ই-পেপার

মোহাম্মদ রায়হান  ইবনে  রহমান

বারবার মনে পড়ে, তার কারণও যথেষ্ট আছে। ১৯৭১ সালে যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পাগল প্রায় বাঙালি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশ যখন উত্তাল- আমি তখন আব্বার চাকরির সুবাদে আমার বড় বোনসহ ফকিরহাট মূলঘর, বাগেরহাটে। আমার আব্বা একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে মুলঘরে সরকারি এতিমখানার সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। সেই সুবাদে আমি এবং আমার বড় বোন আব্বার কাছেই ছিলাম, তখন আমার বয়স ৭-৮ এবং বড় বোনের বয়স ১০ /১১ হবে। মা’সহ আমার অন্য ভাই-বোনেরা গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দেশের সাথে সকল জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আব্বা আমাদের নিয়ে বাগেরহাট, ফকিরহাট মুলঘরে। অপর প্রান্তে আমার মা বোন ভাইদের নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেশের বাড়িতে। অতএব বুঝতেই পারছেন কি পারিবারিক টানা পোড়েন। মায়ের সাথে আমার আব্বা এবং আমাদের ভাই বোনদের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। সে এক নিদারুণ দুরবস্থা, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দেশের বাড়ির সকলেই ভাবতে থাকে আমরা বোধ হয় আর বেঁচে নেই। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ভাষণ ‘বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না’ মুক্তিযোদ্ধারা এই মন্ত্র বুকে ধারণ করে সশস্ত্র পাক সেনাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আমার আব্বা মোঃ লুৎফর রহমান প্রায় ৩০০ একর জমির ওপরে প্রতিষ্ঠিত সরকারি এতিমখানার সুপারেনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে প্রায় পাঁচশত এতিম বাচ্চা থাকতো ও লেখাপড়া করত। মাকে না পেয়ে আমরা ভাই-বোন প্রায় সময় কান্নাকাটি করতাম। আব্বার সরকারি কাজ ছাড়াও সেই সময়কার খুলনা জেলার ডিসি মহোদয় মোঃ আজহার উদ্দিন প্রায়শঃ আব্বার কাছে আসতেন এবং অফিসে বসে কথাবার্তা বলতেন। অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত গোপনে আব্বার অফিসে মিটিংয়ে মিলিত হতেন। আমরা ভাই বোন অনেক সময় ভয় পেয়ে আব্বার কাছে গেলে- আব্বা বলতো, তোমরা উপরে যাও। সারা রাত্রি জেগে আব্বা রেডিওতে চরমপত্র নামক একটি অনুষ্ঠান শুনতেন। এখন আমরা বুঝতে পারি আসলে উনারা সারারাত জেগে অত্র এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা, খাওয়ার ব্যবস্থা ও অস্ত্র মজুদের কাজ করতেন। এতিম বাচ্চাদের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধারা রাতের বেলায় শুয়ে থাকতো এবং শেষ রাতের দিকে বিভিন্ন অভিযানে বেরিয়ে পড়তো। দিনের বেলায় আবার এসে এতিমখানায় অবস্থান করতো। এমনিভাবে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করে মুক্তিযোদ্ধারা অত্র এলাকার পাক সেনাদের পর্যদুস্ত করে। এমনি করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পার হতে লাগলো, এতিমখানাটি দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্গ হিসেবে গড়ে উঠলো। এতিমখানাটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান, অস্ত্র মজুদ ও প্রশিক্ষণের কথা একসময় পাক সেনারা জানতে পারে। ইতিমধ্যে আমার এক মামা খুলনার রুপসাতে আমের আড়তে কাজ করছিল, অনেক কষ্ট করে মূলঘরে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। মামাকে দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা, আর সেই রাতে ঘটলো ভয়াবহ পাক সেনার অভিযান।

