত নির্দোষ ব্যক্তিদের প্রতিকার পাওয়ার কোনো উপায়ই থাকে না। পুলিশ বিজ্ঞানে এধরনের ঘটনাকে Criminal Investigative Failures বা  ফৌজদারি তদন্তের ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতা বলা হয়।

আমাদের দেশে কোনো নির্দোষ ব্যক্তির একবার সাজা হলে এবং তা যদি আপিলের মাধ্যমে সংশোধিত বা খালাস দেওয়া না হয়, তবে তা সংশোধনের আর কোনো উপায় থাকে না। তবে পৃথিবীর অনেক দেশেই ভুল বিচারের জন্য সন্দেহজনক ঘটনাগুলোকে বিভিন্নভাবে বারংবার যাচাই করে আসামির নির্দোষতা প্রমাণের নানা উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশেও এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলায় এক কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় ভিকটিমকে ধর্ষণপূর্বক হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো জঘন্য ঘটনাটি উল্লেখ করার মতো। ভাগ্যিস ভিকটিম অল্প সময়ের মধ্যেই ফেরত এসেছে বা তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে! যদি ভিকটিমকে উদ্ধার করা না যেত তাহলে অন্য কোনো ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারতো।

যা হোক, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের মতো ততোবেশি উন্নত নয়। আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা কানাডার পুলিশের মতো আমাদের দেশের পুলিশের আধুনিক যন্ত্রপাতি বা উন্নত প্রশিক্ষণ নেই। তাই তদন্ত, গ্রেফতার, সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও সেগুলো আদালতে উপস্থাপনে পুলিশের নানাবিধ দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু সবদিক দিয়ে উন্নত ও অগ্রগামী দেশগুলোর বিশ্বব্যাপী অনুসরণীয় পুলিশ বিভাগগুলোর তদন্ত কি পরিপূর্ণভাবে নিখুঁত? তাদের বিচার ব্যবস্থা কি সর্বাংশে নির্ভুল? উন্নত দেশের পুলিশগুলো সাধারণভাবে উন্নত তদন্ত উপহার দিলেও প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের কাজে কর্মে ব্যর্থতাও ফুটে ওঠে। এসব ব্যর্থতা ও ত্রুটি যেমন গ্রেফতার, তদন্তের সময় তদন্তকারীদের দ্বারা প্রকট হয়ে ওঠে তেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারে ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এমনকি বিচারের ক্ষেত্রেও। আসুন এ ব্যাপারে আমরা কয়েকটি উদাহরণ দেখি।

বার্মিংহাম সিক্স: বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের গোঁড়ামি

১৯৭৪ সালের পহেলা নভেম্বরের রাত আটটায় লন্ডন শহরের বার্মিংহাম এলাকায় দুটো মদের আড্ডায়/বারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই ছিল ব্রিটিশ মূল ভূখ-ে এত বড় ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী ঘটনা যেখানে ২১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল ও ১৮২ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। এ ঘটনায় ব্রিটিশ পুলিশ ছয় জন নিরপরাধ আইরিস ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন রূপে গ্রেফতার করে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ভুল প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ ছয় ব্যক্তির প্রত্যেকের ২১টি করে যাবজ্জীবনের সাজা দেয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ ফৌজদারি বিচারের ইতিহাসে এই ঘটনা তাই ‘দি বার্মিংহাম সিক্স’ নামে পরিচিতি পায়।

বার্মিংহামের বোমা হামলার ঘটনার সময় ব্রিটেনে আইরিস রিপাবলিকান আর্মির (ইরা) সন্ত্রাসী কার্যকলাপ তুঙ্গে ছিল। তাই মনে করা হয়েছিল যে ইরা সন্ত্রাসীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ইরা হল উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গ্রুপ যারা প্রটেস্ট্যান্ট ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার সন্দেহভাজন হিসেবে ছয় জন আইরিস নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। এ ছয় ব্যক্তির জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডে হলেও তারা প্রায় চৌদ্দ বছর যাবৎ লন্ডনে বসবাস করে আসছিল।

