মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
পাকিস্তানের সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষার্থী ব্যাচের একজন ছাত্র হিসেবে ১৯৭০ সালের মার্চে আমি এসএসসি পরীক্ষা দিই। আর ঠিক এক বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের মার্চে বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায় রচিত হয়। আমি তখন একাদশ শ্রেণী বা উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সেই অগ্নিঝরা মার্চ এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপটের যতটুকু মনে পড়ে, সেখান থেকে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার বৌলতলী সাহাপুর ইউনিয়ন হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর ১৯৭০ সালের আগস্টে আমাদের তৎকালীন জেলা সদরে অবস্থিত ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হই। ফরিদপুর শহরে নিজেদের বা আপন কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়ি না থাকায় প্রথম থেকেই কলেজের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়। বিশাল বড় গভীর টলটলে পানিতে ভর্তি একটি পুকুরের চারপাশে আমাদের হোস্টেলের ঘরগুলো। একাধিক পাকা বাঁধানো ঘাট। নিবিড় দূর্বাঘাসে ঘেরা মসৃণ পুকুর পাড়। নানা রঙে মনছোঁয়া সে এক মনোরম পরিবেশে পূর্ণ ছিল দিনগুলো। কিন্তু এ সুখ আর আনন্দ বেশি দিন রইল না। একাত্তর সব কিছু তছনছ করে দিলো। তার বিনিময়ে পেলাম বাংলাদেশ। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়, এটাই চিরন্তন সত্য। আমরা কিছু কম দিইনি। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত ঢেলেছি। পেয়েছি সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া, মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর থেকে যা দেখে আসছি, তার মর্মপীড়ায় দেহ-মন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বারবার। তারপরও দাঁড়িয়ে আছি, মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছি। এটাই বাঙালি জাতির শক্তি, কৈ মাছের প্রাণ। এ ব্যাপারে লেখা এই প্রবন্ধের বিষয় নয়। তাই স্মৃতি কথার প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে আমাদের বাংলা গদ্য পড়াতেন অধ্যাপক জিএম আব্দুল হালিম। দুটি কারণে স্যারের কথা বিশেষভাবে সব সময় মনে পড়ে। প্রথমত, স্যার ছয় মাস ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধু রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পটি এমনভাবে পড়িয়েছেন, যার ফলে এই প্রৌঢ় বয়সে এসেও গল্পের নায়িকা হৈমন্তীর দুঃখ-বেদনায় হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। অল্প বয়সে মা হারানো ও বাবার একান্ত আদরে বড় হওয়া মেয়ে হৈমন্তীর শ^শুরবাড়িতে তার কষ্টের কথা এবং সেখানে একদিন মেয়েকে দেখতে এলে শ^শুর-শাশুড়ির দ্বারা বাবার অপমানে বিদ্ধ হয়ে হৈমন্তীর সেই হৃদয়বিদারক উক্তি, ‘বাবা, আর কোনো দিন তুমি এ বাড়িতে এলে আমি দরজায় কপাট দিব’, মনকে আজও ভীষণভাবে কাঁদায়।
দ্বিতীয়ত, হালিম স্যারকে মনে পড়ে এমন একটা ঘটনার জন্য, যার প্রভাব আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অবিস্মরণীয় অধ্যায়, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সহায়ক ছিল ঘটনাটি। বলার আগে তার প্রেক্ষাপটটি একটু বলা দরকার। ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় বয়স ১৮ বছর না হওয়াতে আমি ভোট দিতে পারি নি। কিন্তু ভোটের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, দুপুরের খাওয়া বাদ দিয়ে গ্রামের বয়স্কদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসা এবং আবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার অফুরন্ত উৎসাহ, উদ্দীপনা, উত্তেজনা ও আকর্ষণের স্মৃতি মনের মণিকোঠায় মণি-মুক্তর মতো জমা হয়ে আছে। সেগুলো হৃদয়ের পাটাতন ভেদ করে আজও যখন জাগ্রত হয়, তখন তার চেতনায় ও অনুভূতিতে যেভাবে আচ্ছন্ন হই, তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব কাজ। তা একেবারে অন্য রকম। এক কথায় অনন্য। সে রকম সময় জীবনে আর কখনো ফিরে আসবে না। সত্তরের ভোটের দিনের শেষ মুহূর্তের একটা ঘটনা না বললেই নয়। শীতকাল, ভোট দেওয়ার শেষ সময় ছিল বিকেল ৪টা পর্যন্ত। তাই ৪টা বাজতেই কেন্দ্রে প্রবেশের সব গেইট বন্ধ হয়ে যায়। ৪টার একটু বেশি বাজে, এমন সময় সত্তর-বাহাত্তর বয়সের একজন বৃদ্ধা ভোট কেন্দ্রের অদূরে নৌকা মার্কার নির্বাচন পরিচালনা কেন্দ্রে আমাদের কাছে এসে বলছেন, ‘বাবারা, আমি ভোট দিব।’ আমরা তাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম এখন আর ভোট দেওয়ার সময় নেই। এ কথা শুনে বৃদ্ধা তাৎক্ষণিক আমাদের সবার সামনে প্রথমে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর কান্নাকাটি, গড়াগড়ি। তার একটাই কথা, ‘আমি শেখের বেটাকে ভোট দিতে এসেছি, ভোট না দিয়ে আমি যাব না’। আমরা উপস্থিত অল্প বয়সের কয়েকজন ছাত্র, একে-অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে বুঝে উঠতে পারছি না কি করা। বৃদ্ধার কান্নাকাটি কিছুতেই থামছে না। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আমাদের থানার অন্য একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমরা অনেক আকুতির সঙ্গে বললাম, স্যার, এই বৃদ্ধা ভোট দিতে না পারলে মনের কষ্টে আমাদের সারা দিনের পরিশ্রম পণ্ড হয়ে যাবে। আপনি দয়া করে অনুমতি দিন। অন্য কোনো পক্ষ যাতে প্রতিবাদ না করে সেটা আমরা দেখব।’ শেষমেশ প্রিসাইডিং অফিসার অনুমতি দিলেন। ভোট দান শেষে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আমাদের সামনে এসে বৃদ্ধা গালভরা যে হাসিটা দিল, সেটি কোনো দিন ভুলার নয়। তার মূল্য কোনো কিছুর বিনিময়ে নির্ণয় করা করা যায় না। এক কথায় সেটি অমূল্য। এই হাসির মূল্য তখন বুঝতে না পারলেও পরিণত বয়সে এসে আজ যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন উপলব্ধিতে আসে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ওই বৃদ্ধার মতো অগনিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সাড়ে সাত কোটি মানুষের এমনই তীব্র আকাক্সক্ষার শক্তিতে বাংলাদেশ মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে স্বাধীন হতে পেরেছে। সমস্ত বাঙালির হৃদয়ে শেখ মুজিবের নাম অমোচনীয় কালিতে প্রোথিত হওয়ার প্রমাণটা আমরা এভাবেই পাই।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে এককভাবে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারিতে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) দলের সব জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শপথ বাক্য পাঠ করান। তাতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ছয় দফার সঙ্গে কেউ আপস করলে বাংলার মাটিতে তার কবর রচিত হবে, এমনকি আমি করলে আমারও।’ এই ৩ জানুয়ারির এক-দুই দিন পর হঠাৎ একদিন হালিম স্যার আমাদের তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে আমাদের কলেজ শাখা ইউওটিসিতে ভর্তি করে দিলেন। এখনকার বিএনসিসির আগের নাম ছিল ইউওটিসি। স্যার বললেন, ‘তুই লম্বা, পাতলা আছিস সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র চালানো শিখলে ভালো হবে, পরবর্তিতে কাজে লাগবে।’ স্যারের কথা সেদিন ঠিক বুঝতে পারিনি কি কাজে লাগতে পারে। সপ্তাহে দুই দিন বিকেলে দেড় ঘণ্টা করে কলেজ মাঠেই আমাদের প্রশিক্ষণ হতো। খাকি পোশাক, বুট, বেল্ট, টুপি পরে প্যারেড করতে ভালোই লাগত। থ্রি নট থ্রি মডেলের রাইফেল দ্বারা অস্ত্র চালানোও আমাদের শেখানো হতো। প্রশিক্ষণ দিতেন একজন মাত্র পাঞ্জাবি মিলিটারির হাবিলদার পদবীর সৈনিক। বাংলা-উর্দু মিলিয়ে তিনি আন্তরিকভাবেই আমাদের সবকিছু বোঝানোর চেষ্টা করতেন। আমরা সবাই তাঁকে সম্মান করতাম এবং ওস্তাদজি বলে ডাকতাম। এভাবে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে একাত্তরের মার্চ চলে এলো।
পয়লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন। ওই দিন বিকাল থেকে সবকিছু যেন দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল। কলেজ খোলা থাকলেও ক্লাস হচ্ছে না। সারা দিন মিছিল-মিটিং এবং স্লোগানে স্লোগানে ক্যাম্পাস ভরপুর। আমাদের ছাত্র নেতারা প্রতিদিন গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন। ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সারা দেশের সঙ্গে ফরিদপুরেও হরতাল পালিত হচ্ছে। ৭ মার্চ দুপুরের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য হোস্টেলে যেসব রুমে রেডিও ছিল সেখানে সবাই জড়ো হলো। দুপুর হতেই রেডিও থেকে ঘোষণা শুনছিলাম। বিকেলে রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচার করা হবে। কিন্তু আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকার পরেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেদিন শুনতে পেলাম না। পরে অনেক রাতে জানলাম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের হুকুমে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই সময়ে ফরিদপুর বসে ঢাকার খবর এখনকার মতো যখন-তখন পাওয়া যেত না। অনেক রাতে খবর পেলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তাৎক্ষণিক সব পর্যায়ের ও শ্রেণীর বাঙালিরা ঢাকার রেডিও এবং টেলিভিশনের কাজ ফেলে বের হয়ে যায়। পরে ওই সন্ধ্যায়ই তারা স্থায়ী কর্মবিরতি ঘোষণা করে। ফলে রাতেই পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ পুনরায় ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় ৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুনঃপ্রচার করা হবে। যথারীতি ৮ মার্চ সকালে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হলো। ভাষণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ঘোষণার পর চারদিক থেকে একসঙ্গে উল্লাসিত চিৎকার আর জয় বাংলা স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে হোস্টেলের ক্যাম্পাস। ভাষণ শোনার পর সবার মুখেই এক কথা- ওদের সঙ্গে আর থাকা হবে না। যুদ্ধ অনিবার্য। ছাত্র নেতারা নির্দেশ দিলেন সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের বললেন, তোমরা ইউওটিসির প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাও। এক সপ্তাহের বিরতির পর ৮ মার্চ বিকেলে আবার প্রশিক্ষণের জন্য পোশাক আর অস্ত্র আনতে গিয়ে দেখি সব কক্ষে তালা লাগানো। আমাদের পাঞ্জাবি হাবিলদার ওস্তাদের কক্ষের কাছে গিয়ে দেখি সেখানেও তালা লাগানো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওস্তাদকে আর কোথাও পাওয়া গেল না। পরে জেনেছি ৭ মার্চ ভাষণের পর ওই রাতেই ওস্তাদ ঢাকায় তার মূল ইউনিটে চলে গেছে। ওস্তাদকে খুঁজে না পাওয়ার খবর পেয়ে অধ্যক্ষসহ অনেকে এলেন। সিদ্ধান্ত দিলেন ইউওটিসির অস্ত্র দিয়ে ছাত্রদের জন্য আরো বৃহত্তর পরিসরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হবে। এর মধ্যে ১৫ কিংবা ১৬ মার্চ আমি গোপালগঞ্জে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে এলাম। এসে দেখি ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পরদিন থেকে আমাদের গ্রামের অবসর প্রাপ্ত একজন পুলিশ হাবিলদারের নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকদের প্রাথমিক সামরিক কলা-কৌশল শেখানোর প্রশিক্ষণ চলছে। হালিম স্যার সেদিন কেন বলেছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণ নিলে সুবিধা হবে তার মর্মার্থ তখন কিছুটা উপলব্ধি করতে শুরু করলাম। তারপর এলো সেই ২৫ মার্চ। ২৬-২৭ মার্চ ঢাকা থেকে আগত মানুষের মুখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবরসহ জানতে পেলাম বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।
0 Comments