দেশের বিভিন্ন স্থানে পাক সেনাদের পরাজয়, তাদের বিপর্যস্তের কথা রেডিও এর মাধ্যমে জানতে পেরে আব্বা ভীষণ খুশি। পাক সেনাদের বিভিন্ন স্থানে পরাজয়ের পর তারা আরো বেশি ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় প্রতিটি রাত বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে, ভয়ে আমরা ভাই-বোন আব্বার সাথে শুয়ে থাকতাম। সন্ধ্যার পরপরই বাবা আমাদের খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিতেন, সেদিন কেন জানি ঘুম আসছিল না। বাবাও চুপ করে আমাদের রেখে নিজে অফিসে চলে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মিটিং করার পর গভীর রাতে বাবা আমাদের কাছে ফিরে আসেন। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে সেদিন বাইরে কুকুরের করুণ কান্না ও শিয়ালের ডাক রাতের পরিবেশকে থমথমে করে তোলে, ঠিক তখনই ভারী বুটের শব্দে আমরা সবাই জেগে উঠি। সাথে সাথে দরজায় প্রচন্ড ভাবে আঘাত আর, উর্দুতে বলতে থাকে দরজা খুলে দাও, আমরা তোমাদেরকে ঘিরে ফেলেছি। বাবা আমাদের ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটি খুলে দেয়, সাথে সাথে খাকি পোশাক পরিহিত পাক সেনারা আমার আব্বাকে বেঁধে ফেলে এবং চোখও সাথে সাথে বেধে ফেলে। আমি তখন দৌড়ে এসে বাবাকে ধরে ফেলি এবং কান্না করতে শুরু করি। সামনে থেকে পাক সেনার একজন সদস্য জোরে বুকে লাথি মেরে আমাকে দূরে ঠেলে দেয়, আমি জোরে জোরে কাঁদতে থাকি, সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ইতোমধ্যে মামাকে পাশের ঘর থেকে হাত, চোখ বেঁধে আমাদের ঘরে নিয়ে আসে। সেখান থেকেই পাক সেনারা উর্দু ভাষায় গালি দিতে থাকে এবং মারতে মারতে বাবা ও  মামাকে নিচতলার অফিসে নিয়ে যায়। বুটের লাথি খাওয়ার পর চলার  সামর্থ্য হারিয়ে ফেলি ও চোখেও কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার বড় বোন আমাকে নিয়ে সারারাত কাঁদতে কাঁদতে রাত পার করে। সকাল বেলা বাবার অফিসের সকল সহকর্মীরা আসে এবং আমাদের উদ্ধার করে। তাদের মুখ থেকেই জানতে পারি বাবার অফিস থেকে গ্রেনেড ও অস্ত্র উদ্ধার করে পাক সেনারা। আমার বাবা ও মামাকে তাদের ফকিরহাট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমি ও আমার বোন অঝোরে কাঁদতে থাকি এবং বাবা মা বলে চিৎকার করতে থাকি। ২৪ ঘন্টা পর রক্তাক্ত অবস্থায় আমার বাবা ও মামাকে পাক সেনারা এতিমখানার গেটে ফেলে রেখে চলে যায়। অতঃপর অত্র অফিসের পিয়ন, নার্স ও দারোয়ানরা ধরাধরি করে বাবা ও মামাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। বাবাকে এ অবস্থায় দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি, এ যেন সন্তানদের সাথে বাবার মহামিলনের দৃশ্য। পাক সেনারা এতিম বাচ্চাদের কথা ভেবে হয়তো বাবাকে না মেরে তার অফিসে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, এতিমদের দোয়ার কারণেই হয়তো আমার বাবাকে পাক সেনার হাত থেকে আমরা ফিরে পেয়েছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়, বাবাকে নিয়ে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করে অনেক অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত আমাদের গ্রামের বাড়ি পৌঁছাতে সক্ষম হই এবং মা ভাই বোনদের ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি।

ডিসেম্বর মাস আসলেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই ভয়াল রাত্রির দৃশ্য, যা আজও আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। সাথে সাথে মা ও ছোট ছোট ভাইবোনদের ফিরে পাওয়ার আনন্দ আমাকে বিমোহিত করে। তাই বিজয়ের মাস আসলে আমার মন আনন্দে ভরে যায়, মুক্ত স্বাধীন দেশ পাওয়ার আনন্দ ও বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। আব্বা গত হয়েছেন অনেকদিন হলো কিন্তু তার মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার কারণে শ্রদ্ধায় মাথা উঁচু হয়ে যায়। আব্বা তোমাকে জানাই স্যালুট। লাল সবুজের পতাকায় তুমি বেঁচে

থাকবে সারা জীবন এই কামনাই করি। ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে অঙ্গীকার করছি, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন এই দেশ ও পতাকা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত থাকবো, ইনশাল্লাহ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক : সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার

বাংলাদেশ পুলিশ, সিআইডি

রাজশাহী মেট্রো অ্যান্ড জেলা।

ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন :)