ই-পেপার

নিউজ স্ক্রল

মোঃ হারুন অর রশিদ

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ২৮০ জনের দু’টি চৌকসদলের মধ্যে প্রথম ফ্লাইটে ১৪০ জন এবং দ্বিতীয় ফ্লাইটে ১৪০ জন LONG JOURNEY শুরু করি ১৩ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে। বাংলাদেশ পুলিশের পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, মহেড়া টাঙ্গাইল থেকে প্রায় ১২ হাজার কি: মি: দূরে বিরোধপূর্ণ MALI নামক দেশের উদ্দেশ্য।

১৩ জানুয়ারি রাত ২২.০০ ঘটিকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস্ বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ‘গাঙচিল’ আকাশ পথের যাত্রা আরম্ভ করে। আকাশ পথের যাত্রা সত্যিই আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনার সময় বটে। আমি ভীরু মন নিয়ে গাঙচিল বিমানের জানালার গ্লাস খুলে দেখতে লাগলাম রঙধনুর মতো বাঁকা হয়ে উঠা আমার নির্জন একাকিত্বের আকাশে একটি ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ, তবে তারাগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আকাশে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ চোখ খুলে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশের মাঝখানে চলে এসেছে সূর্য। দুপুরের রোদে হালকা নীল দেখাচ্ছে আকাশ। ঝকঝকে, তকতকে উঠানের মতো রোদে ভিজে সাদা মেঘগুলো আহ্লাদে ফেটে পড়ছে। ঝলমলিয়ে দেখতে দেখতে আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। পুনরায় ভীরু মন নিয়ে ‘গাঙচিল’ বিমানের জানালার গ্লাস খুলে দেখতে লাগলাম সাহারা মরুভূমির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুয়েকটি বাবলা গাছ। ওসব অঞ্চল যেমন পাহাড়ি, তেমনি বালিময়, ধুলিকনা, বালি আর বালি। লাউড স্পিকারে শোনা যায় বিমান অবতরণ করবে আমরা MALI নামক দেশে চলে এসেছি। সহকর্মীদের আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনায় ভরপুর বিমান ‘গাঙচিল’। বঙ্গবন্ধুর গড়া বাংলাদেশ এয়ারলাইনস্ বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ‘গাঙচিল’। অবতরণ করবে তাই ধীর গতিতে চলছে প্রথমে শব্দটা শোনা যায় হালকাভাবে। পরে শব্দটা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, একটানা-কিন্তু একরোখা হয়ে। কানে সো সো শব্দ। অনুরোধ আসছিলো সিট লাগানোর জন্য। অবশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার রহমতে MALI নামক দেশের BAMAKO আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। প্রথম বারের মতো দেশটির মাটিতে পা রাখলাম। MALI নামক দেশের BAMAKO আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষমান বিমান কর্তৃপক্ষের বাসে করে টার্মিনালে নিয়ে যায়।

সেখানে অপেক্ষমান খালেদ স্যার আমাদের রিসিভ করেন। প্রত্যেকের নাম ডেকে রোল কল নেন। পরবর্তীতে অপেক্ষায় থাকি সংবাদ আসে আমাদের BANFPU-02-GOUNDAM-MALI-এ যেতে দেরি হবে। বর্তমানে ট্রানজিট করতে হবে খালেদ স্যারের নেতৃত্বে ২০ জন করে। UN NISSION BAS-এ MINUSMA, MEDICAL CENTER, SENOU তে উপস্থিতি। সেখানে MEDICAL CENTER, SENOU এর কর্তৃপক্ষ ৩২ জন ব্যান সিগন্যালে পাঠান এবং ৩৭ জন MEDICAL CENTER, SENOU তে অবস্থান করান। আমার ROOM NO-Q2- 61.

দীর্ঘ ৯ দিন ট্রানজিট শেষে সংবাদ আসলে আমাদের স্বনামধন্য কন্টিজেন্ট ব্যানএফপিইউ-০২, গুনদাম-মালি যেতে হবে। ২২ জানুয়ারি ২০২২ সকাল অনুমান ০৫.৩০ টায় পুনরায় সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ হ্যান্ডব্যাগ, টলি ব্যাগ নিয়ে বামাকো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে রওনা এবং উপস্থিতি। ০৯.০০ টায় বোডিংপাস ও ইমিগ্রেশন, বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠিকতা শেষে ফ্র্যান্সের যুদ্ধ বিমান- এ আরোহন করি ফ্র্যান্সের যুদ্ধ বিমানে আকাশ পথের যাত্রা আরম্ভ করে। আকাশ পথের যাত্রা আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা, এই প্রথম যুদ্ধ বিমানে আরোন। পরে দুপুর ১২.৩০ টার সময় তিমভূক্তো বিমান বন্দরে অবতরণ করবে তাই ধীর গতিতে চলছে প্রথমে শব্দটা শোনা যায় হালকাভাবে। পরে যুদ্ধ বিমানের শব্দটা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, একটানা-কিন্তু একরোখা হয়ে। পথিমধ্যে আমার পাশে বসা কলিগ মোতালেব ভাই অসুস্থ বোধ করছে, কতরাচ্ছে আর আমার মনে হচ্ছে মাথার সবশিরা-উপশিরাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে, চোখ দিয়ে টপ টপ পানি গড়িয়ে পড়ছে। অবশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার রহমতে তিমভুক্তো বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। সেখানে অপেক্ষামান ইউএন সদস্যরা গাড়িতে নিয়ে সুপার ক্যাম্প তিমভুক্তো উপস্থিতি সেখানে যাত্রা বিরতি এবং বিরতি শেষে রওনা, দীর্ঘ ৯০ কিলোমিটার সড়কপথের যাত্রা শেষে গুনদাম শহরের পাশে নিজস্ব কন্টিজেন্টে উপস্থিত। শুরু করলাম জাতিসংঘের মহান দায়িত্ব পালন। 