এক বন্ধুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদানের জন্য ঐ ছয় ব্যক্তি ঘটনার সময় একই ট্রেনযোগে উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্টে যাচ্ছিলেন। যেহেতু তারা সবাই জন্মসূত্রে উত্তর আয়ারল্যান্ডের নাগরিক ছিল এবং বোমা বিস্ফোরণের পরপরই লন্ডন ছেড়ে বেলফাস্টে যাচ্ছিল, তাই পুলিশের সন্দেহ আরো বেশি হয়েছিল। এমতাবস্থায়, তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। পুলিশ হেফাজতে অমানসিক নির্যাতনের পর তারা ঘটনার সাথে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দেয়। এ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে বিচারে তাদের সাজা দেওয়া হয়েছিল। ঘটনায় নিহত ২১ জন ব্যক্তিকে হত্যার জন্য তাদের প্রত্যেককে ২১টি করে যাবজ্জীবনের সাজা দেওয়া হয়।

তবে মিথ্যা স্বীকারোক্তিই তাদের সাজার জন্য একমাত্র প্রমাণ ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল ফরেনসিক পরীক্ষায় পজেটিভ মতামত। তদন্তকালে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞগণ ঐ ছয় আসামির হাতের তালু থেকে ঘাম নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছিল যে গ্রেফতারের পূর্বে তারা বিস্ফোরক দ্রব্য নাড়া চাড়া করেছিল যার আলামত তাদের হাতে অবশিষ্ট ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে তাদের প্রত্যেকের হাত ভেজা ছিল এবং বিস্ফোরক বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছিল যে তাদের হাতের ঘামে বিস্ফোরক দ্রব্য নাইট্রোগ্লিসারিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিচার চলাকালে একজন বিস্ফোরক বিজ্ঞানী শপথ করে বলেছিলেন যে তিনি শতকরা নিরানব্বই ভাগ নিশ্চিত যে আসামিরা গ্রেফতারের পূর্বে বিস্ফোরক দ্রব্য নাড়াচাড়া করেছিল। যেহেতু বিস্ফোরণের ঘটনার অব্যবহিত পরেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাই আদালত বিশ্বাস করেছিল যে তারা ঐ বিস্ফোরক দিয়েই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। অর্থাৎ আদালত তাদের প্রকৃত দোষী বলেই বিশ্বাস করেছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে জানা গেছে যে মানুষের হাতের ঘামে নাইট্রোগ্লিসারিনের অনুরূপ বস্তুর উপস্থিতি প্রমাণের জন্য বিস্ফোরক নাড়াচাড়া করার দরকার নেই। বাসা বাড়ি রং করার পেইন্ট, মদ, মাটি, জ্বালানি তেল, সিগারেট এমনকি খেলার তাসের মধ্যেও নাইট্রোসেলুলোজ জাতীয় বস্তুর উপস্থিতি

থাকতে পারে যা বিস্ফোরকদ্রব্য নাইট্রোগ্লিসারিনের উপস্থিতির পক্ষে ইতিবাচক রিডিং দিতে পারে।

এখন প্রশ্ন হল, কোনো কারণে ফরেনসিক পরীক্ষায় তাদের হাতের ঘামে বিস্ফোরক দ্রব্যের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিল, এ নির্দোষ ছয় ব্যক্তি ট্রেনের কামরায় বসে সময় কাটানোর জন্য তাস খেলা অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়েছিল। তাস থেকে তাদের হাতের ফরেনসিক পরীক্ষায় নাইট্রোসেলুলোজের উপস্থিতি পাওয়া যায় যাকে বিস্ফোরক বিজ্ঞানীরা রীতিমতো বিস্ফোরক হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের দোষী সাব্যস্তের পথ পরিষ্কার করে দিয়ে ছিলেন। বার্মিংহাম-সিক্সের এ ঘটনা ফৌজদারি তদন্তের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত জঘন্যতম বিশেষজ্ঞ গোঁড়ামির উদাহরণ।

মাদ্রিদ বোমা হামলা : এফবিআই এর

ফিঙ্গার প্রিন্ট কেলেঙ্কারি

এ তদন্তের ঘটনাটি স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ শহরে বোমা হামলা সংক্রান্ত হলেও এর সাথে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআইও ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে এবং তদন্তের ব্যর্থতার অংশটুকু মূলত তাদের গোঁড়ামিরই ফসল ছিল। ২০০৪ সালের ১১ মার্চ স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ শহরে আলকায়েদা সন্ত্রাসীরা চলন্ত ট্রেনে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। এতে ১৯১ জন নিরীহ মানুষ নিহত ও ২০৫০ জন মানুষ আহত হয়।

স্পেনের পুলিশ ঘটনাস্থলের অদূরে রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পিকআপ থেকে কয়েকটি ব্যাগে রক্ষিত কিছু বিস্ফোরকদ্রব্য ও ডেটোনেটর উদ্ধার করে। ডেটোনেটর ভর্তি একটি সবুজ প্লাস্টিকের ব্যাগের ওপর  থেকে ক্রাইমসিন এক্সপার্টগণ বেশকিছু ফিঙ্গার প্রিন্ট উদ্ধার করে। এদের মধ্যে দুটো ফিঙ্গার প্রিন্টের নমুনার ইলেকট্রনিক কপি স্পেনের পুলিশ ইন্টারপোলের মাধ্যমে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ তদন্ত সংস্থা ও পৃথিবীর সবচেয়ে চৌকস হস্তরেখা বিশারদদের নিকট পাঠায়। কয়েক দফা পত্রালাপের পর এফবিআইয়ের এক্সপার্টগণ স্পেন থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্টের উজ্জ্বলতম ডিজিটাল কপি সংগ্রহ করে সেগুলো তাদের চৌকসতম বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নিজস্ব ডাটাবেইজে সংরক্ষিত সাড়ে চার কোটি ফিঙ্গার প্রিন্ট নমুনার সাথে মেলানোর চেষ্টা করে। একটি ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রায় বিশটি নমুনার সাথে মিলে গেলে সমস্যার মধ্যে পড়ে হস্তরেখাবিদগণ। যাহোক এগুলোর মধ্যে থেকে ১৫টি ম্যাচিং নমুনা নিয়ে অপরেশন শুরু করে এফবিআইয়ের গোয়েন্দারা।

তদন্তের একপর্যায়ে তারা ব্রান্ডনমেফিল্ড নামের একজন তরুন আইনজীবীকে শনাক্ত করে। ব্রান্ডন একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম যে ইতোপূর্বে আমেরিকান সেনাবাহিনীর রিজার্ভ ফোর্সে আমেরিকার বাইরেও কাজ করেছিল। সেনাবাহিনীতে যোগদানের সময় সাধারণ নিয়মানুসারে তার ফিঙ্গার প্রিন্ট নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফিঙ্গার প্রিন্ট ডাটাবেইজে সংরক্ষিত ছিল।

ব্রান্ডনের ফিঙ্গার প্রিন্ট স্পেনের পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলে তারা এটাকে সঠিক বলে মনে করেনি। কারণ তাদের কাছে আরো অনেক সন্দিগ্ধ ব্যক্তি ছিল ঘটনাস্থলে পাওয়া ফিঙ্গার প্রিন্ট যাদের সাথে মিলতে পারত। কিন্তু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞরা এতটাই নিশ্চিত ছিল যে তারা মাদ্রিদ পুলিশের দ্বিমতকে পাত্তাই দেয়নি।

মাদ্রিদ বোমা হামলার অন্যতম আসামি হিসেবে ব্রান্ডনকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতে বিচারের সময় ব্রান্ডনের আইনজীবীরা ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে প্রশ্ন তুললে এফবিআই থেকে বলা হয় যে তাদের পরীক্ষা এফবিআইয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের তিন জন বিশেষজ্ঞ দিয়ে ক্রসচেক করা হয়েছে। তাই তারা শতভাগ নিশ্চিত যে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্রান্ডনেরই। কিন্তু এরপর আদালত একজন নিরপেক্ষ ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ দিয়ে ম্যাচিংটি ক্রসচেক করার ব্যবস্থা করে। নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ ও মতামত দেন যে এ ম্যাচিং শতকরা ১০০ ভাগ সঠিক।