স্মৃতিময় মিশন ‘মালি’র দৃশ্যপট এবং কালচার

স্মৃতিময় মিশন ‘মালি’র দৃশ্যপট এবং কালচার হয়তো একদিন ভুলে যাব। চারদিকে বালি আর বালি, ২/১ টি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাবলা গাছ, উঁচু-নিচু পাথরের পাহাড় ও বালির ভেতর দিয়ে সরু আঁকা-বাঁকা পাকা/কাচাঁ রাস্তা। অতীতে ফিরে খুঁজতে হবে হারানো সেই দিনগুলোকে। এ দেশের মানুষের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, ব্যবহার, খাবার, পোশাক, শিক্ষা-চিকিৎসা আর বাসস্থান সব কিছু মিলিয়ে আশ্চর্য করছে আমাকে। হিংস্র স্বার্থপরতা, গোষ্ঠিগত, বিভিন্ন ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনের আক্রমণের মুখে-ধর্ম বিরোধের কশাঘাত দেশটার জনগণকে কলুষিত করে ফেলছে। ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনের শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পষ্ট এ দেশের মানুষের জীবনধারণের দৃশ্য আমাকে মর্মাহত করছে। এলাকার সাধারণ মানুষের মানবেতর-অনাকাক্সিক্ষত জীবন যাপন দেখে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার। মাঝে মাঝে পাথরের পাহাড়, বালি আর বালি, দুয়েকটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাবলা গাছে ভরা এই সাহারা মরুভূমি। মিশন এরিয়া- গুনদাম, টংকা, নিয়াপংখি, ধীরে, তিমভুক্তো-সাহারা মরুভূমি এলাকার মানুষের অন্যতম যানবাহন ছোট ছোট বাইক, দু-তিনটি গাধা দিয়ে মালবাহি গাড়ি, গাধার গাড়িতে চড়ে নারী ও পুরুষ সাহারা মরুর বুকে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা যাতায়াত করে। তারা হাট/বাজারেও যাতায়াতের জন্য ওই গাধার গাড়ি ব্যবহার করে। এদেশের নারী এবং পুরুষ সবাই একত্রে কাজ করে। ক্ষুধার তাড়নায় নিশি প্রহরে বাদাম, কলা, পাউরুটিসহ বিভিন্ন খাদ্যের ঝাঁকা মাথায় এবং ঘুমন্ত অথবা জাগ্রত ছোট শিশুকে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে পিঠে বেঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিক্রির সন্ধানে। রান্না করা লাকড়ির সন্ধানে তারা যায় বালি আর বালির এই সাহারা মরুর বুকে যদি জুটে মরা দুয়েকটি বাবলা গাছের ডাল-পালা। সারাদিন পর সন্ধ্যায় ফিরে আসে লাকড়ি, খাদ্য সংগ্রহ করে উঠানের মাঝখানে রান্না করে। সেই খাবার খাওয়ার জন্য শিশুরা বসে থাকে রান্নার চুলাকে ঘিরে। এদেশের শিশুরা ইউএনক্র গাড়ি দেখলে ছুটে আসে বিস্কুট আর পানির আসায়। আর সামান্য পেলে তাতেই অতি খুশি হয় তারা। মালি’র মানুষের গায়ের রং ঘন কালো হলেও মনের দিক থেকে তারা সাদা। এরা ফ্রান্সের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। শুধু এদের মুখের হাসি আর ছোট শিশুর কান্না বাংলায়। আমাদের ভাষা তারা বোঝে না এবং তাদের ভাষা আমরা বুঝি না। পারস্পারিক বোঝাপড়ার জন্য আমাদের ভরসা ইসারা-ইঙ্গিত ও শারীরিক ভঙ্গি। মানুষে মানুষে পার্থক্য শুধুই বাইরে কালো আর ধলো, ভাষা কিংবা রঙ এ কি আসে যায়? মুখের ভাষায় নয় শরীরি ভাষায়, ইঙ্গিতে শুরু করেছি মিশনের ভাষা। এদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বেশ সময় লাগে আমাদের। চলছে বঁচু, বঁচুয়া বলে সম্বোধন করা, ধন্যবাদ জানাতে মেকসি, মেকসি বকু এবং ভালো আছি কিনা তা জানতে ছাবা, ছাবাবিয়া ইত্যাদি বলতে শিখেছি। স্থানীয়দের সঙ্গে দেখা হলে মেকসি, মেকসি বকু, বঁচু, বঁচুয়া  না বলে সম্বোধন করলে কষ্ট পায় এবং মনে করে তাকে ছোট মনে করা হয়েছে। আমি মিশনে আসতে পেরে আনন্দিত ও গর্ববোধ করছি। আমাদের কর্মজীবনে এর ফল সুদূর প্রসার লাভ করবে বলে আমি আশা করি। জাতিসংঘ শান্তি মিশন শেষে বাংলাদেশ পুলিশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে এখন আমি বলিয়ান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী দেশের মতো ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছে এটা বাংলাদেশের অহংকার।

লেখক : এএসআই(নিঃ), মিশন ট্রেড-অটো-ইলেকট্রিশিয়ান

ব্যান এফপিইউ-০২ (রোটেশান-০৪), মালি।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x