কিন্তু এফবিআইয়ের ফরেনসিক বিজ্ঞানীদের শতভাগ নিশ্চয়তা ধূলিসাৎ হল যখন স্পেনের পুলিশ আউনান দাউদ নামের এক আলজেরীয় সন্ত্রাসীর ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে ঘটনাস্থলের ফিঙ্গার প্রিন্টের মিল পেয়ে তাকে গ্রেফতার করে। স্পেনের পুলিশ যে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে আমেরিকার এফবিআই সে বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের উৎকর্ষ প্রমাণে ওঠে পড়ে লাগে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় যে এফবিআইয়ের হামবড়া ভাবছিল নিতান্তই মেকি। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া মূল ফিঙ্গার প্রিন্টের কপি থেকে কপি করা ডিজিটাল কপিতে স্বয়ংক্রিয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেম অনেক বেশি সংখ্যায় ফলস পজিটিভ রিডিং প্রদান করে। কিন্তু এফবিআইয়ের নিজস্ব সংস্কৃতিতে সিনিয়র বিশেষজ্ঞের মতের বাইরে জুনিয়রগণ সাধারণত যায় না। অন্যদিকে তারা নিজেদের পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞ মনে করার মেকি গরিমার জন্যও এমন একটি অনাকাক্সিক্ষত দুঃখজনক ঘটনার জন্ম দেয়।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট ও জাস্টিসের নিজস্ব তদন্ত ইউনিট অফিস অব দি ইন্সপেক্টর জেনারেলের মাধ্যমে বিষয়টি গভীরভাবে অনুসন্ধান করে ২৭৩ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ব্রান্ডনকে অতিদ্রুত মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর তিনি তার ভোগান্তির ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেন। কিন্তু আমেরিকার সরকার ব্রান্ডনের সাথে আপোস করে ঘটনার জন্য লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা এবং তার ভোগান্তির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় বিশ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ করে।

কানাডিয়ান পুলিশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অধ্যাস

সন্দেহের তালিকায় থাকা ভিকটিমের প্রতিবেশী এক ব্যক্তি নিহত ভিকটিমের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেয়নি বলেই পুলিশ সন্দিগ্ধকে বিচারের জন্য প্রেরণ করেছিল। বিচারে অভিযুক্তের যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়েছিল বলে আমি এ ঘটনার নাম দিয়েছি, ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অধ্যাস’। ১৯৮৪ সালে কানাডার অন্টারিও রাজ্যের কুইন্স ভিলেক্রিস্টাইনজোসেফ নামের নয় বছরের এক বালিকা তার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। বালিকা স্কুল বাসে করে বাড়ি ফিরলে ঐ সময় তার বাসায় পিতা মাতা কেউই ছিল না। তিন মাস পরে বালিকার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ময়না তদন্তে জানা যায় তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। একই বাড়িতে অন্য ফ্ল্যাটে থাকতেন পলমর্টিন নামের এক ভদ্রলোক। পুলিশ তাকেই সন্দেহ করে। কেননা বালিকা নিখোঁজ হওয়ার সময় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পলমর্টিনই ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। সাক্ষ্য প্রমাণ অপর্যাপ্ত হলেও পুলিশ ভিকটিমের পাশের ফ্ল্যাটের পলমার্টিনের নামেই অভিযোগপত্র দাখিল করে।

কিন্তু বিচার শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের অপ্রতুলতা হেতু মর্টিন খালাস পায়। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রপক্ষ মর্টিনের খালাসের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে। আপিল আদালত মর্টিনকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। মর্টিন কয়েদি হয়ে জেলখানায় সাজা খাটতে থাকে।

একসময় পাশ্চাত্য মুন-ুকে ভুল বিচারের মাধ্যমে নির্দোষ ব্যক্তিদের সাজাদানের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। একই সময় তদন্ত জগতে ডিএনএ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। উন্নত ডিএন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিকটিম জেসোপের অন্তর্বাস থেকে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ডিএন পরীক্ষায় অপরাধীর যে প্রোফাইল পাওয়া গেল তা মর্টিনের ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে কোনোভাবেই মিলল না। তার অর্থ হল, ঐ হত্যাকা-ের সাথে মর্টিন জড়িত ছিল না। কিন্তু তারপরও তাকে যাবজ্জীবনের সাজা খাটতে হচ্ছিল। নানা কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালে মর্টিনকে হত্যার দায় থেকে মুক্ত করা হল।

নির্দোষ মার্টিনের ভুল বিচার সেইসময় সমগ্র কানাডায় ব্যাপক  হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। মানবাধিকার কমিশনগুলোর আন্দোলনের মুখে অন্টারিও রাজ্যের রলে. গভর্নরের নির্দেশে প্রাক্তন বিচারপতি ফ্রেডকাউফম্যানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনগণ শুনানীর মাধ্যমে বিষয়টির খুঁটিনাটি বের করে নিয়ে আসে। কাউফম্যান কমিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা গেল যে মর্টিনের জেসোফ হত্যাকান্ডের তদন্তের সময় পুলিশ ও সরকারি কৌসুলিরা আদালতের কাছে তুলে ধরেছিল যে ভিকটিম জেসোপ আসামির নিকটতম প্রতিবেশি হলেও তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মার্টিন উপস্থিত ছিলেন না। সাক্ষ্য আইনে অভিযুক্তের পরবর্তী আচরণ তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে প্রাসঙ্গিক হিসেবে উপস্থিত করা যায়। মার্টিনের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ নিকট প্রতিবেশি হয়ে ভিকটিমের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত না থাকাটা ভিকটিমকে হত্যা করার অবস্থাগত প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল।

কিন্তু অভিযুক্তের অপরাধ পরবর্তী আচরণ সাক্ষ্য হিসেবে প্রাসঙ্গিক হলেও ভিকটিমের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত না থাকার বিষয়টি ভিকটিমকে হত্যা করার প্রমাণ হিসেবে অত্যন্ত হাস্যকর হলেও কানাডিয়ান পুলিশ সেটাকে যেমন সাক্ষ্য হিসেবে সামনে এনেছিল তেমনি আদালতও তা আমলে নিয়ে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিল।

ফৌজদারি তদন্তের ব্যর্থতা এর ইতিহাসেরই সমান বয়সি। তদন্ত মূলত অপরাধকে ঘিরে আবর্তিত ঘটনাগুলোর যুক্তি- নির্ভর ধারাবাহিকতা উদ্ঘাটন করা। পুলিশের দক্ষতার ওপরই গড়ে ওঠে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য গল্প। কিন্তু তদন্ত কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যর্থতার জন্য এ গল্পের অনেক স্থানে ছন্দপতন ঘটে। তদন্তকারী কর্মকর্তার গল্পটি চূড়ান্তভাবে আদালতের কাছে আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না। এ পর্যায়ে বিচারক আসামিদের খালাস দেন। কিন্তু পুলিশের তদন্তের অনেক ঘটনাই প্রাথমিকভাবে যুক্তিপূর্ণ হলেও তা আদালতের যুক্তিতে টেকে না। আবার অনেক ঘটনায় আদালত পর্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নির্দোষ ব্যক্তিদের সাজা দিয়ে থাকে।

তবে পাশ্চাত্যের সাথে আমাদের দেশের পার্থক্য হল, ঐসব দেশে আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পরেও নিরপরাধ ব্যক্তিদের শনাক্ত করার কিছু না কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক দেশে বিবেচনাহীন গ্রেফতার, অদক্ষ তদন্ত ও ভুল বিচারের শিকার ব্যক্তিরা সরকার বা পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে এমন ক্ষতিপূরণের ঘটনা খুবই বিরল। আমাদের দেশের বিচারের নীতিতে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য একশত দোষীকে খালাস দেওয়ার অঙ্গীকার থাকলেও নির্দোষ ব্যক্তিদের বাস্তবে খালাস পাবার নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না; দিতে পারি না তাদের জান-মাল- ইজ্জতের যোগ্য ক্ষতিপূরণ।

লেখক : এআইজি (পিঅ্যান্ডআর-২),

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x